যুক্তরাষ্ট্র-চীনের এআই দ্বৈরথ: চলছে ঘাতক রোবট মোতায়েনের প্রতিযোগিতা!
বিশ্বে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্রমেই পরাশক্তিতে পরিণত হচ্ছে চীন। তারই ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ ঘনিষ্ঠ মিত্র অস্ট্রেলিয়ার নৌ-বাহিনী অত্যাধুনিক সাবমেরিন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন কৌশল দিয়ে আগাচ্ছে।
প্রথম কৌশলটি অনেকটা ব্যয়বহুল ও ধীর গতির। এক্ষেত্রে ১৩ টি পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বিধ্বংসী সাবমেরিন তৈরিতে অস্ট্রেলিয়া গড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি ব্যয় করবে। এক্ষেত্রে শেষ সাবমেরিনের কাজটি শেষ হতে প্রায় ২০৫০ সাল পেরিয়ে যাবে।
দ্বিতীয় কৌশলটি তুলনামূলক সস্তা ও দ্রুত সময়ে। এক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চালিত মানববিহীন স্বয়ংক্রিয় তিনটি সাবমেরিন তৈরি করা হবে; যার নাম দেওয়া হয়েছে ঘোস্ট শার্ক।
দুটি ভিন্ন কৌশলে তৈরির পরিকল্পনা করা ব্যতিক্রমী এই সাবমেরিনগুলোর সক্ষমতা ও ম্যানুফ্যাকচারিং সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন, কোনো ক্রু না থাকা ঘোস্ট শার্ক সাবমেরিন আকারে একটা স্কুল বাসের সমান হবে। অন্যদিকে নিউক্লিয়ার সাবমেরিনটি ১৩২ জন ক্রু নিয়ে আকারে একটি ফুটবল মাঠের সমান হবে। এক্ষেত্রে দুইটি আলাদা ধরণের সাবমেরিন তৈরি, পরিচালনা ও খরচ প্রমাণ করে যে, অস্ত্র, যুদ্ধক্ষেত্র এবং সামরিক শক্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে কীভাবে এআইয়ের অটোমেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। একইসাথে এটি চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান এআই দ্বৈরথকে আরও পরিণত রূপ দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র অস্ট্রেলিয়া নিজেদের প্রথম পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন সাবমেরিনের টহলে আনার কয়েক বছর আগেই সমুদ্রের গভীরে কয়েক ডজন বিধ্বংসী অটোমেটেড সাবমেরিন টহলে আনার সম্ভবনা রয়েছে।
এক্ষেত্রে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কনট্রাক্টর হিসেবে আন্দুরিল নামের একটি কোম্পানি কাজ করে থাকে। ঐ কোম্পানিটিরই অস্ট্রেলিয়ান সাবসিডিয়ারি অংশ অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর জন্য ঘোস্ট শার্ক সাবমেরিন তৈরি করছে।
আন্দুরিনের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেন আরনট বলেন, "ক্রুয়ের প্রয়োজন নেই এমন সাবমেরিনের ডিজাইন, উৎপাদন ও পারফরম্যান্সে বড় ধরণের পরিবর্তন এসেছে। সাবমেরিনের ভেতর মানুষ থাকার ব্যবস্থা করতে গেলে সেটি তৈরিতে বিপুল পরিমাণে অর্থ খরচ ও সিস্টেম ডিজাইনের প্রয়োজন হয়।"
অথচ ভেতরে মানুষের প্রয়োজন নেই এমন সব স্বয়ংক্রিয় সাবমেরিন তৈরি তুলনামূলক সহজ ও কম ব্যয়বহুল। তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সহযোগিতা দেওয়া এই সাবমেরিন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে কোম্পানিটি।
যদিও শেন আরনট নির্দিষ্ট করে জানায়নি যে, পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষ থেকে অর্ডার সাপেক্ষে ঠিক কতটি ঘোস্ট শার্ক সাবমেরিন তৈরি করতে কোম্পানিটি প্রস্তুত রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট পরিমাণে উৎপাদনের জন্য কোম্পানিটি একটি ফ্যাক্টরি তৈরি করছে বলে জানান তিনি।
