গাজা হাসপাতালে বিস্ফোরণ: ওপেন সোর্স ভিডিও বিশ্লেষণ থেকে যা জানা যাচ্ছে
এ সপ্তাহে গাজার একটি হাসপাতালে বিস্ফোরণে কয়েকশ মানুষের প্রাণহানি হওয়ার পর জাতিসংঘ শুক্রবার (২০ অক্টোবর) একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান করেছে।
গাজার ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ আল-আহলি আরব হামপাতালে হামলার জন্য ইসরায়েলেকে অভিযুক্ত করেছে। অন্যদিকে অভিযোগ অস্বীকার করে ইসরায়েল দাবি করেছে, প্যালেস্টাইনিয়ান ইসলামিক জিহাদ-এর উৎক্ষেপণ করা একটি রকেট ভুলে হাসপাতালে পড়ে এ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীটি এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিস্ফোরণে ৪৭০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলের দাবি ফিলিস্তিনিরা নিহতের সংখ্যা ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়িয়ে বলেছে। মার্কিন গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর মূল্যায়ন, নিহতের সংখ্যা ১০০ থেকে ৩০০ হতে পারে।
৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে আচমক আক্রমণের পর ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় পালটা হামলা শুরু করে। হামলার আগে ইসরায়েল গাজাবাসীকে বাসস্থান ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে বলে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আল-আহলি আরব হাসপাতাল থেকে সবাইকে সরে যেতে বিশেষ করে সতর্কবার্তা দিয়েছিল — এমনটাই জানিয়েছে হাসপাতালটি পরিচালনাকারী অ্যাংলিকান চার্চ।
শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের একজন মুখপাত্র জানান, তাদের কর্মীরা বিস্ফোরণস্থল থেকে প্রমাণ উদ্ধারে চেষ্টা করছে, কিন্তু ভারি বোমাবর্ষণ, জ্বালানি সংকট এবং ইসরায়েলের গাজা 'সম্পূর্ণ অবরোধ' এ কাজে বাধা দিচ্ছে।
এদিকে আদতে কী ঘটছে তা বুঝতে আল জাজিরাসহ বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ঘটনার ভিডিও ফুটেজগুলো বিশ্লেষণ করেছে। আল জাজিরা এখনো তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য এটি প্রকাশ করেছে।
কী হয়েছিল?
মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টায় হাসপাতালটিতে বিস্ফোরণ ঘটে। আল জাজিরা'র সরাসরি সম্প্রচারের ভিডিওতে দেখা গেছে, আকাশে একটি উজ্জ্বল আলো ওপরে উঠছে এবং তীব্রভাবে গতিপথ পরিবর্তন করে দুইবার আলোকচ্ছটার পর বিস্ফোরিত হয়েছে।
এরপর দূরে মাটিতে একটি বিস্ফোরণ ধরা পড়ে। তারপরই ক্যামেরার আরও কাছে দ্বিতীয় আরেকটি বড় বিস্ফোরণ দেখা যায়।
বিস্ফোরণের পর হাসপাতাল কম্পাউন্ডের অভ্যন্তরের ভিডিও ও ছবি থেকে দেখা যায়, গাড়ি পার্কিং এলাকায় প্রায় দুই ডজনের মতো গাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। চারপাশে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন, সেগুলোর জানালা উড়ে গেছে, দেওয়ালে ও মাটিতে রক্তের ছোপ।
ভিডিও ফুটেজ থেকে কী জানা গেছে?
