৬০ যেন নতুন ৪০! যেভাবে মানুষ চিরতরুণ থাকতে চায়
"বছর পাঁচেকের মধ্যে অনুমান করে আর মানুষের বয়স বোঝা যাবে না। আমাদের সবার বয়স তখন হবে ৩৮", কথাগুলো হেয়ার সার্জারিতে দক্ষ স্প্যানিশ চিকিৎসক ডেভিড সামপায়োর।
এই বিশেষজ্ঞের মতে, বয়সের ভেদাভেদ এমনভাবে মিইয়ে আসছে যে আমাদের বয়স অনির্দিষ্টকালের জন্য চল্লিশের কোঠায়ই আটকে থাকবে। 'এইজ গ্রুপ' বলে তখন আর কিছু থাকবেনা। বরং আমরা সবাই বিভিন্ন বয়সের তরুণ হয়ে থাকব।
আসছে ডিসেম্বরে ৬০-এ পা দেবেন হলিউড সুপারস্টার ব্র্যাড পিট। হায়ালুরোনিক অ্যাসিড এবং ভিটামিন সেরামে আসক্ত ডা. ডেভিড সামপায়ো তার সহকর্মীদের সাথে মিলে সম্প্রতি এই অভিনেতার ভিডিও'র চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন।
"বড় একটি স্ক্রিনে ভিডিওটি প্লে করে প্রতিটি সেকেন্ড লক্ষ্য করি আমরা- চিবুক, গালের হাড়, হেয়ারলাইন, চোখের পাতা, ত্বকের ভাঁজ সব খুঁটিয়ে দেখি। কোথাও কোনোপ্রকার আঁচড় আছে কি-না খুঁজতে থাকি…।"
"এটুকু বুঝলাম তার জেনেটিক্স সত্যিই ভালোমানের; এখন পর্যন্ত ছুরির নিচে যান নি এই অভিনেতা। তবে নিশ্চিত বলতে পারি, তিনি গ্রোথ হরমোনের ইনজেকশন নিয়েছেন…কোলাজেন রিজেনারেটর।"
ব্র্যাড পিটের এই কৌশল সম্পর্কে মাদ্রিদের ল' বুস্ট ক্লিনিকের পরিচালক এবং ডার্মাটোলজিস্ট জুয়ানমা রেভেলস মনে করেন, এই অভিনেতা একটি দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করেন যাতে তার মুখমণ্ডলের পরিবর্তনটা আসে ধীরে ধীরে।
"কপাল আর দুই ভ্রুর মাঝে নিউরোমড্যুলেটরস ব্যবহার করা হয়েছে যা বলিরেখা শিথিল করে এবং চোখকে আরাম দেয়; চিবুকে আছে ফিলার যা মুখকে দৃঢ়তা দিয়ে চোয়ালকে নিখুঁত করে তোলে; ত্বককে টানটান আর নাকের পাশের চামড়ার ভাঁজ কমাতে আছে রেডিওফ্রিকুয়েন্সি; পাশাপাশি ত্বকের মসৃণতা আর উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতে অন্যান্য প্রক্রিয়া তো আছেই", জুয়ানমা বলে যেতে থাকেন।
জুয়ানমা রেভেলসের ক্লিনিকে ২০% চিকিৎসা পদ্ধতির গ্রাহক এখন পুরুষ।
এই হার অল্পবয়সীদের মধ্যে বেশি। অন্যদিকে ডা. সামপায়োর অফিসে আসা বেশিরভাগই সেনা সদস্য যাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করতে হয়। নিজেদের ক্রম (সিরিয়াল) আসার জন্য এদের চিকিৎসকের চেম্বারে অধীরভাবে অপেক্ষা করতে দেখা যাবে; শুধু সার্জারিই না, অনেকে আসেন ভিটামিন সি, ম্যাগনেসিয়াম এবং জিঙ্ক সেরামের জন্যও।
ডা. সামপায়ো মূলত চুলের সমস্যা দেখে থাকেন।
"আগে আমাদের নিশ্চিত করতে হতো যেন তারা কেউ কাউকে না দেখে ফেলেন। এখন তারা নিজেরাই দেখা হলে পরস্পরকে অভিবাদন জানান।"
অনুমান করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালে যে সব চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পন্ন হয়েছে তার মধ্যে ১৩ মিলিয়নেরও বেশি নিয়েছেন পুরুষেরা। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতির নাম- 'ম্যাসকিউলিনাইজেশন'।