আন্দুরিনের পক্ষ থেকে রয়টার্সকে বলা হয়, শুধু অস্ট্রেলিয়া নয়; বরং যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশ যুক্তরাজ্য, জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের নানা দেশের জন্যও সাবমেরিনটি তৈরির পরিকল্পনা করছে কোম্পানিটি।
প্রকল্পটি বেশ দ্রুতগতিতে এগোনোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কেননা ইতোমধ্যেই চীন সামরিক ক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবে বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে। গত এপ্রিলে অস্ট্রেলীয় সরকারের ডিফেন্স স্ট্র্যাটেজিক রিভিউতেও এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
এই বিষয়ে শেন আরনট বলেন, "প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য আমাদের হাতে পাঁচ, দশ বছর কিংবা কয়েক দশক সময় নেই। সময় ফুরিয়ে আসছে।"
একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। অপরদিকে চীন এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্যকে রুখতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
এছাড়াও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে প্রযুক্তির অত্যাধুনিক ব্যবহারও দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে এআই ও ঘোস্ট শার্কের মতো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কার্যকরী ব্যবহার দেশগুলোকে আরও বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।
এই বিষয়ে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অস্ট্রেলিয়ান সেনাবাহিনীর মেজর ও যুদ্ধে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মিক রায়ান বলেন, "কৌশলী এই প্রতিযোগিতায় সফটওয়্যার যুদ্ধে জয়লাভ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। এটি আবহাওয়ার পূর্বাভাস, জলবায়ু পরিবর্তন মডেল, অত্যাধুনিক পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা; নতুন অস্ত্র তৈরি ও যুদ্ধক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে নেওয়ার মতো বিষয়গুলি তদারকি করতে পারে।"
মিলিটারি স্ট্র্যাটেজিস্টদের অনেকেই মনে করেন, পারমাণবিক অস্ত্রের মতোই এআই সামরিক শক্তির জন্য এক বিশাল টার্নিং পয়েন্ট হবে। কিন্তু এআই পরিচালিত রোবট নিজে নিজেই বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। এক্ষেত্রে তারা আপাতত এআইয়ের গবেষণা বন্ধ রেখে আগে সামরিক ক্ষেত্রে এআই ব্যবহারের রেগুলেশন তৈরির ওপর জোর প্রদান করেন।
তব শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও চীন-যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষই এমন সব যন্ত্র তৈরি করছে যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে এআইকে কাজে লাগাবে। এক্ষেত্রে সাবমেরিন, যুদ্ধজাহাজ, ফাইটার জেট, অ্যারিয়াল ড্রোন ইত্যাদিতে এআই প্রযুক্তি যুক্ত করা হচ্ছে। এই পদক্ষেপগুলি মানুষের পাশাপাশি লড়াইয়ের জন্য ঘাতক রোবট তৈরির ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে।
মিলিটারি বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের রোবটকে প্রথাগত জাহাজ, বিমান কিংবা স্থলে সৈন্যদের সাথে দলে কাজ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। যার ফলে ইতিমধ্যেই যুদ্ধের পদ্ধতিগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
