আল-শিফা হাসপাতালে ইসরায়েলি বাহিনীর নিষ্ঠুর অবরোধের বর্ণনা দিলেন ফিলিস্তিনি নারী সার্জন
গাজার সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যকেন্দ্র– আল শিফা হাসপাতাল গত ৯ নভেম্বর থেকেই ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ। একইসঙ্গে, করা হয়েছে গোলাবর্ষণ। এতে করে, বেশকিছু চিকিৎসক ও আশ্রয় নেওয়া বেসামরিক নাগরিক হাসপাতাল ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখে গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা ইতোমধ্যেই আল-শিফার কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার কথাও জানিয়েছেন।
পালাতে বাধ্য হওয়াদের মধ্যে আছেন ফিলিস্তিনি সার্জন হায়া আল-শেখ খলিল। গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর এক মাস পেরিয়েছে। এই সময়টা খলিল হাসপাতালেই ছিলেন, কিন্তু গত শুক্রবার (১০ নভেম্বর) যখন আল-শিফা মেডিকেল কমপ্লেক্সের ভবনে ইসরায়েলি বাহিনীর অনুপ্রবেশ অবশ্যসম্ভাবী মনে হচ্ছিল, তখন খলিল অন্যদের সাথে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন।
নারী এই শল্যচিকিৎসক জানান, নিজের দুই ভাই ও আরও জনাকয়েক নারী চিকিৎসকের সাথে তিনি হাসপাতাল ত্যাগ করেন। তাদের সাথে ছিল বাস্তুচ্যূত অনেক ফিলিস্তিনি, যারা হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিল। গত শুক্রবার ইসরায়েলি বাহিনী হাসপাতাল ত্যাগের আল্টিমেটাম দিলে, নারী ও শিশুদের প্রাণ বাঁচাতে পালাতে বলেন সেখানে অবস্থান করা অন্য চিকিৎসকরা।
হাসপাতালের মতোন মানবিক স্থাপনা ঘিরে ফেলে ইসরায়েলি বাহিনী যে নিষ্ঠুর অবরোধ কায়েম করেছে, তার বর্ণনাও দেন খলিল। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার রাতে ইসরায়েলি বাহিনী আল-শিফার বিশেষায়িত ইউনিটের ভবনকে লক্ষ্যবস্তু করে, সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র ও ট্যাংকের গোলা ছোঁড়ে। হাসপাতালের বহির্বিভাগের ক্লিনিক, প্রসূতি বিভাগ ও গাইনোকলজি ভবনও এ হামলার শিকার হয়।
এই অবস্থায়, অবধারিত মৃত্যুর মুখেও বিপুল সংখ্যক গুরুতর আহত রোগীদের মুখ চেয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করতে রাজি হননি অনেক চিকিৎসক। এসব রোগীর অবস্থা এতটাই গুরুতর যে তাদের হাসপাতাল থেকে অন্যত্র নেওয়া সম্ভব নয়।
খলিল বলেন, 'আল-শিফা হাসপাতাল অবরোধকালে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী যে নিষ্ঠুরতা চালাচ্ছে, তা আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। অথচ এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিপুল সংখ্যক আহতদের পাশাপাশি, বাস্তুচ্যুত অনেক পরিবার ও বেসামরিক চিকিৎসকরা রয়েছেন।'
তিনি জানান, আল-শিফায় ভর্তি অনেক রোগীর পরিবারের প্রায় সকল সদস্যই ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন। ফলে তাদের সার্বক্ষণিক পরিচর্যা করবার মতোন নিকটজন কেউ নেই, ডাক্তার ও নার্সরাই তাদের শেষ ভরসা। তাঁরা এতটা গুরুতর আহত যে অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া তাদের সরিয়ে নেওয়া যাবে না। অথচ পুরো গাজায় এখন অ্যাম্বুলেন্সের প্রচণ্ড সংকট। অনেক অ্যাম্বুলেন্সকে ধবংস করেছে ইসরায়েল। অবশিষ্ট অ্যাম্বুলেন্সগুলোও ধবংসস্তূপে ভরা সড়ক পারি দিয়ে হাসপাতালে আসতে পারছে না।'
