গুজরাট দাঙ্গা: সাজাপ্রাপ্ত ১১ জনকে ফের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ ভারতের সুপ্রিম কোর্টের
২০০২ সালে ভারতের গুজরাটে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় এক গর্ভবতী মুসলিম নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত ১১ জনকে ফের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।
এর আগে তাদের যাবজ্জীবন সাজা কমিয়ে মুক্তি দিয়েছিল রাজ্য সরকার। সোমবার সেই সিদ্ধান্তকে বাতিল করে ফের তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলেন দেশটির শীর্ষ আদালত।
এই অভিযুক্তেরা সেসময় হিন্দু জনতার পক্ষ থেকে দাঙ্গায় অংশ নেয়। তারা ২১ বছর বয়সী বিলকিস বানোকে গর্ভবতী অবস্থায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে এবং তিন বছরের মেয়ে শিশুসহ তার পরিবারের ১৪ জনকে হত্যা করে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন গুজরাট রাজ্য সরকারের গঠিত একটি উপদেষ্টা প্যানেলের সিদ্ধান্তে ১৪ বছর কারাবাসের পরে ২০২২ সালের আগস্টে সাজাপ্রাপ্ত ১১ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
সোমবার ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করে দুই সপ্তাহের মধ্যে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আদালত তার রায়ে জানিয়েছেন, মহারাষ্ট্র রাজ্যে বিচার ও সাজা হওয়ায়, গুজরাট সরকারের অভিযুক্তদের ক্ষমার আদেশ পাস করার 'যোগ্যতার অভাব' রয়েছে।
আদালত ১১ জন দোষীকে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে মুক্তি দিয়ে তার বিচক্ষণ ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য গুজরাট সরকারের সমালোচনা করেছেন।
বানোর সমর্থকরা এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে।
তারা অভিযুক্তদের মুক্তিকে শুধু মুসলমানদের উপর নয়, পুরো দেশের নারী অধিকারের উপর আক্রমণ হিসেবে নিন্দা করেন।
দেশটির সরকারি তথ্যানুযায়ী, ভারতে প্রতি ১৭ মিনিটে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়।
সোমবার রায় ঘোষণার পরে বানোর আইনজীবী শোভা গুপ্তা বলেন, ''এই রায়ের মাধ্যমে আইনের শাসন পুনরুদ্ধার হয়েছে। বিলকিস ও তাদের সবাইকে অনেক অনেক অভিনন্দন, যারা তার পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং তার পক্ষে লড়াই করেছেন।''
মামলার আরেকজন বাদীর আইনজীবী অপর্ণা ভাটও এই রায়ের প্রশংসা করেছেন।
ভাট বলেন, "আমরা সত্যিই সেই বিচারকদের স্যালুট জানাই যারা আইনের পুরো বিধানকে ব্যাখ্যা করেছেন এবং স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন অভিযুক্তদের আত্মসমর্পণ করা উচিত।''
তিনি বলেন, ''এটি একটি অসাধারণ মামলা এবং সুপ্রিম কোর্টের একটি বিস্ময়কর রায়।''
২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গুজরাটে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেকার দাঙ্গার অন্যতম ভুক্তভোগী বানো।
এটি ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ ধর্মীয় দাঙ্গাগুলোর একটি। এতে এক হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়, যার বেশিরভাগই ছিল মুসলমান।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দাঙ্গার জন্য গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দায়ী নন।
বানো আদালতকে জানিয়েছিলেন, অনেক মানুষ তলোয়ার, লাঠি ও কাস্তে নিয়ে তাদের বাড়িতে হামলা করে।
আদালতের নথি অনুসারে, এক আসামি বানোর ছোট্ট মেয়েটিকে মাটিতে আছড়ে ফেলে হত্যা করে, তিনজন তাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। অন্যরা তার বোন, খালা ও তাদের মেয়েদের ওপর হামলা চালায়। বানো অচেতন হয়ে পড়েন এবং কয়েক ঘন্টা পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে উঠে দেখেন তার আশেপাশে লাশ আর লাশ।
২০০৮ সালে বিচারের পরে তার ওপর নির্যাতনকারীদের ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু ২০২২ সালের আগস্টে রাজ্য সরকার ভারতের ফৌজদারি কার্যবিধির একটি আইনের (এতে বন্দীদের ১৪ বছর কারাভোগের পরে মুক্তি দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে) অধীনে তাদের ক্ষমা করে দেয়।
এই সিদ্ধান্তের ফলে ভারতজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং কলকাতা থেকে মুম্বাই পর্যন্ত বানোর সমর্থনে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
সমালোচকেরা দাবি করেছেন, আসামিদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত রাজনীতি, নারীবিদ্বেষ ও ধর্মীয় বৈষম্যের কালিতে কলঙ্কিত।