হাই-টেক যুদ্ধের নতুন যুগের সূচনা
বড় যুদ্ধে যেসব দেশ জড়ায় — তাদের জনগণকেই চোকাতে হয় চরম মূল্য, তাদের বিয়োগান্তক পরিণতিরও অন্ত থাকে না। বৃহৎ সংঘাত পৃথিবীর অন্যান্য দেশের যুদ্ধ প্রস্তুতিতেও প্রভাব ফেলে; যার অবধারিত পরিণতি দেখা যায় বৈশ্বিক নিরাপত্তায়। ইতিহাস বলে, বিশ্ব শক্তিগুলো সংঘাতের এই শিক্ষাকে আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করে। সে অনুযায়ী নিজ সামরিক বাহিনী, প্রযুক্তিতে আনে নানান সংযোজন বা পরিবর্তন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধকালে গেটিসবার্গের মতো মোড় পরিবর্তনকারী লড়াইগুলো অধ্যয়নে পর্যবেক্ষকদের পাঠিয়েছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি।
১৯৭৩ সালে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে সংঘটিত হয় ইয়ম-কিপুর যুদ্ধ; যেখানে উভয় পক্ষের ট্যাংক বেশকিছু প্রচণ্ড লড়াইয়ে একে-অপরের মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধার্জিত শিক্ষা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে আমেরিকান সেনাবাহিনীতে; যা তৎকালে ভিয়েতনামে পরাজিত বাহিনীটিকে ১৯৯১ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার শক্তি যুগিয়েছিল। উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রযুক্তি ও কৌশল থেকে শিক্ষা নিয়েছিল চীন। তারই ধারাবাহিকতায়, চীনের গণমুক্তি ফৌজ আজ বিশ্বের অন্যতম দুর্বার শক্তি হিসেবে গড়ে উঠেছে।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর ইউক্রেন যুদ্ধই ইউরোপের বুকে সর্ববৃহৎ যুদ্ধ। আগামী কয়েক দশক ধরে সংঘাতের বোঝাপড়া বদলাতে এটি ভূমিকা রাখবে। আধুনিক যুদ্ধ কেবল বিদ্রোহী দমনের অভিযান বা সাইবারস্পেসে সীমিত রক্তপাতের দ্বৈরথ — এমন অনেক ভুল ধারণাকেই ইতোমধ্যেই চূর্ণ করেছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ।
বরং নতুন ধরনের তীব্রতর যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে চলমান এ লড়াই, যেখানে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি ব্যাপক গোলাবারুদের ব্যবহার হবে, চলবে হত্যাযজ্ঞ। সংঘাতে জড়িতদের মিত্র দেশ ও তাদের বেসামরিক নাগরিক, কোম্পানিগুলোও তাতে জড়িয়ে পড়বে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পশ্চিমা বিশ্ব ও চীন – উভয় শিবির আগামী দিনের সংঘাতে এগিয়ে থাকতে এই যুদ্ধকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করছে।
ইউক্রেনের হত্যালীলার ময়দান তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। প্রথমটি হলো যুদ্ধক্ষেত্র আরও স্বচ্ছ বা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। না আদ্যিকালের বাইনোকুলার বা ম্যাপের কথা হচ্ছে না। আজকের বাস্তবতায় আপনাকে ভাবতে হবে, সর্বাধুনিক সেন্সরসজ্জিত সর্বদ্রষ্টা স্যাটেলাইট ও ড্রোন বহরের কথা। এগুলো যেমন সাশ্রয়ী, তেমনই যুদ্ধক্ষেত্রের সর্বত্রই নজরদারি চালাতে পারে।
এদের অ্যালগরিদমে এতটাই উন্নতি করা হয়েছে যে, খড়ের গাদা থেকেও সুচ খুঁজতে ওস্তাদ তারা। যেমন কোনো রাশিয়ান জেনারেলের মোবাইল ফোনের সিগন্যাল, ক্যামোফ্লজ দিয়ে লুকিয়ে রাখা ট্যাংক ইত্যাদি চিত্র বিশ্লেষণ করে নিজেই শনাক্ত করতে পারে এ যুদ্ধ সরঞ্জামগুলো। তারপর এসব তথ্য যুদ্ধরত সেনাদের কাছে সরাসরি পৌঁছে যায়। এভাবে শত্রুর লক্ষ্যবস্তুতে অভূতপূর্ব নির্ভুলতার সাথে রকেট বা আর্টিলারি হামলা করা সম্ভব হচ্ছে।
যুদ্ধক্ষেত্রের এই অতি-স্বচ্ছতার উন্নত মানের অর্থ ভবিষ্যতের যুদ্ধ বিপুল পরিসরে নজরদারির ওপর নির্ভর করবে। অগ্রাধিকারের মধ্যে প্রথমে থাকবে শত্রুর আগেই তাকে শনাক্ত করা; তাদের ড্রোন ও স্যাটেলাইট ইত্যাদি নজরদারি উপকরণকে নিষ্ক্রিয় করা অথবা ফাঁকি দেওয়া এবং তাদের তথ্যপ্রবাহকে ব্যাহত করা। এই কাজগুলো সাইবার হামলা, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের মাধ্যমে করা যেতে পারে।
আবার প্রচলিত গোলাবারুদের আঘাত হেনেও তা করা যাবে। গতিশীলতা, দ্রুত ছড়িয়ে পড়া, আত্মগোপন ও শত্রুর চোখে ধুলো দেওয়ার ওপর জোর দিয়ে সৈন্যদেরও লড়াইয়ের নতুন সব কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে। যেসব বৃহৎ সামরিক বাহিনী এসব কৌশল ও প্রযুক্তি আয়ত্তে ব্যর্থ হবে – সহজেই তারা একাজে দক্ষতা অর্জন করা ছোট সামরিক বাহিনীর হাতে নাস্তানাবুদ হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগেও ইউক্রেন যুদ্ধের দ্বিতীয় শিক্ষা হলো – এখনও বৃহৎ যুদ্ধে বিপুল জনবল প্রয়োজন। আর অবধারিতভাবেই হতাহত হবে লাখো বেসামরিক মানুষ। গোলাবারুদ, রণসরঞ্জামও ব্যবহার হবে প্রচুর। ইউক্রেনে মারাত্মক হতাহতের ঘটনা লক্ষ করা গেছে — যার পেছনে ভূমিকা রেখেছে সহজে শত্রুর অবস্থান দেখতে পাওয়া এবং তার ওপর আঘাত হানার সক্ষমতা। এতে লাশের পাল্লাই ভারি হয়েছে কেবল। এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভার্দান বা প্যাশানডেলের লড়াইয়ের মতো পরিখা খুঁড়ে আত্মগোপনের চেষ্টা করছে সৈন্যরা।
এদিকে গোলাবারুদ ও যুদ্ধ উপকরণের ক্ষয়ও হয়েছে আকাশচুম্বী। এক বছরে রাশিয়া এককোটির বেশি গোলা নিক্ষেপ করেছে। প্রতি মাসে গড়ে ১০ হাজার ড্রোন হারিয়েছে ইউক্রেন। এখন পাল্টা-আক্রমণ অভিযানের জন্য পশ্চিমা মিত্রদের কাছে ক্লাস্টার বোমা ও গোলা চাইছে, যা এক সনাতন যুদ্ধাস্ত্র।
দিনশেষে সেনা, রণসরঞ্জামের মোতায়েন ও ব্যবস্থাপনাকে বদলে দিতে পারে প্রযুক্তি। গত ৩০ জুন যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফ অব স্টাফসের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি পূর্বাভাস দেন যে, আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে পৃথিবীর অগ্রসর সামরিক বাহিনীগুলোর অন্তত এক-তৃতীয়াংশ হবে 'রোবোটিক'।
অর্থাৎ, বিপুল হারে বাড়বে চালকহীন বিমান ও ট্যাংকের সংখ্যা। তবে ভবিষ্যতের যুদ্ধ প্রস্তুতির পাশাপাশি চলতি দশকেও লড়তে হবে সেনাবাহিনীগুলোকে। তাই প্রচলিত অস্ত্রের নিঃশেষিত ভান্ডারকেও পূরণ করতে হবে। গোলাবারুদ ও যুদ্ধ উপকরণ যাতে বিপুল হারে উৎপাদন অব্যাহত রাখা যায়, সেজন্য আরও বৃহৎ পরিসরে উপযুক্ত শিল্প-সক্ষমতাও গড়ে তুলতে হবে। লোকবলের বাড়তি রিজার্ভও রাখতে হবে।
পশ্চিমা দেশগুলো এসব লক্ষ্যপূরণে নিজেদের সামরিক জোটকে কতোটা কাজে লাগাতে পারবে — আগামী ১১ ও ১২ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য ন্যাটো সম্মেলনে তারই পরীক্ষা হবে।
ইউক্রেনের তৃতীয় শিক্ষাটি হলো বৃহৎ যুদ্ধ বিস্তৃত হয় এবং ঘোলাটে রূপ নেয় — বিংশ শতকের বেশিরভাগ সংঘাতের ক্ষেত্রেও যা প্রযোজ্য ছিল। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে তুলনামূলক ছোট অথচ পেশাদার সেনাবাহিনী নিয়ে লড়েছে পশ্চিমারা, এতে তাদের নিজ দেশের স্থানীয় জনগণের ওপর সামান্যই চাপ পড়েছে (যদিও যুদ্ধাঞ্চলের স্থানীয় মানুষের ওপর চরম দুর্ভোগ নেমে আসে)।
