মানব কোষ থেকে সৃষ্ট ক্ষুদ্র রোবটে বিষ্ময় বিজ্ঞানীদের
বিজ্ঞানীরা মানবদেহের কোষ থেকে ক্ষুদ্র জীবন্ত রোবট তৈরি করেছেন, যেটি নিজে থেকে নড়াচড়া করতে পারে। তারা বলছেন, এটি সম্ভবত একদিন মানবদেহের আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুর নিরাময়ে ভূমিকা রাখবে।
টুফ্টস ইউনিভার্সিটি ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ওয়েইজ ইনস্টিটিউটের এক দল গবেষক এই সৃষ্টির নাম দিয়েছেন অ্যানথ্রোবট। এর আগে আফ্রিকান নখযুক্ত ব্যাঙের (বৈজ্ঞানিক নাম জেনোপাস লেভিস) ভ্রুণের স্টিম কোষ থেকে জীবন্ত রোবট বা জেনোবট তৈরি করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। তাদেরই কয়েকজন এবার জেনোবটের উপর ভিত্তি করে অ্যানথ্রোবট সৃষ্টি করলেন।
গবেষণাটির লেখক মাইকেল লেভিন বলেছিলেন, 'আমি মনে করি এটি জীবন্ত জিনিসগুলোরই একটি।'
তিনি আরো বলেন, 'আমাদের নিজেদের শরীরের কোষের যেসব দক্ষতা বা সক্ষমতা রয়েছে তার সবগুলোই আমরা বুঝতে পারি না।'
লেভিন বলেন, অ্যানথ্রোবটগুলো পূর্ণাঙ্গ জীব ছিল না। কারণ তাদের পূর্ণ জীবনচক্র ছিল না। এটি আমাদের ভাবায় যে এই ক্ষুদ্র শ্রেণি আসলে একটি রোবট, নাকি একটি প্রাণী, নাকি যন্ত্র? এগুলো থেকে আমরা খুব ভাল ধারণা পাই না। আমাদের এর বাইরে গিয়ে আরো বিস্তর গবেষণা করতে হবে।'
গবেষণাটি অ্যাডভান্সড সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা কীভাবে এগুলো তৈরি করলেন?
বিজ্ঞানীরা এই অ্যানথ্রোবট তৈরির জন্য বিভিন্ন বয়স (প্রাপ্তবয়স্ক) ও লিঙ্গের মানুষের শ্বাসনালী বা উইন্ডপাইপের কোষ ব্যবহার করেছেন।
গবেষণাটির সহলেখক গিজাম গুমুস্কায়া বলেন, কোভিড-১৯ ও ফুসফুসের রোগ নিয়ে কাজ করার কারণে এই ধরনের কোষের ওপর গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করাটা গবেষকদের জন্য তুলনামূলক সহজ ছিল। আরো গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তা হলো এসব কোষের একটি বৈশিষ্ট্য, যা কোষগুলোকে গতিশীল করতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেছিলেন।
শ্বাসনালীর কোষগুলো সিলিয়া নামক লোমের মতো কিছু দ্বারা আবৃত থাকে, যা সামনে-পিছে নড়াচড়া করতে পারে। আগের গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, এসব কোষ অর্গানয়েড (কোষগুচ্ছ) গঠন করতে পারে।
রাসায়নিক সংমিশ্রণ ব্যবহার করে গুমুস্কায়া শ্বাসনালীর কোষের বৃদ্ধির ওপর পরীক্ষা চালান। তিনি সিলিয়াকে অর্গানয়েড থেকে বহির্মুখী করার একটি উপায় খুঁজে পান। আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর কয়েকদিন পর অর্গানয়েডগুলো নিজে থেকে নড়াচড়া করতে শুরু করে।
গুমুস্কায়া বলেন, প্রথম পাঁচ দিন পর্যন্ত কিছুই ঘটেনি। সাত দিনের মাথায় একটি দ্রুত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এটি দেখতে ছিল প্রস্ফুটিত ফুলের মতো।
লেভিন জানান, প্রতিটি অ্যানথ্রোবটের নিজে নিজে একসাথে জড়ো হওয়ার দৃশ্য তাদের অনন্য করে তোলে।
আকার-আকৃতির ভিন্নতা
দলটির তৈরি করা অ্যানথ্রোবটগুলো আকার-আকৃতিতে একই রকম নয়। এগুলোর কিছু ছিল গোলাকার এবং সিলিয়া দ্বারা সম্পূর্ণরূপে আচ্ছাদিত। আর কিছু ছিল ফুটবলের মতো এবং অসম্পূর্ণরূপে আবৃত। এগুলোর একেকটির নড়াচড়ার দিকও ভিন্ন। কিছুর নড়াচড়ার দিক সরলরেখা বরাবর, কিছুর দিক আবার আঁটসাঁট বৃত্তাকার। পরীক্ষাগারে থাকা অবস্থায় অ্যানথ্রোবটগুলো ৬০ দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিল।
লেভিন এবং গুমুস্কায়া বলেন, লক্ষ্য হলো এই অ্যানথ্রোবটগুলোর চিকিৎসা কার্যকারিতা আছে কি না, সেটি খুঁজে বের করা। এজন্য গবেষকরা মানুষের নিউরনের ভেতর দিয়ে অ্যানথ্রোবটগুলো চলাচল করতে পারে কি না তা পরীক্ষা করেন।
গবেষকরা বিষ্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেন, অ্যানথ্রোবটগুলো নিউরনের ক্ষতিগ্রস্ত অংশের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করছে। তবে এর নিরাময়ের প্রক্রিয়াটি এখনও বুঝতে পারেননি তারা।
জার্মানির ফ্রেইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রেইবার্গ সেন্টার ফর ইন্টারঅ্যাকটিভ ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড বায়োইনস্পায়ার্ড টেকনোলজিসের একটি গ্রুপের নেতা ফার্ক টাউবার বলেছেন, অ্যানথ্রোবটগুলো 'বিষ্ময়কর আচরণ' দেখিয়েছে। বিশেষত নিউরনের ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলোতে চালিত হওয়ার সময়।
এই অ্যানথ্রোবটগুলো নিরাপত্তা বা সুরক্ষা নিয়ে কোনো উদ্বেগ তৈরি করতে পারে বলে মনে করেন না লেভিন। তিনি বলেন, এগুলো কেবল একটি নির্দিষ্ট পরিবেশেই বেঁচে থাকতে পারে। তাই অ্যানথ্রোবটগুলো কোনোভাবে ল্যাবের বাইরে চলে গেলেও তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই।