লোহিত সাগরে জাহাজে হামলার ঘটনায় তেলের দাম বৃদ্ধির শঙ্কা
লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা একের পর এক হামলা করছে। এমতাবস্থায় তেলসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকেরা। কেননা বহু প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তাজনিত কারণে এই রুট দিয়ে নিজেদের শিপমেন্ট আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খবর বিবিসির।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিপিং লাইন মারস্ক গতকাল (মঙ্গলবার) জানায়, প্রতিষ্ঠানটি রুট পরিবর্তন করে আফ্রিকার কেপ অফ গুড হোপ অঞ্চলে নিজেদের কিছু জাহাজকে চলাচল করাবে।
অন্যদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে টহল দিতে লোহিত সাগরে মাল্টিন্যাশনাল রেড সি ফোর্স গঠনের ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
লোহিত সাগরের এই কোয়ালিশনে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রয়েছে বাহরাইন, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সিচেলিস ও যুক্তরাজ্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে হামলা প্রতিরোধে চীনের কাছেও গঠনমূলক ভূমিকা পালনের প্রত্যাশা করা হয়েছে। অন্যদিকে হুতি বিদ্রোহীরা এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যেকার গুরুত্বপূর্ণ শিপিং লেন বাব আল-মান্দেব প্রণালীতে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে।
হুতি বিদ্রোহীদের সিনিয়র কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল-বুখাইতি মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্স-এ বলেন, "এমনকি আমেরিকা যদি সমগ্র বিশ্বকে একত্রিত করতেও সফল হয়, তবুও আমাদের সামরিক অভিযান বন্ধ হবে না। এবার এর জন্য যতই ত্যাগ স্বীকার করতে হোক না কেন।"
এদিকে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন একটি ভার্চুয়াল মিটিংয়ে ৪০ টিরও বেশি দেশের মন্ত্রীদের সাথে কথা বলেছেন। সেখানে তিনি নিরাপত্তা নিশ্চিতে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার জন্য দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছেন।
লয়েড অস্টিন বলেন, "এই বেপরোয়া হুথি আক্রমণগুলি একটি গুরুতর আন্তর্জাতিক সমস্যা। তাই এগুলোর বিপক্ষে আন্তর্জাতিকভাবে দৃঢ় প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে।"
এদিকে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানান, যেহেতু নিরাপত্তা পরিস্থিতি অবণতির দিকে যাচ্ছে তাই রয়্যাল নেভি ডেস্ট্রয়ার এইচএমএস ডায়মন্ড নতুন টাস্ক ফোর্সে যোগ দেবে।
লোহিত সাগর তেল, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের চালানের পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যের জন্য বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুট। এটি ইয়েমেনের উপকূলের কাছে দক্ষিণে ও উত্তরে সুয়েজ খালের কাছে বাব আল-মান্দাব প্রণালী দিয়ে যুক্ত৷
এদিকে হুথিরা গাজায় চলমান যুদ্ধে ইসরায়েলের বিপক্ষে ও হামাসের পক্ষে তাদের সমর্থন ঘোষণা করেছে। আর তাই ইয়েমেনে অবস্থিত এই বিদ্রোহীরা ঐসব জাহাজগুলিকে লক্ষ্যবস্তু করছে যেগুলো ইসরায়েলের দিকে যাচ্ছে বলে তারা মনে করেছে।
ইনভেস্টর কেমিক্যাল ট্যাঙ্কারের সোয়ান আটলান্টিক জাহাজে গত সোমবার হামলা হয়েছিল। তবে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়ে, ঐ জাহাজের সাথে ইসরায়েলের কোন সম্পর্ক নেই। মূলত ড্রোন ও মিসাইলের মাধ্যমেই হুতি বিদ্রোহীরা আক্রমণ করছে বলে শিপিং ফার্মগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
এই বিষয়ে ক্যাম্পবেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেভাল হিস্টরিয়ান সাল মের্কোগ্লিয়ানো বিবিসিকে বলেন, "ব্যালিস্টিক মিসাইলগুলো সত্যিই বেশ জটিল ধরণের। এই প্রথম আমরা এমন অস্ত্র দিয়ে জাহাজগুলোকে আঘাত করতে দেখেছি। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে ভূপাতিত করা সত্যিই বেশ কঠিন।"