"এক্ষেত্রে মুখের মধ্যে এবং নীচের তিনভাগের এক ভাগ অংশে (গালের হাড়, চিবুক এবং চোয়াল) ফিলার ইনজেক্ট করা হয় যেন গ্রাহক একটি বর্গাকার, কৌণিক মুখের আকার পান", ব্যাখ্যায় বলেন রেভেলেস।
দ্বিতীয় যে পদ্ধতির গ্রাহক বেশি, তা হলো চুল প্রতিস্থাপন বা হেয়ার গ্রাফট।
আরেকজন ডার্মাটোলজিস্ট হোসে মারিয়া রিকার্ট বলেন, "সার্জিক্যাল ফেস লিফটের আবেদন সবচেয়ে কম পাই আমরা। কাটাছেঁড়াবিহীন পদ্ধতিই মানুষকে টানে বেশি, যেমন আলথেরাপির কথা বলা যায়। এই প্রযুক্তিতে এমন আল্ট্রাসাউন্ড তৈরি হয় যা ত্বকের ৪.৫ মিলিমিটার গভীরে প্রবেশ করে ঘাড়ের পাশের ঝুলে যাওয়া ত্বককে টানটান অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। এই পদ্ধতিটির সাফল্যের হার অনেক বেশি, কারণ এতে একে তো ব্যথা হয় না, আবার অন্যদিকে প্রাকৃতিক; এর প্রভাবও দীর্ঘস্থায়ী।
মুখের 'ভলিউম' আগের অবস্থায় নিয়ে আসতে চান, এমন গ্রাহকও আছে তার, যারা পেশায় দৌড়বিদ।
"মুখের মধ্যে হাড়-চর্বি পুনঃশোষিত হয়। অ্যাথলেটদের ক্ষেত্রে চোখের নিচের অংশ সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল অংশের একটি, আরেকটি হলো মুখের নীচের অংশ। এর কারণ, মুখের এসব জায়গায় ফ্যাট কম্পোনেন্ট ক্ষয়ে যায়।"
এদিকে ডা. সামপায়ো মনে করেন, তিনি নিজেই তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার 'গিনিপিগ'। ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যামিনো অ্যাসিডের অর্থোমোলিকুলার সেরাম থেরাপি তার বেশ পছন্দ।
বেস হিসেবে এতে আরও থাকে, ভিটামিন সি, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, গ্লুটাথিয়ন প্রভৃতি। এরপর তারা প্রয়োজন বুঝে অন্যান্য উপকরণ যোগ করেন।
যেমন ক্লায়েন্টকে জিজ্ঞেস করা হয়, "আপনার কি চুল পড়ছে? আমরা তাহলে বায়োটিন এবং ভিটামিন বি-৫ মেশাব।"
'বায়োলজিক্যাল এইজ' বা নিজের প্রকৃত বয়স কমানোর চূড়ান্ত প্রকল্পগুলো জৈবপ্রযুক্তি উদ্যোক্তারা সরাসরি পরীক্ষা করে দেখেছেন। এদের সবার মধ্যে যা যা মিলে গেছে তা হলো- অর্থের উচ্চ প্রাপ্যতা, প্রযুক্তি নামক 'ঈশ্বরে'র প্রতি অটুট বিশ্বাস আর বুড়িয়ে যাওয়ার ভয় ও মৃত্যুভীতি।
সান ফ্রান্সিসকোর বায়োটেকনোলজি কোম্পানি, অল্টোস ল্যাব গবেষণা করছে সেলুলার রিজুভেনেশন বা কোষের পুনরুজ্জীবন নিয়ে। এই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ বিনিয়োগকারী ৬০ বছর বয়স্ক রবার্ট নিলসেন এপিজেনেটিক রিপ্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে তার কোষগুলোকে 'রিসেট' করার চেষ্টা করছেন। এর আগে ২০০৬ সালে ইঁদুরের ওপর এর ট্রায়াল পরিচালনা করেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারজয়ী জাপানি গবেষক শিনিয়া ইয়ামানাকা।