আল জাজিরা'র সানাড ভেরিফিকেশন টিমের তদন্তে দেখা গেছে, বিভিন্ন ভিডিও উৎসে রেকর্ড হওয়া আলোকচ্ছটাটি আদতে একটি রকেট মিসফায়ার — ইসরায়েলের এমন দাবির সঙ্গে বিদ্যমান প্রমাণের অসঙ্গতি রয়েছে।
সব ভিডিওর বিস্তারিত বিশ্লেষণের পর সানাড সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, যে আলোকচ্ছটাকে ইসরায়েল রকেট মিসফায়ার হিসেবে অভিহিত করেছে, তার সঙ্গে দেশটির আয়রন ডোমের গাজা থেকে নিক্ষেপ করা একটি মিসাইল প্রতিহত করা ও মাঝ-আকাশে ধ্বংস করার বেশি মিল রয়েছে।
দুই পক্ষের উপস্থাপন করা প্রমাণ বিশ্লেষণ করে চ্যানেল ৪ জানিয়েছে, 'মাঝ-আকাশের ওই বিস্ফোরণ আর মাটিতে ঘটা বিস্ফোরণ একই বলে কোনো প্রমাণ নেই।'
এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় ওই বিস্ফোরণের পেছনে কারা, তার কোনো অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েকটি সংস্থার ধারণা অনুযায়ী, বিস্ফোরণস্থলে তৈরি হওয়া তুলনামূলক ছোট গর্তগুলো ইসরায়েলের সচরাচর নিক্ষিপ্ত মিসাইলগুলোর সঙ্গে মেলে না।
তবে ভিন্ন ধরনের গোলা ব্যবহারের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন বেলিংক্যাট-এর একটি বিশ্লেষণের কথা জানিয়ে প্যাক্স প্রটেকশন অভ সিভিলিয়ানস-এর সামরিক উপদেষ্টা মার্ক গারলাসকো উল্লেখ করেন, বিস্ফোরণস্থলের দৃশ্যপট ইসরায়েলের ব্যবহৃত ৫০০, ১০০০ বা ২০০০ পাউন্ডের জয়েন্ট ডিরেক্ট অ্যাটাক মিউনিশন (জেড্যাম)-এর সঙ্গে মেলে না।
চ্যানেল ৪-এর যেসব সাংবাদিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন, তারাও জানান বিস্ফোরণস্থলে তৈরি হওয়া গর্ত মিসাইলের চেয়ে মর্টারের গোলার সঙ্গেই বেশি মেলে। আশপাশের ভবনগুলো কেবল বাইরের দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, গঠনগত কোনো ক্ষতি হয়নি।
তবে এটি মাটি স্পর্শ করার আগে শূন্যে বিস্ফোরিত হওয়া কোনো মিসাইলের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়নি।
বিবিসি'র বিশ্লেষণ করা ভিডিওতে দেখা গেছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারির ঘটনা নিয়ে উল্লেখ করা বয়ানও অসঙ্গতিপূর্ণ। বিবিসি জানিয়েছে, ওই মুখপাত্র হাসপাতালের কাছে একটি গোরস্থান থেকে রকেট ছোড়া হয়েছে দাবি করলেও বাস্তবে হাসপাতালের কাছাকাছি স্থানে কোনো গোরস্থান নেই।
বিবিসি আরও জানিয়েছে, এ বিস্ফোরণে এখনো একটি বড় প্রমাণ পাওয়া যায়নি, আর সেটি হলো মিসাইলের ভাঙা টুকরা। বিস্ফোরণস্থলে পাওয়া মিসাইল বা রকেটের ভাঙা অংশ দেখে প্রায়ই সেটি শনাক্ত করা যায়। কিন্তু আল-আহলি আরব হাসপাতালে বিস্ফোরণের পর এখনো কোনো গোলা বা মিসাইলের ভাঙা অংশ পাওয়া যায়নি।
অন্য কোনো প্রমাণ আছে কি?
বিস্ফোরণের রাতে বিস্ফোরণ ঘটার কয়েক মিনিট পরপরই ৭টা ৯ মিনিটে টেলিগ্রামে দ্য প্যালেস্টাইনিয়ান ইসলামিক জিহাদ এক পোস্টে জানায়, এটি ইসরায়েলের দিকে একগুচ্ছ রকেট নিক্ষেপ করেছে।
বুধবার দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গোষ্ঠীটির একজন মুখপাত্র মুসাব আল-ব্রেইম বলেন, তাদের পোস্টের সময় আর রকেট নিক্ষেপের সময় সর্বদা এক হয় না।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর একজন সহযোগী (এইড) হানানিয়া নাফতালির এক্স-এ করা একটি পোস্টও সন্দেহের উদ্রেক ঘটিয়েছে। তিনি তার পোস্টে লেখেন, 'ইসরায়েল বিমানবাহিনী গাজায় একটি হাসপাতালের অভ্যন্তরে হামাস সন্ত্রাসীদের আস্তানায় আঘাত হেনেছে।' কিন্তু তিনি পোস্টটি তাৎক্ষণিকভাবে মুছে ফেলেন।
রাত ১০টা ৫৮ মিনিটে ক্ষমাপ্রার্থনা করে আরেক পোস্টে তিনি লেখেন, তিনি রয়টার্স-এর একটি প্রতিবেদন শেয়ার করেছিলেন, যেখানে 'ভুলভাবে বলা হয়েছে যে ইসরায়েল হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে'। 'যেহেতু ইসরায়েলি বাহিনী হাসপাতালে বোমাবর্ষণ করে না, তাই আমি ভেবে নিয়েছিলাম ইসরায়েল গাজায় হামাসের কোনো ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে,' তিনি লেখেন।