আমেরিকা ও চীন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য কেন লড়ছে
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে – জমে উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর পরাশক্তিগুলোর মনোযোগ না পাওয়া দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোয় – এখন উভয় দেশই প্রভাব বাড়াতে চাইছে।
এই প্রতিযোগিতা বাড়তে থাকে ২০২২ সালে, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ বেইজিংয়ের সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তি সই করার পর। এটি ছিল, অঞ্চলটিতে নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রথম কোন চুক্তি। এতে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মনে প্রতিবেশী দেশে চীনের সম্ভাব্য সামরিক ঘাঁটি নিয়ে ভয় বাড়তে থাকে।
এরপর এই অঞ্চলে কূটনৈতিক তৎপরতা এবং জলাবায়ু পরিবর্তনসহ নানান বিষয়ে সহায়তা ও সহযোগিতা বাড়তে থাকে। নতুন নতুন দূতাবাসও খোলা শুরু হয়।
কোন দেশগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে?
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় ১৪টি দ্বীপরাষ্ট্র আছে। এর মধ্যে কেবল পাপুয়া নিউগিনির জনসংখ্যা দশ লাখের বেশি।
সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ছাড়া, ভানুয়াতু, সামোয়া এবং কিরিবাতির সম্মিলিত মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য– ভার্মন্টের জিডিপিই এগুলোর সমান।
কিছু দ্বীপ রাষ্ট্র তাদের পররাষ্ট্রনীতিকে 'সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়' বলে উল্লেখ করলেও, যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে তাদের মিত্র অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সাথে চীনের প্রভাব ঠেকাতে কাজ করছে।
চীন কেন সম্পৃক্ত হতে চাইছে?
বিশ্বমঞ্চে নিজেকে আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করতে, এই অঞ্চলে মনোযোগ দিয়েছে চীন। ২০২২ সালে দেশটির তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এই অঞ্চলে বিরল এক সফর করেন। ফিজিতে তিনি চীন-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের একটি মন্ত্রী-পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেন। ২০২৩ সালে চীন এই অঞ্চলের জন্য বিশেষ দূত নিয়োগ দেয়। অন্যান্য উদীয়মান বাজারের মতো, প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোতেও অন্যতম বড় ঋণদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বেইজিং।
চীন সরকারের তথ্যমতে, এই অঞ্চলের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য ৫৩০ কোটি মার্কিন ডলারের উন্নীত হয়েছে। ১৯৯২ সালে বাণিজ্য ছিল মাত্র ১৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
চীনের এমন উদ্যোগ জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থায় – উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিজের পাশে পেতে তাদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরির প্রচেষ্টার অংশ। কারণ জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র সহজেই তার ইউরোপীয়, পূর্ব এশিয়া ও অন্যান্য মিত্রদের সমর্থনের উপর নির্ভর করতে পারে।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সম্পর্ক বৃদ্ধি তাইওয়ানকে বিচ্ছিন্ন করতেও, সহায়তা করছে চীন সরকারকে। ২০১৯ সালে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ও কিরিবাতির তাইওয়ানের কূটনৈতিক স্বীকৃতি বাতিল করা ছিল চীনের জন্য বড় এক কূটনৈতিক জয়।
পশ্চিমারা চিন্তিত কেন?
পশ্চিমা দেশগুলো চায় না, কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকা দ্বীপগুলো চীনের বলয়ে আসুক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াইগুলোর মধ্যে একটি – সলোমন দ্বীপপুঞ্জের গুয়াডালকানালে সংঘটিত হয়েছিল। জাপানের দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হওয়া বন্ধ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অভিযানের অংশ ছিল এই যুদ্ধ।
বর্তমানে, এসব দ্বীপে শত্রুপক্ষের সামরিক উপস্থিতি অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের নৌবাণিজ্য পথকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের অংশ- গুয়াম ও হাওয়াই-ও অরক্ষিত হয়ে উঠতে পারে। এই অঞ্চল যুক্তরাষ্ট্রের 'আইল্যান্ড চেইন' নিরাপত্তা কৌশলের অংশ। এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার প্রতিরক্ষা রেখা হিসেবে দেখা হয় দ্বীপগুলোকে।
এই প্রেক্ষাপটে অতীতের সফরকালে চীনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং সব ধরনের সমালোচনা প্রত্যাখান করে বলেন, 'আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো কোনও দেশের পিছনের উঠোন নয়, যাকে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ব্যবহার করা হবে।'
সলোমনে কি ঘটছে?
