জি-২০ নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রে দেশের নাম 'ইন্ডিয়া'র পরিবর্তে 'ভারত'
ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিতব্য জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষে বিদেশি অতিথিদের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রে দেশের নাম 'ইন্ডিয়া'র পরিবর্তে সংস্কৃত শব্দ 'ভারত' লিখেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার। শুধু তাই নয়, ২০তম আসিয়ান-ইন্ডিয়া সম্মেলনে এবং ১৮তম পূর্ব এশিয়া সম্মেলনে যোগ দিতে বুধবার এবং বৃহস্পতিবার ইন্দোনেশিয়া যাবেন নরেন্দ্র মোদি; সেখানেও সরকারি নথিতে তাকে 'প্রাইম মিনিস্টার অব ভারত' বলে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।
আগামী ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জি-২০ সম্মেলন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁসহ আরও অনেক বিশ্বনেতা এই সম্মেলনে যোগ দেবেন।
সম্মেলন উপলক্ষে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু বিদেশি অতিথিদের সম্মানে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর এক নৈশভোজের আয়োজন করেছেন। কিন্তু আমন্ত্রণপত্রের ছবি প্রকাশিত হওয়ার পরেই আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের নাম পরিবর্তন করা হবে কিনা, তা নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে উঠেছে।
১.৪ বিলিয়নের বেশি জনসংখ্যার দেশ ভারত সরকারিভাবে দুটি নামেই পরিচিত- ইন্ডিয়া এবং ভারত। তবে 'ইন্ডিয়া' নামটিই দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিকভাবে বেশি ব্যবহৃত হয়। দেশটির আরও একটি নাম হলো 'হিন্দুস্তান', যা সাহিত্যে এবং পপ-সংস্কৃতিতে দেখা যায়।
'ভারত' একটি প্রাচীন সংস্কৃত শব্দ। এটি 'ইন্ডিয়া'র হিন্দি পরিভাষা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল, ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কর্মকর্তারা দেশের নাম পরিবর্তনকে সমর্থন করেছেন। তাদের যুক্তি এই যে- 'ইন্ডিয়া' নামটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা প্রবর্তন করেছিলেন এবং এটি একটি 'দাসত্বের প্রতীক'। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভের আগ পর্যন্ত ব্রিটিশরা প্রায় ২০০ বছর ভারত শাসন করেছিল।
দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের মোগল ও ঔপনিবেশিক অতীতের সঙ্গে সম্পর্কিত সকল নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করছে বিজেপি। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত থেকে সরে এসে বিজেপি সরকার একটি জাতিগত হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা নিয়ে এগোচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
মোদির দলের নেতাদের প্রতিবাদের পর ২০১৫ সালে নয়াদিল্লির বিখ্যাত আওরঙ্গজেব রোডের নাম বদলে ড. এপিজে আব্দুল কালাম রোড রাখা হয়।
নয়াদিল্লির কেন্দ্রে অবস্থিত, ঔপনিবেশিক আমলের একটি এভিনিউ যা আনুষ্ঠানিক সামরিক কুচকাওয়াজের জন্য ব্যবহৃত হতো, গতবছর সেটিরও নতুন নামকরণ করে সরকার।
মোদি সরকারের ভাষ্যমতে, ভারতের হিন্দু অতীতকে পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা হিসেবে নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে।
এদিকে জি-২০ সম্মেলনের নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রের ছবি এক্স-এ(প্রাক্তন নাম টুইটার) শেয়ার করে বিজেপি নেতা ও উত্তরাখন্ডের নির্বাচিত একজন শীর্ষ কর্মকর্তা পুস্কর সিং ধামি লিখেছেন, "দাসত্ববাদী মানসিকতার ওপর আরও একটি চপেটাঘাত।"
