হুতিদের লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা কীভাবে বিশ্ব বাণিজ্যকে প্রভাবিত করছে?
ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের সময় লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা বাড়িয়েছে। এতে সাগর পথে তেল, শস্য এবং ভোগ্যপণ্যের পরিবহনে ব্যাঘাত হওয়ায় বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর এর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
শুরুতে কেবল ইসরাইলগামী জাহাজের ওপর হামলা হলেও সাগরের আফ্রিকা ও আরব পেনিজুয়েলার মধ্যকার অংশ দিয়ে নরওয়ে ও লিবিয়ার মতো দেশগুলোর পতাহাবাহী জাহাজের ওপরেও হামলার হুমকি বাড়ছে। ফলে এই পথে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সারাবিশ্বের প্রায় ১০ শতাংশ বাণিজ্যিক পণ্য লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে চলাচল করে।
সাম্প্রতিক এসব হামলার কারণে বিশ্বের বৃহত্তম শিপিং কোম্পানি মারস্ক, তার সমস্ত জাহাজকে পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত দক্ষিণ লোহিত সাগরের একটি চোক পয়েন্টের মধ্য দিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। জার্মান ভিত্তিক জাহাজ হ্যাপাগ-লয়েডের একটি জাহাজে হামলার পর সোমবার পর্যন্ত তাদের সকল কন্টেইনার জাহাজ চলাচলে বিরতি ঘোষণা করেছে। তবে জাহাজ ট্র্যাকিং সংস্থা 'মেরিন ট্র্যাফিক' জানায়, ওই অঞ্চলে এখনো অনেক জাহাজ চলাচল করছে।
সাম্প্রতিক আক্রমণগুলো যেভাবে পণ্য পরিবহন ও বিশ্ব বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করছে
ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা ২০১৪ সালে উত্তর ইয়েমেন থেকে এসে ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখল করে। এরপর থেকে তারা সৌদি আরবের নেতৃত্বে এক জোট হয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয় ইয়েমেনি সরকার পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে।
হুতি বিদ্রোহীরা ওই এলাকার নির্দিষ্ট জাহাজ লক্ষ্য করে হামলা চালাতে থাকে, কিন্তু ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর তাদের এই হামলা আরো বৃদ্ধি পায়। ইসরায়েলি জাহাজ এবং নাবিকদের জিম্মি করতে তারা ড্রোন, অ্যান্টি-শিপ মিসাইল এবং একবার একটি হেলিকপ্টারেরও ব্যবহার করে।
হুতিরা আগে শুধু ইসরায়েলের দিকে যাওয়া বা আসা জাহাজগুলোকে হামলার হুমকি দিলেও এখন এই পথে চলাচল করা সকল জাহাজকেই হুমকির মধ্যে রাখছে। তারা রেডিও ব্যবহার করে জাহাজগুলোকে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা অঞ্চল থেকে দূরে থাকতে ও তাদের গতিপথ পরিবর্তন করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি অফিস জানান, 'ইয়েমেন এর হুতি বিদ্রোহীদের লাগাতার হামলার কারণে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নৌপথ ও সামুদ্রিক নিরাপত্তাও হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।'
লোহিত সাগরের উত্তর প্রান্তে সুয়েজ খাল এবং দক্ষিণ প্রান্তে সংকীর্ণ বাব এল-মান্দেব প্রণালী রয়েছে, যা এডেন উপসাগরে নিয়ে যায়। এটি এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে পণ্য পরিবহনের জন্য সুয়েজ খাল অতিক্রমকারী জাহাজগুলোর অন্যতম ব্যস্ত জলপথ।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অফ শিপিং এর পরিবেশ ও বাণিজ্য বিষয়ক সিনিয়র ম্যানেজার জন স্টোপার্ট জানান, লোহিত সাগর দিয়ে বিপুল পরিমাণে তেল ও ডিজেলের মতো জ্বালানি ইউরোপে সরবরাহ করা হয়, যা পৃথিবীর মোট বাণিজ্যিক বহরের ৮০ শতাংশ। এছাড়াও পাম তেল, শস্য, এবং বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সমন্বিত কন্টেইনার জাহাজের বিভিন্ন পণ্য পরিবহনের জন্য এই জলপথ গুরুত্বপূর্ণ।
কোপেনহেগেন ভিত্তিক মারস্ক কোম্পানি সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা জানায়, এ ধরনের হামলার পর তারা নাবিকদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। গত বৃহস্পতিবার ওমান থেকে সৌদি আরব যাওয়ার পথে তাদের একটি কন্টেইনার জাহাজে মিসাইল হামলা করা হলেও তা শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যচ্যুত হয়।