কিন্তু ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকরা চলমান যুদ্ধের শিকারে পরিণত হয়েছে। এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে নয় হাজারের বেশি মানুষ। বেসামরিক নাগরিকদের যুদ্ধে যোগ দিতে বা যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সহায়তা দিতেও উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। তারা স্মার্টফোন অ্যাপের মাধ্যমে রুশ বাহিনীর অবস্থান ইউক্রেনীয় কমান্ডকে জানাতে পারছে। চিরাচরিত প্রতিরক্ষা শিল্পের বাইরেও অন্যান্য ধরনের বেসরকারি কোম্পানির সম্পৃক্ততাও যে অপরিহার্য, সেই শিক্ষাও দিচ্ছে কৃষ্ণসাগর পাড়ের রণভূমি।
যেমন ইউক্রেনের ব্যাটেল ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার বিশ্বের অন্যান্য দেশে অবস্থিত ক্লাউড সার্ভার থেকে হোস্ট করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে টার্গেটিং ডেটা সরবরাহ করছে ফিনল্যান্ডের কোম্পানিগুলো। আর আমেরিকান কোম্পানিগুলো দিচ্ছে স্যাটেলাইট যোগাযোগের সুবিধা। নানান মাত্রায় ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মিত্রদের নেটওয়ার্ক ইউক্রেনকে বিভিন্ন প্রকার সহায়তা দানের পাশাপাশি রাশিয়ার ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রাখতে ভূমিকা রাখছে।
কিন্তু, যুদ্ধের সীমারেখা এভাবে অস্পষ্ট হয়ে পড়া নতুন সমস্যারও জন্ম দিচ্ছে। বেসামরিক নাগরিকদের এভাবে যুদ্ধে জড়িত হওয়া আইনি ও নৈতিক প্রশ্নেরও উদ্রেক করে। যুদ্ধাঞ্চলের বাইরে থাকা বেসামরিক কোম্পানিগুলো সাইবার হামলারও শিকার হতে পারে। যুদ্ধকাজে নতুন নতুন সংস্থা জড়িত হওয়ায় কোনো কোম্পানি যেন ব্যর্থ না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে কোম্পানিটি যে দেশে অবস্থিত — ওই দেশেরই সরকারকে।
দুটি যুদ্ধের মধ্যে মিল থাকতে পারে, কিন্তু মনে রাখা দরকার তারা পুরোপুরি একই নয়। ভবিষ্যতে পৃথিবীর ছাদে (হিমালয় অঞ্চলে) যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে ভারত ও চীনকে। অন্যদিকে, তাইওয়ানকে ঘিরে চীন-আমেরিকার যুদ্ধে বিমান ও নৌশক্তি, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও বাণিজ্যিক বিচ্ছিন্নতার বৈশিষ্ট্যই বেশি প্রবল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়া ও রাশিয়া – উভয়েরই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি – ইউক্রেনে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের ঝুঁকিকে আপাতত সীমিতই রেখেছে।
তাছাড়া, ন্যাটো সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ-ঘোষণা করেনি, এবং মস্কোর হুমকিও এ পর্যন্ত অসার বলেই প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু, তাইওয়ানকে ঘিরে যুদ্ধ শুরু হলে চীন ও আমেরিকা একে অন্যকে মহাকাশে আক্রমণ করতে প্ররোচিত হবে, যা পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগে রূপ নিতে পারে। বিশেষত, পারমাণবিক হামলার আগাম সতর্কতাদানকারী (আর্লি-ওয়ার্নিং) এবং কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল স্যাটেলাইটগুলো যদি এ ধরনের হামলায় ধবংস হয়, তাহলেই রয়েছে এই বিপদের সমূহ সম্ভাবনা।