বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পর ইউক্রেনের অর্জন কতটুকু?
ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ চলছে, কিন্তু তা যেন আগের তীব্রতা হারিয়ে ফেলেছে। এ পর্যন্ত দেশটির সেনারা উল্লেখযোগ্যভাবে এগোতে পারেনি, এমনকি কিছু জায়গায় পিছু হটতেও বাধ্য হয়েছে।
ইউক্রেনীয় সেনা হতাহতের বিষয়ে রাশিয়া কিছু সংখ্যা প্রকাশ করেছে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বোর্ড সভায় দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু জানান, চলতি মাসে এ পর্যন্ত ১৭ হাজার ইউক্রেনীয় সেনা নিহত হয়েছে।
তার মতে, কিয়েভ পশ্চিমা-নির্মিত তিনটি ট্যাংক হারিয়েছে, ধবংস হওয়া এসব ট্যাংকের মধ্যে রয়েছে দুটি জার্মান লেপার্ড ও একটি ব্রিটিশ চ্যালেঞ্জার ট্যাংক।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি সাতটি ব্রাডলি সাঁজোয়া যান, ৭৭টি এম-৭৭৭ হাউইটজার এবং জার্মানি, ফ্রান্স, পোল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ৫১টি স্বচালিত হাউইটযান যান ধবংস করেছে রুশ বাহিনী।
রুশরা দাবি করছে, তারা যুক্তরাজ্যের তৈরি একটি স্টোর্মার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ধবংস করেছে। ব্রিটিশ কোম্পানি অ্যালভিস ভিকার্সের (বর্তমানে বিএই সিস্টেমস ল্যান্ড অ্যান্ড আর্মামেন্টস) তৈরি এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা লেজার-গাইডেন্স ব্যবহার করে লক্ষ্যবস্তুর দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে। তুলনামূলক নিচু দিয়ে উড়ে চলা যুদ্ধবিমান, বিশেষত ড্রোন ও হেলিকপ্টার ধবংস করতেই এটি নির্মাণ করা হয়।
এদিকে নির্ধারিত সময়ের আগেই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি আব্রামস এমবিটি (মেইন ব্যাটেল ট্যাংক) ইউক্রেনে পৌঁছেছে। ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা প্রধান কিরিলো বুদানভ বলেছেন, কেবল বিশেষ অভিযানে আব্রামস ট্যাংক ব্যবহার করা হবে। গতানুগতিক লড়াইয়ে এগুলো ব্যবহার করা হবে না, কারণ তাহলে ধ্বংস হবে।
চলতি সপ্তাহে রাশিয়ার ধবংস করা একটি লেপার্ড ট্যাংকে তিনজন জার্মান ক্রু ছিলেন। তাদের মধ্যে দুজন তাৎক্ষনিকভাবেই মারা যান, আর বেঁচে যাওয়া তৃতীয় ক্রু বন্দি হন রুশ সেনাদের হাতে। তিনি একজন মেকানিক বলে রুশ সেনাদের জানিয়েছেন। জার্মান চালকদল কেন ট্যাংকে ছিল, তা এখনও স্পষ্ট নয়। নাকি আগামীতে এরই ধারাবাহিকতা আরও ঘটবে? অর্থাৎ পশ্চিমা সেনারাই চালাবে ইউক্রেনের ট্যাংক বা অন্যান্য সমরাস্ত্র।
ইউক্রেনের কয়েকটি বিমানঘাঁটিতেও হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। এসব হামলায় অন্তত দুটি মিগ-২৯ ফাইটার জেটসহ হ্যাঙ্গারে থাকা আরও বেশকিছু যুদ্ধবিমান ধবংস হয়েছে বলে জানা গেছে।
রাশিয়া ওডেসা বন্দরেও আক্রমণ করেছে, এতে ধবংস হয়েছে শস্য সংরক্ষণের অবকাঠামো এবং লোডিং ডক। ইউক্রেনের সামরিক-বেসামরিক সম্পদের ওপরও আকাশপথে রাশিয়ান হামলা তীব্র হয়েছে।
ইউক্রেন এরমধ্যেই রুশ নৌবাহিনীর কৃষ্ণসাগর নৌবহরের প্রধান অ্যাডমিরাল ভিক্টর সোকোলভ-সহ আরও ৩৪ জনকে এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হত্যার দাবি করেছে। এ কথা সত্যি, তাদের স্ট্রোমশ্যাডো মিসাইল ক্রিমিয়ার সেভেস্তোপলে কৃষ্ণসাগর নৌবহরের সদর দপ্তরে আঘাত করেছিল। কিন্তু, এতে সোকোলভ মারা যাননি বলেই পরে প্রমাণিত হয়।
রুশ কর্তৃপক্ষ সের্গেই শোইগুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকের ভিডিও প্রকাশ করেছে। সভায় সোকোলভকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। সেখানে কৃষ্ণসাগর বহরের আরও কয়েকজন কমান্ডারকেও দেখা গেছে। এতেই ইউক্রেনের দাবির অসারতা প্রকাশ পায়।
