রুপার্ট মারডক যেভাবে অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যম বদলে দিয়েছেন
রুপার্ট মারডক যখন তার কর্মজীবন শুরু করেন, তখন তিনি তরুণ, সাফল্যের জন্য ক্ষুধার্ত এবং অস্ট্রেলিয়ার সংবাদ ব্যবসায় তার পরিবারের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য মরিয়া ছিলেন।
উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার কাছ থেকে অ্যাডিলেডের একটা পত্রিকা পেয়েছিলেন মারডক। 'দ্য বয় পাবলিশার' হিসেবে খ্যাতি পাওয়া মারডক এই পত্রিকাকেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে রূপান্তরের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
এই ৯২ বছর বয়সী এখন আন্তর্জাতিকভাবে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে সফল ব্যবসায়ী। সাফল্য ক্ষুধা তাকে এখান পর্যন্ত নিয়ে এসেছে বলে মনে করেন অনেকে। তার উত্থানের গল্পই তুলে ধরেছে বিবিসি।
২০১১ সালের এক প্রবন্ধে নিউজ কর্পোরেশনের হয়ে কাজ করা অধ্যাপক রবার্ট ম্যানে লেখেন, অর্থের আকাঙক্ষা ও ক্ষমতার তৃষ্ণা- মারডক বিভিন্ন পন্থা ব্যবহার করে এই দুটি বিষয়কে একসূত্রে গাঁথতে তার প্রতিভা কাজে লাগিয়েছেন।
কিন্তু রুপার্ট মারডকের ৭০ বছরের পেশাজীবন শেষ হওয়ার সাথে সাথে তার উত্তরাধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যম পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কেন্দ্রীভূত। যেখানে মুদ্রন সংবাদমাধ্যমের ৬০ শতাংশের অংশীদার নিউজ কর্পোরেশন। তবে নানা কারণে প্রতিনিয়ত সমালোচনার সম্মুখিন হতে হয়েছে নিউজ কর্পোরেশনকে।
দেশের গণতন্ত্রে মারডকের প্রভাব এবং 'বিদ্বেষমূলক' প্রতিবেদন থেকে তার সংবাদমাধ্যমের করা আয় নিয়ে সর্বোচ্চ তদন্তের দাবিও করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী।
সিডনি ইউনিভার্সিটির গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক টিম ডোয়ায়ার বলেন, সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, ডানপন্থী সংবাদ সংস্কৃতি এবং গণমাধ্যমের মালিকানার উপর তার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবই গুরুত্বপূর্ণ। ৯২ বছর বয়সে মারডকের সাথে কি ঘটছে তা মুখ্য নয়।
'দ্য বয় পাবলিশার'
সংবাদপত্র ব্যবসা রুপার্ট মারডকের রক্তে মিশে আছে। তার বাবা স্যার কিথ মারডক ছিলেন একজন খ্যাতিমান প্রতিবেদক এবং অস্ট্রেলিয়ান জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
১৯৩০ এর দশকের শেষের দিকে তিনি কয়েকটি সংবাদপত্র এবং রেডিও স্টেশনের মালিকানা কেনেন এবং নিজেকে রাজনৈতিক অধিকারের শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
কিন্তু ১৯৫২ সালের স্যার কিথের মৃত্যুর পর ঋণের কারণে পারিবারিক ব্যবসার বৃহদাংশই বিক্রি করতে হয়েছিল। বাকি ছিল কেবল অ্যাডিলেড নিউজ, যার পাঠক সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৫ হাজার।
রুপার্ট মারডক যখন এই সংবাদপত্রের দায়িত্ব নেন, তখন প্রতিযোগীদের থেকে এগিয়ে থাকতে তিনি বড় শিরোনাম এবং চটকদার প্রতিবেদন প্রকাশ করতেন।
তিনি ব্যক্তিগতভাবে পৃষ্ঠসজ্জাও করতেন কখনো কখনো। সেই সাথে সম্পাদকদেরকে প্রচুর স্বাধীনতা দেওয়ার দাবিও করেন মারডক।
ট্যাবলয়েডটির এই কৌশল কাজে লাগে। ১৯৬৪ সালের অস্ট্রেলিয়ার প্রতিটি রাজ্যে সংবাদপত্রের মালিক বনে যান রুপার্ট মারডক। এসময় ব্রডশিট আকারের দেশের প্রথম জাতীয় পত্রিকা- দ্য অস্ট্রেলিয়ান- প্রকাশের প্রক্রিয়াও চলছিল। যুক্তরাজ্যের বাজারেও প্রবেশের পরিকল্পনা ছিল রুপার্টে। তার বাবাও একই পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
১৯৯৬ সালে 'স্কাই নিউজ অস্ট্রলিয়া' চালুর মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টার টিভি সাংবাদিকতার জগতে প্রবেশ করে নিউজ কর্পোরেশন।
তবে চ্যানেলটি প্রায়শই মেরুকরণ ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের জন্য সমালোচিত হয়েছে। জলবায়ু বিজ্ঞানের বৈধতার মতো বিষয়ে বিতর্ক তুলেছে প্রচারমাধ্যমটি। আদিবাসী স্বীকৃতির উপর আসন্ন গণভোট নিয়ে বলা হয়েছে, 'এটি একটি বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে।'
অধ্যাপক ডোয়ারার বলেন, এটি এমন একটি ব্র্যান্ড যা ডানপন্থী মতামতযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে, স্থানীয়রাও বিষয়টিতে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে।
'পলিটিকাল কিংমেকার'
১৯৬৭ সালে নিজের প্রথম টিভি সাক্ষাৎকারে রুপার্ট মারডককে প্রশ্ন করা হয়, সংবাদপত্রের সাম্রাজ্য তার কাছে যে ক্ষমতা নিয়ে এসেছে সেটিকে তিনি পছন্দ করেন কিনা। তখন মারডকের উত্তর ছিল, 'এই প্রশ্নের একটিই সৎ উত্তর আছে। আর সেটি হলো, হ্যাঁ।'
একবিংশ শতাব্দির সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে তার গভীর সম্পর্ক আছে।
২০২১ সালে মিডিয়া বৈচিত্র্যের বিষয়ে একটি সিনেট তদন্তে সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুড বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও আমি মারডকের মিডিয়া 'জন্তুকে' ভয় করতাম।
তিনি আরো বলেন, মারডককে নিয়ে কারও ভয় পাওয়া উচিত নয়, তবে বলতেই হয়, তার হাতে থাকা ক্ষমতার কারণে তিনি ভয় পাওয়ার মতো একজন মানুষ।
রুডই ২০২০ সালে নিউজ কর্পোরেশনকে 'গনতন্ত্রের জন্য ক্যান্সার' বলে মন্তব্য করে এটির বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ তদন্ত রয়্যাল কমিশনের আহ্বান করেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুলসহ পাঁচ লাখ মানুষ স্বাক্ষর করলেও নিউজ কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়নি। এবং অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ দায়িত্ব নেওয়ার আগে স্পষ্ট করে দেন যে, তিনি এই প্রস্তাব সমর্থন করেন না।
পিটিশন চালু করার পর তিনি মন্তব্য করেন, এটা অনেকটা ফুটি খেলায় (অস্ট্রেলিয়ায় জনপ্রিয় একটি খেলা) রেফারির বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো। এতে আপনি সন্তুষ্ট হতে পারেন, কিন্তু ফলাফল বদলাবে না।
২০২২ সালের নির্বাচনে আলবানিজ ও জলবায়ু-বান্ধব স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিজয়ে অস্ট্রেলিয়ায় নিউজ কর্পোরেশনের প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে কিনা তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
রাজনৈতিক সাংবাদিক ম্যালকম ফার লিখেছেন, নির্বাচনের ফলাফল নিউজ কর্পোরেশন এবং ভোটারদের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার চিত্র তুলে ধরেছে।
কিন্তু অধ্যাপক ডোয়ায়ার বলেন, যদিও ব্র্যান্ডটি হয়তো 'ক্ষতিগ্রস্ত' হয়েছে এবং তরুণ অস্ট্রেলিয়ান দর্শকরা ঐতিহ্যবাহী মিডিয়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তবে রাতারাতি নিউজ কর্পোরেশন তার প্রভাব হারাবে না।
লাচলান মারডকের নিউজ কর্পোরেশনের দায়িত্ব নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়গুলি খুব একটা বদলাবে না। নিউজ কর্পোরেশনের একটি পৃথক সংস্কৃতি আছে, যার হাতেই ক্ষমতা থাকুক না কেন এখানে পরিবর্তন আনা হবে না।