মারস্ক কোম্পানি শুক্রবারে এক বিবৃতিতে বলে, "আমরা পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সকল মারস্ক জাহাজগুলোকে বাব আল-মান্দাব প্রণালীতে যাত্রা বিরতি দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছি।" কোম্পানিটি জানায় যে, তারা পুরো নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং গ্রাহকদের ওপর এই ঘটনার প্রভাব কমানোর জন্য কাজ করছে।
জাহাজ হ্যাপাগ-লয়েড কর্তৃপক্ষ জানায়, আগামী সোমবার পর্যন্ত তাদের কন্টেইনার জাহাজগুলোকে লোহিত সাগরে সাময়িক বিরতি দেওয়া হয়েছে এবং সোমবারের পর তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির সিনিয়র ফেলো নোয়াম রায়দানের মতে, ইসরায়েলি সংযোগ আছে এমন কিছু জাহাজ আফ্রিকা এবং কেপ অফ গুড হোপ-কেন্দ্রিক দীর্ঘপথ বেছে নিয়েছে। জাহাজের গতির ওপর নির্ভর করে এই পথে যাত্রার সময় ১৯ থেকে ৩১ দিন পর্যন্ত হতে পারে। এই পথে তাদের সময় ও খরচ অনেক বাড়বে।
সাম্প্রতিক এসব হামলায় বিশ্বব্যাপী তেলের বাজারে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তেলের দাম কমে গেছে এবং বাজারে তেলের দুর্বল চাহিদাই প্রধান চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, হুতিদের সাম্প্রতিক হামলার সবচেয়ে তাৎক্ষণিক প্রভাব হলো অতিরিক্ত বিমা (ইনস্যুরেন্স) খরচ।
ভেসেল প্রোটেক্ট'র অপারেশন প্রধান মুনরো অ্যান্ডারসনের মতে, সাম্প্রতিক আক্রমণগুলো লোহিত সাগরে জাহাজগুলোর জন্য একটি ক্রমবর্ধমান হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে; যা এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক পরিবহন ব্যবস্থার জন্য একটি বাধা সৃষ্টি করেছে।
ভেসেল প্রোটেক্ট সংস্থাটি সমুদ্রে যুদ্ধের ঝুঁকি মূল্যায়ন করে এবং বিশ্বের বৃহত্তম বীমা বাজার লয়েডে'র সহায়তায় বিমা প্রদান করে।
মুনরো অ্যান্ডারসনের আরো জানান, লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো আরো অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন হতে পারে, যার ফলে স্বল্প থেকে মধ্য মেয়াদে উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।
লয়েড'স লিস্ট ইন্টেলিজেন্সের বীমা সম্পাদক ডেভিড ওসলারের মতে, লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে যাতায়াতকারী জাহাজগুলো এখন দ্বিগুণ বীমা খরচের সম্মুখীন হচ্ছে। এই বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে ব্যয়বহুল জাহাজের জন্য কয়েক হাজার ডলারের অতিরিক্ত খরচ হতে পারে।
তিনি আরো জানান, ইসরায়েলি জাহাজ মালিকদের জন্য বীমা খরচ ২৫০ শতাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছে; কিন্তু কিছু কিছু বীমা কোম্পানি এই বীমার পুরো অংশ কাভার করবে না।
এছাড়া জাহাজগুলো আমাজন থেকে কেনা শস্য, তেল এবং অন্যান্য পণ্যে প্রতি কন্টেইনারে ৫০ থেকে ১০০ মার্কিন ডলার এর মতো যুদ্ধ ঝুঁকি (ওয়ার রিস্ক) চার্জ যুক্ত করছে। তবে এই ফি তুলনামূলকভাবে কম।
লয়েড'স লিস্ট ইন্টেলিজেন্সের বীমা সম্পাদক ডেভিড ওসলারের মতে, এটি ভোক্তাদের জন্য অতোটা দাম বাড়াবে না।
ডেভিড মনে করেন, অবস্থার অবনতি হলে বীমা খরচ আরো বাড়বে। তাই জাহাজ মালিকদের এই পথ ব্যবহার করার আগে আরো ভাবা উচিত।
বিশেষজ্ঞদের মত, নৌপথে অবরোধ দেওয়ার জন্য হুথিদের ভালো কোনো যুদ্ধজাহাজ নেই। তারা মাঝে মাঝে ঝটিকা হামলা চালায় এবং মাত্র একটি হেলিকপ্টার দিয়ে একবার জাহাজে হামলা করেছে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং অন্যান্য দেশের জোটের যুদ্ধজাহাজগুলো জলপথ খোলা ও হুথিমুক্ত রাখতে নিয়মিত টহল দিচ্ছে।
স্টোপার্ট বলেন, এ ধরনের হামলা জাহাজ ইন্ডাস্ট্রিতে উদ্বেগ তৈরি করলেও এখনো অনেক জাহাজ লোহিত সাগর দিয়ে চলাচল করছে, কারণ ইউরোপ ও এশিয়ার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ।
তার মতে জলপথে হুতিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা সীমিত। তিনি বলেন, "আমি লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে পণ্য পরিবহন বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখি না। জাহাজ শিল্প এভাবে কাজ করে না। আর আমরাও এই ধরনের হুমকির জবাব এভাবে দেই না। আমরা আমাদের সর্বাত্বক চেষ্টা করবো এ ধরনের হামলা প্রতিহত করতে এবং নৌপথে বাণিজ্য চালু রাখতে।"
তবে অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে স্টোপার্ট এসব এলাকায় নৌবাহিনীকে আরো কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান।