নিরাপত্তা পরিষদে তুমুল বিতর্কের পরও ‘মানবিক বিরতি’ চায় যুক্তরাষ্ট্র!
গাজায় যুদ্ধবিরতি চায় না যুক্তরাষ্ট্র, তাদের চাওয়া 'মানবিক বিরতি'। এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবে সব দেশকে আহ্বান জানিয়েছে দেশটি।
ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রথম উন্মুক্ত বিতর্কের আয়োজন করেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। সেখানে অধিকাংশ সদস্য ফিলিস্তিনে মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে দেওয়ার জন্য তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে।
১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদ এখনও এই সহিংসতা বন্ধের জন্য কোনো প্রস্তাব পাশ করতে পারেনি। পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতা রয়েছে।
ওয়াশিংটন বলেছে, তারা যুদ্ধবিরতি নয়, 'মানবিক বিরতির' পক্ষে—যা কম আনুষ্ঠানিক এবং যুদ্ধবিরতির চেয়ে সংক্ষিপ্ত।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে উত্থাপন করা একটি নতুন প্রস্তাবে সমর্থন দিতে আহ্বান জানিয়েছেন নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি। নতুন এই প্রস্তাবের খসড়ায় 'সব রাষ্ট্রের সহজাত আত্মরক্ষার অধিকারের' ওপর জোর দেওয়া হবে। সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহ্বানও জানানো হবে। গাজায় সহায়তা প্রবেশের জন্য এ প্রস্তাবে 'মানবিক বিরতি'কে সমর্থন দেবে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের রক্ষার ওপরও জোর দেন।
তিনি বলেন, বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য ইসরায়েলকে সম্ভাব্য সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এছাড়া গাজায় ত্রাণ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে ও বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতির হাত থেকে নিরাপদ রাখতে অবশ্যই 'মানবিক বিরতি' কার্যকর করার কথা বিবেচনা করতে হবে।
একজন সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, তারা মনে করেন মানবিক বিরতি দিলে গাজায় সহায়তা প্রবেশ করার সুযোগ তো তৈরি হবেই, তার সঙ্গে যুগপৎভাবে ইসরায়েল সামরিক অভিযানও চালিয়ে যেতে পারবে। সেজন্যই তারা যুদ্ধবিরতির বদলে মানবিক বিরতির পক্ষে।
এদিকে রাশিয়া এখনও তার আগের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের পক্ষেই অনড় রয়েছে। এ সপ্তাহের শেষ দিকে এ প্রস্তাবের ওপর আবার ভোটাভুটি হতে পারে।
জাতিসংঘের রুশ প্রতিনিধি ভাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, 'পুরো বিশ্ব আশা করছে যে নিরাপত্তা পরিষদ শিগগিরই গাজায় নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাবে।'
গত সপ্তাহে এক প্রস্তাবে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। তাতে সমর্থন দিয়েছিল ১২টি সদস্য, কিন্তু ভেটো দিয়েছিল ইসরায়েলের সবচেয়ে কট্টর সমর্থক যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল, ওই প্রস্তাবে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
এর আগে রাশিয়ার উত্থাপন করা এক প্রস্তাবেও ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
মঙ্গলবারের বিতর্কে ৩০ জন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ডেপুটি মন্ত্রীসহ বক্তার তালিকায় ছিল ৯০টি দেশ। সেখানে অনেক বক্তাই যুদ্ধবিরতি এবং ফিলিস্তিনে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা বন্ধের আহ্বান জানান।
মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শুকরি বলেন, 'আমরা দুঃখের সঙ্গে দেখেছি, এই পরিষদ দুবার প্রস্তাব গ্রহণে, এমনকি এই যুদ্ধ শেষ করতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাতেও ব্যর্থ হয়েছে।'
জাতিসংঘে ২২ সদস্যের আরব গ্রুপের প্রতিনিধি হিসেবে জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেছেন, ইসরায়েল গাজাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাতে নিরাপত্তা পরিষদের ব্যর্থতায় তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন।
যুদ্ধ বন্ধ, দুপক্ষের বেসামরিক নাগরিক হত্যার নিন্দা জানানো এবং ফিলিস্তিনিদের শাস্তি ও অনাহার ঠেকাতে প্রস্তাব গ্রহণ করতে সব কূটনীতিকের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সাফাদি বলেন, 'আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ করা হবে—২০০ কোটি আরব ও মুসলিমকে এ নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে।'
এই অচলাবস্থার মধ্যে জর্ডান ও রাশিয়া বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি বৈঠক আয়োজনের অনুরোধ জানিয়েছে দেশগুলোকে। জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলো মানা বাধ্যতামূলক নয়, তবে এসব প্রস্তাবের প্রতীকী মূল্য রয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে অতর্কিত হামলা চালায় ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী সংগঠন হামাস। এতে ১ হাজার ৪০০ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়। জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় বিরামহীন বোমাবর্ষণ করছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে অন্তত ৬ হাজার ৪৫৬ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে।
সংঘাত শুরুর পর থেকেই গাজায় পানি, খাদ্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। আর বিরামহীন বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে ২৩ লাখ বাসিন্দার গাজায়।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার কারণে হামাসের ৭ অক্টোবরের ভয়ংকর হামলা ন্যায্যতা পেতে পারে না। আর ওই ভয়ংকর হামলার কারণে ফিলিস্তিনি মানুষদের সম্মিলিতভাবে যে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, তা-ও ন্যায্যতা পেতে পারে না।
সরাসরি নাম না নিয়ে ইসরায়েলের সমালোচনা করে গুতেরেস বলেছেন, গাজায় আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের যে সুস্পষ্ট লঙ্ঘন দেখতে পাচ্ছেন, তা নিয়ে তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, একটি সংঘাতে কোনো পক্ষই আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
গুতেরেস হামাসেরও সমালোচনা করেন। হামাসের নাম না নিয়ে তিনি বলেন, বেসামরিকদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের নাম কখনও তাদেরকে রক্ষা করা হতে পারে না।
গুতেরেসের মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তার পদত্যাগ দাবি করেছে ইসরায়েল। সেইসঙ্গে তারা এ-ও জানিয়েছে যে, জাতিসংঘের কোনো কর্মকর্তাকে ইসরায়েলের ভিসা দেওয়া হবে না।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ আল-মালিকি বলেছেন, একমাত্র শান্তিই ইসরায়েলকে নিরাপদ রাখতে পারে।
হামাসের প্রতিপক্ষ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি আল-মালিকি বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের নিষ্ক্রিয়তার মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।