এতে সফল হওয়ার জন্য রবার্ট নিলসেনকে একটি জটিল রুটিন অনুসরণ করতে হচ্ছে: প্রতিদিন ডজনখানেক পিল খেতে হয় তাকে, যার মধ্যে রয়েছে রেপামাইসিন (পরিচিত অ্যান্টিটিউমার), মেটফরমিন (এ ওষুধ বহু বছর ধরে ডায়াবেটিস রোগীদের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে) এবং টাউরিন (প্রাকৃতিক পুষ্টি উপাদান, যার উৎপাদন বয়সের সাথে সাথে হ্রাস পায়)। এছাড়াও বছরে তিনি দু'বার পুরো শরীরের এমআরআই করেন, প্রতি তিন মাসে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যান এবং ইলেকট্রিক্যাল স্টিমুলেশন স্যুট গায়ে চাপিয়ে ব্যায়াম করেন।
অবশ্য বায়োহ্যাকার এবং বিলিয়নেয়ার ব্রায়ান জনসনের সামনে এ কিছুই-না। ৪৫ বছর বয়সী এ ধনকুবের নিজেকে আবারও ১৮-তে দেখতে ইতিমধ্যে দুই মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন। প্রতিদিন একই নিয়মে চলে তার জীবনধারা- ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠেন, অথচ সকাল ১১টার মধ্যেই সারাদিনের শেষ খাওয়া সারেন। এতটুকু সময়ের মধ্যে লবণ-চিনি ছাড়া ২,২৫০ ক্যালরি গ্রহণ করতে হয় তাকে। রাতে ঘুমানও দ্রুত, সাড়ে ৮টার ভিতর।
জিংক, হলুদ আর লিথিয়াম সমৃদ্ধ ১১১টি পিল নিতে হয় তাকে। প্রতিদিন ৪৫-৬০ মিনিটের ব্যায়াম করতে ভুল হয় না, খেলেন টেনিস আর বাস্কেটবল। ব্রকোলি, ফুলকপি, রসুন, আদা সবমিলিয়ে প্রতিমাসে তাকে খেতে হয় ৭০ পাউন্ড শাকসবজি। তাছাড়া প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় থাকে 'গ্রিন জায়ান্ট শেক', যার সাথে তার পেটে যায় স্পার্মিডিন, ক্রিয়েটিন এবং কোলাজেন পেপটাইডের ৫৪টি সাপ্লিমেন্ট।
ঘুমে যেন ব্যাঘাত না আসে, তাই বিকেল ৪টার পর তিনি কোন প্রকারের লিকুইড বা তরলদ্রব্য সেবন করেন না। একইসাথে পেলভিক ফ্লোরের দৃঢ়তা বজায় এবং প্রস্রাবের প্রবাহ ঠিক রাখতে তিনি একটি যন্ত্র ব্যবহার করেন। মাথার ত্বককে উদ্দীপ্ত করতে ভিটামিন ককটেল এবং রেড লাইট থেরাপি হেলমেটও ব্যবহার করেছেন বলে সম্প্রতি এক পডকাস্টে জানান রবার্ট।
আবার ব্লুমবার্গকে বলেছেন যে, তিনি প্রতিদিন সাতটি ফেসিয়াল ক্রিম ব্যবহার করেন, সপ্তাহে একদিন অ্যাসিড পিল ফেসিয়াল করান, গালের হাড়ের ভেতর ইনজেকশনের মাধ্যমে ফ্যাট প্রবেশ করান এবং কখনোই রোদ পোহান না।
এতকিছু কি সত্যিই কাজে এসেছে? হ্যা দু'টি বছর এবং দুই বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের পর জনসন তার কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে শুরু করেছেন। পরীক্ষায় দেখা গেছে, তার ফিজিক্যাল ফিটনেস এখন ১৮ বছর বয়সীদের সমতুল্য, তার বার্ধক্য প্রক্রিয়ার গতি ২৮% কমে গেছে এবং ডিএনএর পরিমাপ অনুসারে তার কোষের বয়স (এপিজেনেটিক এইজ) পাঁচ বছর পিছিয়ে গেছে।
আসলে সময় আর বার্ধক্যকে প্রতিহত করতে চাইলে ব্যক্তিকে প্রচুর শৃঙ্খলা এবং ত্যাগ স্বীকারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, একদিক দিয়ে ব্যাপারটি গর্বেরও। কিন্তু সত্যিই কি বয়সকে থমকে রাখা যায়!
"আগে মানুষ আভিজাত্য আর মর্যাদার সাথে বার্ধক্যকে মেনে নিত, কিন্তু এখন মানুষ বুড়ো হতেই চায়না! শারীরিক যন্ত্রণা, শত শত পরীক্ষা, ব্যাংকের ঋণ- বয়স কমাতে যেকোনো কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে রাজি তারা", বলেন ডা. সামপায়ো।