এমতাবস্থায় জার্মান ফার্ম হ্যাপাগ-লয়েডের আল জাসরাহ জাহাজে গত শুক্রবার হামলা করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে নতুন টাস্ক ফোর্স গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়েছে। তবে কোম্পানিটি লোহিত সাগর জাহাজের চলাচলে শতভাগ নিশ্চয়তা চেয়েছে।
এক্ষেত্রে বিকল্প পথ হিসেবে যদি কেপ অব গুড হোপ ব্যবহার করা হয় তবে আরও ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পথ বেশি পাড়ি দিতে হবে। এতে করে নিশ্চিতভাবে বাড়বে খরচ।
হ্যাপাগ-লয়েডের কর্পোরেট কমিউনিকেশনের প্রধান নিলস হাউট বিবিসিকে বলেন, "আমাদের জাহাজগুলি পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে সিঙ্গাপুরে চলাচল করি। এক্ষেত্রে সাধারণত সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে যেতে ১৩ দিন লাগে। আর খালটি ব্যবহার না করে গেলে ৩১ দিন লাগে।"
তেল রপ্তানির বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বিপি গত সোমবার জানায়, এই অবস্থা চলতে থাকলে এটি সাময়িকভাবে রুটটি দিয়ে অপরিশোধিত তেলের সমস্ত চালানকে বাধাগ্রস্ত করবে। অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী শেল এই বিষয়ে এখনও মন্তব্য করেনি।
বর্তমানে তেলের দামের পরিবর্তন খুবই অল্প পরিমাণে হয়েছে। গত সোমবার দাম মাত্র ১ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু গত মঙ্গলবার বেঞ্চমার্ক ব্রেন্ট ক্রুডের প্রতি ব্যারেলের দাম সামান্য বেড়ে প্রায় ৭৮ ডলারে দাঁড়িয়েছে।
এ সম্পর্কে আরএসি মোটরিং গ্রুপের জ্বালানী মুখপাত্র সিমন উইলিয়ামস বলেন, "লোহিত সাগর এড়িয়ে চলাচল করা ট্যাঙ্কারগুলির তেলের দাম বাড়ানোর সম্ভাবনা ছিল। তবে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম এখনও ৮০ মার্কিন ডলারের নিচে। সেপ্টেম্বরের শেষের তুলনায় যা ১৫ ডলার কম।"
সিমন উইলিয়ামস আরও বলেন, "চলমান ঘটনা জ্বালানির দামকে অবিলম্বে প্রভাবিত করবে এমন কথা বলা উচিত হবে না। কারণ আমরা এখনও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে অনেক কম দামে বিক্রি করছি। এমতাবস্থায় তাদের দাম বাড়ানোর কারণ দিতে চাই না। বিশেষ করে যখন এটি যখন বছরের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সময়।"
শিপিং সংবাদপত্র লয়েডস লিস্টের প্রধান সম্পাদক রিচার্ড মিড বিসিসিকে বলেন, "ঘটনা সত্যিই অন্যদিকে মোড় নেবে যদি ট্যাংকারগুলোর জন্য বিকল্প পথ ঠিক করা হয়। কেননা এতে করে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে তা মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।"
আর নতুন করে রুট ঠিক করতে সেটি তেল ছাড়াও অন্য পণ্য সামগ্রীতে প্রভাব ফেলবে। যেমন মিড জানান, বৈশ্বিক বাণিজ্যের শতকরা ১২ ভাগ লোহিত সাগরের মাধ্যমে যাতায়াত করে। বছরে যা প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য।
মিড বলেন, "কন্টেইনার ক্যারিয়ারগুলোর মধ্যে রয়েছে রেডিমেইড পণ্য, টিভি, ইলেকট্রনিক্স পণ্য ইত্যাদি। তারা প্রায় একচেটিয়াভাবে পুনরায় নতুন রুট খোঁজা শুরু করেছে।"
এদিকে হ্যাপাগ-লয়েড বছরের শেষ নাগাদ ২৫ টি জাহাজকে অন্য রুটে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে কয়েক মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত খরচ হবে। কেননা হামলার আগে জাহাজগুলি বুক করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে নতুন অর্ডারগুলিতেও 'সম্ভবত' খরচ বৃদ্ধি পাবে।
ইনস্টিটিউট অফ এক্সপোর্ট এন্ড ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডের মার্কো ফোরজিওনা মনে করেন, শিপিং অন্য রুটে স্থানান্তর করা হলে সেটা জ্বালানী ও বীমা খরচ বাড়িয়ে দেবে। এছাড়াও আপনি তখন দেখবেন যে, জাহাজগুলি ভুল জায়গায় রয়েছে, কন্টেইনারগুলি ভুল জায়গায় রয়েছে। একইসাথে বন্দরে যানজট ও বিলম্বের সম্ভাবনা বাড়বে।
তবে নিলস হাউট বলেন, "হ্যাঁ, আমরা চলাচলে কিছুটা ব্যাঘাত দেখতে পাব। একইসাথে আমরা বিলম্ব দেখতে পাব। কিন্তু আমি আশা করি না যে, এটি সাপ্লাই চেইনে সম্পূর্ণরুপে ব্যাঘাত ঘটাবে।"