যেমন, ঘোস্ট শার্ক সমুদ্রের তলদেশে হাজার হাজার মিটার নিচ দিয়ে চলাচল করতে পারবে। এআই তৈরি রোবটগুলো ঠিক এমন সব দক্ষতা দেখাতে পারবে যা প্রথাগত সামরিক যান করতে সক্ষম নয়।
অন্যদিকে শুধু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তৈরি নয়; বরং এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সামরিক ক্ষেত্রে মিলিটারি অফিসাররা নানা তথ্য সম্পর্কে জানতে ও লড়াইয়ের কৌশল নির্ধারণ করতে পারবে। এক্ষেত্রে এআই স্যাটেলাইট, রাডার, অনলাইন ট্র্যাফিক, সিগন্যাল ইনটিলিজেন্স থেকে আগত বিপুল পরিমাণ ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মতো ব্যাপারগুলো জড়িত।
প্রযুক্তিবিদদের মতে, তথ্যের পরিমাণ এত বেড়েছে যে মানুষের পক্ষে এত ডেটা বিশ্লেষণ অসম্ভব। তাই এইসব ডেটা বিশ্লেষণের জন্য প্রশিক্ষিত এআই সিস্টেমের ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে করে যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা আসবে এবং কমান্ডারদের যুদ্ধক্ষেত্রের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে বুঝতে সহায়তা করবে। ফলে সামরিক অভিযানের জন্য বিভিন্ন বিকল্পও কৌশলও নির্ধারণ করা সম্ভব হবে।
এছাড়াও এআইয়ের ফলে যুদ্ধের মাত্রা আরও ব্যক্তিগত পর্যায় পর্যন্ত চলে যেতে পারে। কেননা মেডিক্যাল রেকর্ড, সোশ্যাল মিডিয়া বিহেবিয়র, অনলাইন শপিং পর্যালোচনা থেকে শুরু করে ড্রোন বা অন্যান্য অস্ত্রের নির্ভুল ব্যবহার করতে সাহায্য করবে এআই। এতে করে যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে নেই এমন সব ব্যক্তিকেও 'মাইক্রো-টার্গেটিং' করা সম্ভব। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ সিনিয়র মিলিটারি লিডারদের সফলভাবে টার্গেট করার ঘটনা যেন তারই উদাহরণ।
যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উভয় দেশই এআই-চালিত ড্রোনের পরীক্ষা করেছে। গত বছর মার্কিন সৈন্যদের এই সংক্রান্তও প্রশিক্ষণের ফুটেজও প্রকাশ হয়েছিল। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, ফোর্ট ক্যাম্পবেল, টেনেসিতে ২০২১ সালের শেষের দিকে মার্কিন সৈন্যরা ড্রোন পরীক্ষা করছেন। ফুটেজে দেখা যায়, পরীক্ষা চলাকালীন এক ব্যক্তি ভিডিও গেমের মতো চশমা পড়ে রয়েছেন।
মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি ক্যাথলিন হিক্স গত ২৮ আগস্ট বলেন, "আমেরিকা আগামী দুই বছরের মধ্যে চীনকে পাল্লা দিতে 'কয়েক হাজার' স্বয়ংক্রিয় মানববিহীন সিস্টেম তৈরি করবে। আমরা চীনের পিএলএ ম্যাসকে আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে কাউন্টার দেব। আর এক্ষেত্রে আমাদের সিস্টেমগুলোকে আঘাত করা কিংবা পরাজিত করা কঠিন হবে।"
এমনকি সামান্য এআই ক্ষমতাসম্পন্ন ড্রোনগুলোরও বেশ ভালো প্রভাব রাখছে। কিছু স্বয়ংক্রিয় বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ রিমোট-নিয়ন্ত্রিত ক্ষুদ্র নজরদারি ড্রোন ইতিমধ্যেই ব্যবহার হচ্ছে। এমন একটি উদাহরণ হল পকেট-আকারের ব্ল্যাক হর্নেট ৩; যেটি এখন একাধিক সামরিক বাহিনী ব্যবহার করে থাকে।