খলিল বলেন, 'বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাকে আহত শিশুদের অপারেশন করতে হয়েছে। এখন তাদের দেখাশোনার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক চিকিৎসা কর্মী নেই, চিকিৎসা সরঞ্জাম, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিও নেই। এক কথায়, তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।'
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, শুক্রবার হাসপাতালটি অবরুদ্ধ হওয়ার পর থেকে দুই শিশুসহ লাইফ সাপোর্টে রাখা অন্তত ৭ রোগী মারা গেছে। বিদ্যুতের অভাবে ভেন্টিলেটর ও ইনকিউবেটর কাজ না করায় নবজাতক শিশু দুটি মারা যায়।
রোববার সকালে গাজায় ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ডা. মুনির আল-বোর্শ সাংবাদিকদের জানান, অন্তত ৪০ জন বাস্তুচ্যুত মানুষ হাসপাতালের প্রধান ফটক দিয়ে বাইরে যাচ্ছিল, এসময় নিকটবর্তী সড়কে অবস্থান করা ইসরায়েলি ট্যাংক তাদের লক্ষ্য করে গোলা ছোঁড়ে। এতে প্রায় সকলেই তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হন। মৃতদেহগুলো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘটনাস্থলে পড়ে আছে। কাছাকাছি থাকা অ্যাম্বুলেন্স কর্মীরা লাশগুলো সরাতে পারেননি, কারণ যেই সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, তার দিকে গুলি ছুঁড়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
মহাপরিচালক জানান, শনিবার রাতভর আল-শিফা মেডিকেল কমপ্লেক্সের পানির কূপগুলোতে বোমা ফেলেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে রোববার দিনের শুরুতে সচল ছিল মাত্র একটি পাম্প। যেখান থেকে প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ১২ কাপ পানি পাওয়া যাচ্ছে হাসপাতালে অবরুদ্ধ থাকা ১৫ হাজার মানুষের জন্য।
এ ছাড়া, হাসপাতালের নিবির পরিচর্যা ইউনিটে আবারো গোলা নিক্ষেপ করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা আগেও এ ইউনিট হামলার শিকার হয়।
এই অবস্থায়, রোববার সকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও বা হু) জানায়, আল-শিফা হাসপাতালের সাথে তাদের সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সংস্থাটি বলেছে, 'স্বাস্থ্য কর্মী, শত শত অসুস্থ ও আহত রোগীর নিরাপত্তার বিষয়ে হু'র গভীর উদ্বেগ আছে। রোগীদের মধ্যে লাইফ সাপোর্টে থাকা শিশুরাও আছে। এ ছাড়া, বাস্তুচ্যুত মানুষ যারা হাসপাতালে রয়েছেন, তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেও আমরা উদ্বিগ্ন।'
হু জানায়, 'স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা রোগীদের কখনো ভীতি, আতঙ্কের মুখোমুখি করা উচিত নয়, এবং যেসব স্বাস্থ্যকর্মী তাদের চিকিৎসার ব্রত নিয়েছেন – তাদেরকেও দায়িত্ব পালন করতে জীবনের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে, যা কখনোই কাম্য নয়।'
হু আরও বলে, হাসপাতাল ছেড়ে পালানো কিছু মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে তাদের 'আহত এমনকি হত্যার' ঘটনাও আমরা জেনেছি।
পালানোর 'ভয়াল' অভিজ্ঞতা
আল-শিফা হাসপাতাল উত্তর গাজায়, হাসপাতাল ছেড়ে খলিল ও তার সঙ্গীরা পায়ে হেঁটে গাজার দক্ষিণাঞ্চলের দিকে রওনা হন।
কিন্তু, যুদ্ধাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে তাদের এই যাত্রা ছিল মারাত্মক বিপজ্জনক। খলিল জানান, 'আমরা নিজদের পরিচয়পত্র সাথে রেখেছিলাম, কিন্তু কোথায় যাব, আদৌ সেখানে পৌঁছাতে পারব কিনা– কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। গন্তব্য ছিল পুরোপুরি অনিশ্চিত।'