চীনা কূটনীতিকরা কয়েক বছর ধরে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের প্রধানমন্ত্রী মানসেহ সোগাভারেকে প্ররোচিত করে আসছেন। তবুও ২০২২ সালে দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা চুক্তির খসড়া ফাঁস হয়ে যায়। এরপর অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি নিয়ে নজরদারি শুরু করে।
এসময় প্রধানমন্ত্রী সোগাভারে জোর দিয়ে বলেন, চীনকে একটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হবে না। তিনি চুক্তির সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেন, সলোমন দ্বীপবাসীদের সঙ্গে হাতে বন্দুক থাকা শিশুর মতো আচরণ করা হচ্ছে।
তবে খসড়ায় চীনা নৌবাহিনীকে একটি নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি উপস্থিত ছিল। চীন জানায়, খসড়ার একমাস পর চূড়ান্ত চুক্তিতে সই করা হয়েছে। তবে সে চুক্তির বিষয়বস্তু এখনো জনসম্মুখে আসেনি। পাশাপাশি ২০২২ সালে চীন এবং সলোমন দ্বীপপুঞ্জ নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীর করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে।
গত বছরের আগস্টে মার্কিন কোস্ট গার্ডের একটি জাহাজ সলোমন দ্বীপপুঞ্জে জ্বালানি নেওয়ার জন্য থামতে চাইলেও কর্তৃপক্ষ থেকে কোন সাড়া পায়নি। কারণ কিছুদিন আগেই বিদেশি জাহাজ ভেড়ানোর ক্ষেত্রে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছিল।
জাতিসংঘে এক বক্তৃতায় সোগাভারে বলেন, তার দেশ কোন একক পক্ষকে বেছে নিতে বাধ্য হবে না। আর এ বছর বেইজিংয়ে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের নতুন দূতাবাস খোলার পরিপ্রেক্ষিতে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং 'পারস্পরিক সহায়তা জোরদার করার' প্রতিশ্রুতি দেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে?
এই অঞ্চলের সঙ্গে চলমান উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক মেরামতে ব্যাপক তৎপরতা দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার তরফ থেকে। চলতি বছরের মে মাসে পাপুয়া নিউগিনি সফর করার কথা ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। তবে ওয়াশিংটনে জরুরি কাজ থাকায় তিনি আসতে পারেননি। তবে 'অন্যভাবে যুক্ত' হওয়ার উপায় বের করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
গতবছর বাইডেন নতুন পদ সৃষ্টি করে জোসেফ ইউনকে মাইক্রোনেশিয়া, পালাউ এবং মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দেন। প্রথমবারের মতো হোয়াইট হাউসের শীর্ষ সম্মেলনে বাইডেন এক ডজনেরও বেশি আঞ্চলিক নেতাকে আমন্ত্রণ জানান। যেখানে বৈশ্বিক উষ্ণয়ন মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতিসহ একটি চুক্তি সই হয়।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জন্য হুমকি তৈরি করছে। তারপরও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন – জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে সেভাবে অগ্রাধিকার না দেওয়ায় – প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোর নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন, এবং মরিসনের উত্তরসূরি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবেনিজ কার্বন নিঃসরণ কমাতে নতুন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। হোয়াইট হাউসের চুক্তিতে উন্নয়ন ও নিরাপত্তার পাশাপাশি নতুন মার্কিন দূতাবাস খোলার প্রতিশ্রুতিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সলোমনে নতুন দূতাবাস খোলা হয়েছে।
ফিজিতে চীনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-ও একই ধরনের একটি চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। তবে তা ভেস্তে যায়। আঞ্চলিক কর্মকর্তারা বলছেন, সম্ভাব্য চুক্তিটি ভেস্তে যাওয়ার অন্যতম কারণ- বেইজিংয়ের তাড়াহুড়ো।