হাতের তালুতে এঁটে যাওয়া ড্রোনটি তৈরি করেছে টেলিডাইন নামের একটি কোম্পানি। তাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, মাত্র ৩৩ গ্রামের চেয়েও কম ওজনের ড্রোনটি টানা ২৫ মিনিট কোনো শব্দ ছাড়াই উড়তে পারে। অপারেটরের কাছে হাই-ডেফিনেশনের ভিডিও ও ছবি সরবারাহ করতে পারে। যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা সৈন্যদের রিয়েল টাইম তথ্য সরবারাহের মাধ্যমে আশেপাশের অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সরবারাহ করতে পারে।
আরনট জানান, আন্দুরিল কোম্পানি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও কিয়েভকে অস্ত্র সরবারাহ করছে। তবে অপরদিকে রাশিয়ানরা দ্রুত যুদ্ধে মোতায়েন করা অস্ত্রগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তাই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে অস্ত্র সম্পর্কে নিয়মিত আপডেট নেওয়া হচ্ছে।
যদিও ঠিক কোন ধরণের অস্ত্র সরবারাহ করা হয়েছে, সেই সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রদান করেননি আরনট। তবে গত ফেব্রুয়ারি মাসে আন্দুরিনের পক্ষ থেকে রয়টার্সকে জানানো হয়, বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে যে অস্ত্র সহায়তা করা হয়েছে সেখানে কোম্পানিটির আলটিয়াস ৬০০ মডেলের যুদ্ধাস্ত্র ড্রোনটি ছিল।
ড্রোনটি গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি এবং পুনরুদ্ধারের কাজে ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও এটিকে কামিকাজি ড্রোন হিসাবেও ব্যবহার করা যেতে পারে; যা একটি বিস্ফোরক ওয়ারহেড দিয়ে সজ্জিত ও শত্রুর লক্ষ্যবস্তুতে সফলভাবে আঘাত হানতে পারে।
যুদ্ধের অংশ হিসেবে ইউক্রেন ইতিমধ্যেই রুশ জাহাজে হামলার জন্য বিস্ফোরক ভর্তি ড্রোন সারফেস ক্রাফট ব্যবহার করেছে বলে জানা গেছে। এদিকে রয়টার্সের পক্ষ থেকে তাইওয়ানের ড্রোন প্রোগ্রাম সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে গত জুনে বলা হয় যে, রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে ইউক্রেনের ড্রোন ব্যবহার তাইওয়ান 'অনেক অনুপ্রেরণা' যুগিয়েছে।
চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিন মিত্ররা প্রত্যেকেই মানবচালিত এয়ারক্রাফটের সাথে ফ্লিট আকারে উড়তে পারে এমন সব গুপ্ত স্বয়ংক্রিয় ড্রোন তৈরির চেষ্টা করছে। এই ড্রোনগুলি লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ করা ও যোগাযোগ জ্যাম করতে পারবে। এছাড়াও সামনে এগিয়ে যেয়ে এয়ারক্রাফটকে রাডার এবং অন্যান্য সেন্সর সম্পর্কে প্রাথমিক সতর্কতা প্রদান করতে পারবে। মূলত রোবটের ন্যায় কাজ করে এই ড্রোনগুলো মানব চালিত এয়ার ক্রাফটের সাথে পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তথ্য সরবারাহ করবে।
গত মার্চে কলরাডোতে আয়োজিত ওয়্যারফেয়ার কনফারেন্সে মার্কিন বিমান বাহিনীর সেক্রেটারি ফ্রাঙ্ক কেনডাল বলেন, রোবোটিক ফাইটার ড্রোনের শক্তিশালী ফ্লিট তৈরির পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে গত নভেম্বরে জুহাই এয়ার শো এ চীন জেট ফাইটার সদৃশ এফএইচ-৯৭এ মডেলের একটি ড্রোন প্রদর্শন করেছে।
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, ড্রোনটি মানবচালিত যুদ্ধ বিমানের পাশাপাশি স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকবে এবং সার্বিকভাবে তথ্য ও বুদ্ধিমত্তা প্রদান করবে। অন্যদিকে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পক্ষ থেকে প্রত্যেকেই অস্ট্রেলিয়ার ঘোস্ট শার্কের মতো মানববিহীন সাবমেরিন তৈরি কাজ করছে।