তবে ভারতের বিরোধী দলগুলো ইতোমধ্যেই সরকারের এ পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে।
প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা জয়রাম রমেশ এক্স-এ (প্রাক্তন নাম টুইটার) লিখেছেন, "জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ভবন আগামী ৯ সেপ্টেম্বর নৈশভোজের আয়োজন করেছে, যেখানে চিরাচরিত 'প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া'র পরিবর্তে 'প্রেসিডেন্ট অব ভারত' লেখা হয়েছে। সংবিধানের ১ নং আর্টিকেলে বলা হয়েছে: ভারত, অর্থাৎ ইন্ডিয়া একটি ইউনিয়ন অব স্টেটস। কিন্তু এবার এই 'ইউনিয়ন অব স্টেটস' হুমকির মুখে।"
কংগ্রেসের আইনপ্রণেতা শশী থারুর বলেছেন, ভারতীয়দের উচিত "ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত, এমন একটি নাম পরিবর্তনের বদলে দুটি নামই (ইন্ডিয়া ও ভারত) ব্যবহার করা।"
"যদিও সাংবিধানিকভাবে ইন্ডিয়াকে 'ভারত' বলতে কোনো আপত্তি নেই, কারণ দেশের দুটি সরকারিভাবে প্রচলিত নামের মধ্যে 'ভারত' একটি। তবে আমি আশা করি, সরকার এতটাও বোকা নয় যে বহু শতাব্দী ধরে যেই 'ইন্ডিয়া' নামটির গুরুত্বপূর্ণ ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি হয়েছে, সেটিকে পুরোপুরি বাতিল করে দেবে", যোগ করেন তিনি।
এদিকে, বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র সম্বিত পত্র আসিয়ান-ইন্ডিয়া সম্মেলনে এবং পূর্ব এশিয়া সম্মেলনের নোটটি এক্স-এ পোস্ট করার সাথেসাথেই এর সমালোচনা করেন কংগ্রেসের নেতারা।
কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ একই প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করে বলেন, "দেখুন, মোদি সরকার কতটা বিভ্রান্ত! 'প্রাইম মিনিস্টার অব ভারত' যাচ্ছেন ২০তম আসিয়ান-ইন্ডিয়া সম্মেলনে যোগ দিতে। বিরোধীরা একসঙ্গে এসেছে এবং তারা জোটের নাম রেখেছে ইন্ডিয়া। শুধুমাত্র সে কারণেই এখন দেশের নাম পরিবর্তন নিয়ে নাটক করা হচ্ছে।''
অন্যদিকে, বিজেপি প্রেসিডেন্ট জগত প্রকাশ নাড্ডা কংগ্রেস পার্টির কড়া সমালোচনা করে এক্স-এ লিখেছেন, "দেশের সম্মান ও গৌরবের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি বিষয়ে কেন কংগ্রেসের এত আপত্তি? এটা তো পরিষ্কার যে কংগ্রেস দেশকে সম্মান করে না এবং একইসঙ্গে দেশের সংবিধান বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্মান করে না।"
গত জুলাইয়ে দক্ষিণ ভারতের ব্যাঙ্গালোরে কংগ্রেস-সহ দেশের ২৬টি বিরোধী দলের নেতারা মিলে 'ইন্ডিয়া' নামে একটি নতুন জোট ঘোষণা করেছেন। এই 'ইন্ডিয়া'র পূর্ণ রূপ হলো ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স। ২০২৪ সালের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়া ঠেকাতে এবং তার দল বিজেপিকে পরাজিত করতে এই জোট গঠন করেছেন তারা। এরপর থেকেই 'ইন্ডিয়া' বনাম 'ভারত' নিয়ে বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে।
এ ঘটনার পর থেকেই মোদির দলের কোনো কোনো নেতা দেশের নাম 'ইন্ডিয়া'র পরিবর্তে 'ভারত' রাখার দাবি জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার একাধিক ভারতীয় গণমাধ্যম বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, চলতি মাসে সংসদে বিশেষ অধিবেশনে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব দিতে পারে সরকার।
তবে এখন পর্যন্ত আগামী ১৮-২২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশনের এজেন্ডা প্রকাশ করেনি সরকার।