তবে এ ভিডিও জাল বলে দাবি করেছে ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু, তারপরও এটাই প্রমাণ হয়েছে যে, অ্যাডমিরাল সোকোলভ-সহ অন্যান্য কমান্ডারদের হত্যার যে দাবি তারা করেছিল, তা ছিল 'অতিরঞ্জিত'। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মিসাইল হামলায় মাত্র একজন নিহত হয়েছে। অবশ্য সদর দপ্তরের ভবনটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কিয়েভকে সহায়তা দেওয়া দাতাদের জন্য একটি সমন্বয়ক প্ল্যাটফর্ম গঠন করেছে পশ্চিমারা। সম্প্রতি ব্রাসেলসে এর একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ইউক্রেনকে যেসব বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করতে হবে, তা নিয়ে দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিবৃতির একটি কপি কিয়েভে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসেও পাঠানো হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে কিয়েভকে মারাত্মক দুর্নীতি মোকাবিলায় বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এরমধ্যে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় থেকে শুরু করে ইউক্রেনের- ইউক্রেনার্জ ও নাফতোগ্যাস-সহ জ্বালানি কোম্পানিগুলোর যথাযথ ব্যবস্থাপনার দিকনির্দেশনা রয়েছে।
চলমান যুদ্ধে গোলা উৎপাদন খুবই গুরুত্ব পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা শিল্পকে দুর্নীতিমুক্ত দেখতে চায়। দেশটির ইউক্রোবোরোনপ্রম ১২৫ মিলিমিটার কামানের গোলা উৎপাদন করে। এই সংস্থার তত্ত্বাবধানে একটি সুপারভাইজরি বোর্ড গঠনের প্রস্তাব করেছে ওয়াশিংটন। বোর্ড সদস্য হিসেবে মার্কিন কর্মকর্তারাও থাকবেন।
এছাড়া, ইউক্রেনের দুর্নীতি দমন ব্যুরো নাবু এবং দুর্নীতিদমন কৌশুলির কার্যালয়কেও তদারকির আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছে ওয়াশিংটন। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে প্রসিকিউটর জেনারেলের দপ্তরের আওতামুক্ত রাখতেও বলেছে।
সংস্কার প্রস্তাবে ইউক্রেনের নিরাপত্তা কাঠামো নিয়েও সরব হয়েছে বাইডেন প্রশাসন। সোভিয়েত আমলের কেজিবির মতোন কাজ করে ইউক্রেনের সিক্রেট সার্ভিস- এসবিইউ। ওয়াশিংটনের প্রস্তাব শুধু কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স, অ্যান্টি-এস্পিওনাজ, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা ও সাইবার সন্ত্রাস মোকাবিলায় এ সংস্থার কর্মকাণ্ড যেন সীমিত রাখা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রস্তাবের ভাষা তেমন সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট নয়। কারণ এসবিইউ-কে বিরোধী মতদমনে ব্যবহার করছেন জেলেনস্কি। তার সরকারের বিরোধিতাকারীদের এ সংস্থা নিয়মিতভাবে গ্রেপ্তার করছে।
এসবিইউ-এর মাধ্যমে অতীতে ইউক্রেনে অবস্থিত রুশ অর্থোডক্স চার্চের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও সদস্যদের ওপর দমনপীড়ন চালানো হয়েছে। এদের মধ্যে কারো কারো বিরুদ্ধে অস্ত্র বিক্রির অভিযোগও আনা হয়। সেনাভর্তি যারা এড়াতে চান, তাদের বিরুদ্ধেও এসবিইউ কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
ফলে ধারণা করা হচ্ছে, ওয়াশিংটন এসব কার্যক্রমে কিছুটা লাগাম টানার উদ্দেশ্যেই এ প্রস্তাব দিয়েছে।
কিন্তু সীমিত আকারের এসব সংস্কারও ইউক্রেন বাস্তবায়ন করবে বলে মনে হয় না। হয়তো এ কারণেই ব্রাসেলসে নিম্ন কূটনৈতিক পর্যায়ে সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে তা-ও ছিল খসড়া প্রস্তাব। ইউক্রেনে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার বিষয়ে বাইডেন প্রশাসন যে গুরুতর চেষ্টা করছে না, এটা তারই ইঙ্গিত।