স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধযানের সুবিধা এই যে, এটিকে বেশ বড় সংখ্যায় যুদ্ধে মোতায়েন করা যায়। এক্ষেত্রে সৈন্যদের কিংবা চালকদের জীবনের ঝুঁকি থাকে না। তবে তাই বলে ইতিবাচক ফলাফল যে কম আসছে এমনটাও নয়। বরং অনেক সময় আরও ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
একইসাথে যুদ্ধে রোবটের সুবিধা হচ্ছে, এটি মানুষের মতো ক্লান্ত হয়ে যায় না। বরং যতক্ষণ পর্যন্ত জ্বালানি থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত টানা লড়াই করে যেতে পারবে।
এছাড়াও মানববিহীন ড্রোনগুলো তৈরি করা অপেক্ষাকৃত সস্তা। এই অত্যাধুনিক ড্রোনগুলো তৈরি করতে মাত্র কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। আর বিপরীতে মানবচালিত ড্রোনগুলো তৈরি করতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়।
পশ্চিমা সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি রোবট স্কাউট যান প্রতিপক্ষের অবস্থান ও গতিবিধি শনাক্ত করা এবং প্রতিবন্ধকতার হাই-ডেফিনেশন ইমেজ ফেরত পাঠাতে পারে। এমনকি যদি এটি পরবর্তীতে ধ্বংস হয়ে যায়, তবুও পূর্বে ধারণ করা ডেটাগুলো উদ্ধার করা যায়।
এখন পর্যন্ত এটা বলা মুশকিল যে, এআই চালিত অস্ত্র তৈরির দিক থেকে ঠিক কোন দেশ এগিয়ে আছে। চীনের বিশাল উৎপাদন খাত ও লোকবল প্রযুক্তিটি ঘিরে ব্যাপকভাবে অস্ত্র উৎপাদনের সুবিধা দিতে পারবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ও সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো। তবে উভয় পক্ষই এই সংক্রান্তও প্রকল্পগুলো ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই বেশ গোপনীয়তা অবলম্বন করে।
প্রতিরক্ষায় ঠিক কত ব্যয় করা হয় সেটি চীনের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা হয় না। ঠিক তেমনিভাবে সামরিক খাতে এআই গবেষণার জন্য দেশটি ঠিক কী পরিমাণ খরচ করছে, সেটি সম্পর্কেও জানা যায়নি। তবে যতটুকু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে দেখা যায় চীন ২০১০ এর দশকে প্রতিনিয়ত সামরিক খাতে এআই ও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তিতে ব্যয়ে গুরুত্ব দিয়েছে।
চীনের ইন্ডাস্ট্রি ও টেকনোলজি নিয়ে বিশ্লেষণ করা নেদারল্যান্ডসভিত্তিক প্রাইভেট রিসার্চ কোম্পানি ডাটেনার তথ্যমতে, চীনা সরকার দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০১১ সালে ৩.১ মিলিয়ন ডলার এআইয়ে ও ৮.৫ মিলিয়ন ডলার মেশিন লার্নিংয়ের গবেষণায় খরচ করেছে। ২০১৯ সালে আবার দেশটির এআই খাতে গবেষণা খরচ বেড়ে দাড়ায় ৮৬ মিলিয়নে; আর মেশিন লার্নিং গবেষণায় খরচ বেড়ে দাড়ায় ৫৫ মিলিয়নে।
এ সম্পর্কে মার্কিন সেন্ট্রাল ইনটিলিজেন্স এজেন্সির সাবেক বিশ্লেষক ও ডেটেনার ম্যানেজিং ডিরেক্টর মার্টিজন রাসার বলেন, "সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আমরা ঠিক জানি না যে, চীন সামরিক ক্ষেত্রে এআইয়ের ব্যবহারে ঠিক কতটা ভালো করছে। তবে এটা নিশ্চিত যে, দেশটি ওয়ার্ল্ড ক্লাস গবেষণা করছে। কিন্তু দেশটির পিএলএ এবং পিএলএ এফিলিয়েটেড রিসার্চ প্রতিষ্ঠানগুলো নির্দিষ্ট করে কী করছে সেটা বোঝা মুশকিল।"