'রাস্তার দৃশ্য ছিল দুঃস্বপ্নের বিভীষিকার মতোন। কামানের গোলা বৃষ্টির মধ্যেই ধবংসস্তূপে চাপা পড়া মানুষকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছিল চারধারে। (ইসরায়েলি) সেনারা আমাদের দিকে রাইফেল তাক করছিল। অসহ্য গরমের মধ্যে আমরা দীর্ঘপথ হেঁটেছি। এক পর্যায়ে আমি সম্পূর্ণ পরিশ্রান্ত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম।'
খলিলের সাথে থাকা তার দুই ভাই ও অন্যান্য সহকর্মীরা উত্তর গাজা থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা পায়ে হেঁটে গাজার কেন্দ্রে অবস্থিত নুসেরিয়াত শরণার্থী শিবিরে পৌঁছান।
তিনি জানান, পথচলতি মানুষকে ডাইনে বা বাঁয়ের রাস্তায় যেতে দেয়নি ইসরায়েলি সেনারা। এসময় তাঁরা পলায়মান জনতার মধ্যে থেকে অনেক তরুণকে আটক করে, বেধরক মারপিট করে। অনেককে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে গ্রেপ্তার করে।
'আমরা এক ফিলিস্তিনি যুবককে দেখেছি, সেনারা যাকে নিজের সব কাপড় খুলতে বাধ্য করছিল। আরেক তরুণ এবং তার শিশু সন্তানকে মারপিট ও লাঞ্ছনার দৃশ্যও দেখেছি।'
ফিলিস্তিনি এই নারী সার্জন আরও বলেন, যে পরিমাণ বাস্তুচ্যুত মানুষকে আমরা পথে দেখেছি, তা অবিশ্বাস্য। কোন আশ্রয়কেন্দ্রেই আর তিলমাত্র জায়গা নেই।
খলিলের দুই ভাই-ই চিকিৎসক। তাদের মধ্যে একজনের নাম বদর। তিনি মিডল ইস্ট আইকে জানান, বৃহস্পতিবারে শুরু হওয়া গোলাবর্ষণ টানা চলেছে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত।
এরপর সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টার মধ্যে আটকে পড়া মানুষকে পালানোর নির্দেশ দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। আসার পথে মৃত্যু ও ধবংসের যে ভয়াবহ দৃশ্যগুলো দেখেছেন, সে সম্পর্কে তিনিও জানান।
বদর বলেন, 'যাত্রাপথ ছিল ভয়ঙ্কর। আমাদের চারপাশে বোমায় গুঁড়িয়ে দেওয়া ভবনের সারি, রাস্তায় পড়ে আছে খণ্ডবিখণ্ড মানবদেহের টুকরো। এ ছাড়া, যেসব মানুষ বা পশুপাখিকে পালানোর সময়েই গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তাদের মৃতদেহও দেখেছি আমরা।'
'আইডি হাতে নিয়ে আমরা যেন ছুটছিলাম, আমাদের ডানে বা বাঁয়ে মোড় নিতেও দেওয়া হয়নি।'
বদর বলেন, পথে তাঁরা একটি তল্লাশী চৌকির সম্মুখীন হন। যেখানে ছিল সাতটি ট্যাংক, বেশ কয়েকটি বুলডোজার। ট্যাংকের চারপাশে অবস্থান নিয়েছিল অন্তত ২০ ইসরায়েলি সেনা। যাদের কোন আইডি নেই, তাদেরকে তারা থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল, খুবই বাজেভাবে অপমান, লাঞ্ছনা করছিল।
এদিকে ইসরায়েল দাবি করছে, আল-শিফা হাসপাতালকে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু, তার স্বপক্ষে কোন প্রমাণ দিতে পারেননি ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।
এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা; হামাস-সহ ফিলিস্তিনের সশস্ত্র মুক্তিকামী সংগঠনগুলোও বলছে এটি ডাহা মিথ্যে। আল-শিফা হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা সেবা দেওয়া বিদেশি চিকিৎসক ও মানবাধিকার কর্মীরাও বলছেন, যুদ্ধাপরাধকে জায়েজ করতে এই মিথ্যাচার করছে তেল আবিব।
আল-শিফা হাসপাতালে ১৬ বছর চিকিৎসা সেবা দেওয়া নরওয়ের চিকিৎসক ম্যাডস গিলবার্ট বলেন, তিনি কোনদিন আল-শিফায় সামরিক কমান্ড সেন্টার থাকার প্রমাণ পাননি।
তিনি বলেন, আমি ওই হাসপাতালে রাতের পর রাত কাটিয়েছে। সর্বত্র অবাধে ঘুরে বেড়িয়েছি, কেউ আমাকে কোনখানে যেতে বাঁধা দেয়নি। কস্মিনকালেও সেখানে কোন সামরিক কর্মকাণ্ড ছিল না।