এদিকে চীনের সাথে প্রযুক্তি প্রতিযোগিতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেশ উদ্বিগ্ন। তারই ফলশ্রুতিতে গত মাসে বাইডেন প্রশাসন একটি নির্বাহী আদেশে চীনে সংবেদনশীল প্রযুক্তির কিছু খাতে মার্কিন বিনিয়োগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কেননা এর ফলে চীনের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সম্ভবনা রয়েছে।
অস্ত্র তৈরির কোম্পানি আন্দুরিল প্রতিষ্ঠা করেন ভিআর-হেডসেটের পথিকৃৎ পামার লাকি। ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক কোম্পানিটির যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মোট ১৮ হাজার কর্মী রয়েছে।
আন্দুরিল মূলত অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কাজ লাভের চেষ্টা করছে। তারই ফলশ্রুতিতে গত বছর কোম্পানিটি মার্কিন স্পেশাল অপারেশন কমান্ডকে কাউন্টার ড্রোন সিস্টেম সরবারাহের জন্য ১ বিলিয়নের ডলারের চুক্তি করেছে। একইসাথে মার্কিন মিত্র যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে বেইজ ডিফেন্স সিস্টেম সংক্রান্ত একটি চুক্তি করেছে।
এদিকে ঘোস্ট শার্কের সক্ষমতা ঠিক কতটুকু হবে, সেই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি আরনট। সাবমেরিনটি সিডনির হারবারে অস্ট্রেলিয়ান নৌ-বাহিনী ও প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীদের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কোম্পানিটি তৈরি করবে।
তবে আন্দুরিলের কাছে থাকা তিন টন ওজনের ডাইভ-এলডি নামের মানববিহীন একটি স্বয়ংক্রিয় সাবমেরিন রয়েছে। সেটি থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে, এআই চালিত এই সাবমেরিনগুলো কতটা দক্ষতাসম্পন্ন হতে পারে।
ডাইভ-এলডি সাবমেরিন ৬ হাজার মিটার গভীরে পর্যন্ত যেতে পারে এবং সেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ১০ দিন পর্যন্ত কাজ করতে পারে। যেদিকে নেভাল বিশ্লেষকদের ধারণা মতে, মানবচালিত সাবমেরিন মাত্র ৩০০ থেকে ৯০০ মিটার গভীরে যেতে পারে। ফলে মানবচালিত সাবমেরিনের তুলনায় স্বয়ংক্রিয় সাবমেরিনের অবস্থান নির্ণয় ও আক্রমণ বেশ কঠিন।
অভিজ্ঞ নেভী অফিসারদের মতে, ঘোস্ট শার্কের মতো কয়েক ডজন স্বয়ংক্রিয় সাবমেরিন টর্পেডো, ক্ষেপণাস্ত্র এবং মাইনসহ প্রতিপক্ষের উপকূলে লুকিয়ে থাকতে পারবে কিংবা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলপথ বা চেকপয়েন্টে অবস্থান নিতে পারবে। এগুলোকে এআই-চালিত অপারেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে এমন লক্ষ্যে আঘাত করতে পারবে।
অস্ট্রেলিয়ার পারমাণবিক নৌবহর অবশ্য বর্তমানের স্বয়ংকৃত সাবমেরিনের চেয়ে আরও শক্তিশালী হবে। কিন্তু, এগুলো বাস্তবায়িত হতে আরও বহু সময় লাগবে।
প্রজেক্টের প্রথম অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ক্যানবেরাকে মোট পাঁচটি ভার্জিনিয়া-ক্লাস সাবমেরিন উপহার দেবে। তবে এগুলোর প্রথমটি বহরের যুক্ত হতেই পরবর্তী দশকের শুরু পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। আর অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ডিফেন্স টেকনোলজি কলাবরেশনের অংশ হিসেবে ২০৪০ এর দশকের শুরু থেকে আরও আটটি নতুন ধরণের সাবমেরিন তৈরির কাজ শুরু করা হবে।
মিলিটারী স্ট্রাটেজিস্টদের মতে, এই সময়ের মধ্যে নৌ-বহরটি একটি কার্যকরী ফোর্স হিসেবে উপনীত হব। সেখানে বিধ্বংসী রোবট মূলত সৈন্য ও প্রথাগত যানের সাথে সমন্বয় করে কাজ করবে। ফলে যুদ্ধের ধরনেও পরিবর্তন আসবে।"