মিয়ানমারের সামরিক জান্তা-বিরোধী থ্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্স কী?
মিয়ানমারের একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি জানিয়েছে, তারা এই সপ্তাহে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এসময় তারা সেনাবাহিনীর উপর হামলা চালায়। দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধে সেনাবাহিনীর পরাজয়ের তালিকায় যোগ হলো সফল এ অভিযানের ঘটনাটি।
চিন রাজ্যের এই পালেতোয়া শহর ভারত এবং বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি কালাদার নদীর তীরে অবস্থিত। এই শহরটি একটি মাল্টি-মিলিয়ন ডলারের বন্দর প্রকল্পের অংশ– যা ভারতের সাথে মিয়ানমারের বাণিজ্যকে সংযুক্ত করবে।
আরাকান আর্মি তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে, "পুরো পালেতোয়া এলাকায় সামরিক বাহিনীর একটি ক্যাম্পও আর অবশিষ্ট নেই।"
মিয়ানমারে প্রায় তিন বছর আগে অং সান সুচির নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী । সামরিক এই অভ্যুত্থান গণবিক্ষোভের জন্ম দিলে সেনাবাহিনী তা নৃশংসতার সাথে দমন করে। এর ফলে সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ বেছে নেয় বিক্ষোভকারীরা।
আরাকান আর্মি-সহ অন্যান্য সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর জোট– দ্য থ্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্স বা থ্রিবিএইচএ গত অক্টোবরের শেষ দিকে সেনাবাহিনীর উপর বেশকিছু উল্লেখযোগ্য হামলা চালায়। সেনাবাহিনীর ডজনখানেক ফাঁড়ি দখল করে– চীন সীমান্তের কাছাকাছি উত্তরের বেশ কয়েকটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা।
কাদের নিয়ে এই জোট ?
কয়েকটি সশস্ত্র জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত থ্রি ব্রাদারহুড জোট।
আরাকান আর্মি: ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আরাকান আর্মির যোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের আরাকানিদের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করে চলেছে তারা। বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি এই সংখ্যালঘু মুসলমান রোহিঙ্গাদের থেকেও সৈন্য নিয়োগ দিয়েছে। এই সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের উপর বর্বরোচিত হামলা চালায় সামরিক বাহিনী। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে চলছে এই গণহত্যার বিচার।
মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) : চীন সীমান্তের কাছে উত্তরে শান রাজ্যে কার্যক্রম চালায় এই গোষ্ঠীটি। হান ভাষাভাষী কোকাং জাতিগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করছে তারা।
এমএনডিএএ প্রায় ২০ বছর ধরে মিয়ানমারের শান রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে। এর আগে অঞ্চলটিতে মাদকের ব্যবসা বেড়ে গিয়েছিল। ২০০৯ সালে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির উত্থানের পর, অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সামরিক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ শুরু হয় এমএনডিএএর। এই অঞ্চলটি মানবপাচার এবং অনলাইন জালিয়াতির জন্য কুখ্যাত। ২০০৯ সালে নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর, এমাসের শুরুতে অনলাইন জালিয়াতির প্রধান কেন্দ্র লাউকাইয়ের নিয়ন্ত্রণ পুনরায় নিয়েছে এমএনডিএএ।
তাং' আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) : টিএনএলএ হলো পালাউং সেলফ লিবারেশন ফ্রন্টের সশস্ত্র শাখা। রাজনৈতিক সংগঠন পালাউং সেলফ লিবারেশন ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা করেছেন টার আইক বং এবং টার বোন কিআউ। তারা দুজনেই তাং'আং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রাক্তন যোদ্ধা। ১৯৯২ সালে নতুনভাবে জন্ম নেয় সংগঠনটি। তারা মায়ানমারের প্রকৃত কেন্দ্রীয় শাসনের জন্য লড়াই করছে বলে দাবি করে। সংগঠনটি দাবি করে, তাদের পাঁচ হাজারের বেশি যোদ্ধা রয়েছে।
জোটের সামরিক ইতিহাস
২০১৯ সালে এই তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠী একত্রিত হয়ে জোট গঠন করে। প্রথমে এমএনডিএএ এবং আরাকান আর্মির শক্তিশালী ঘাটি শান এবং রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর উপর তারা হামলা চালায়। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের হত্যার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে জোটটি। এই জোট এপর্যন্ত ছোট-বড় অনেক আক্রমণ চালিয়ে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বেশকিছু অঞ্চল। পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) প্রতিষ্ঠা করেছিল ন্যাশনাল ইউনিটি গভার্নমেন্ট (এনইউজি)। এটি অভ্যুত্থানের পর বেসামরিক প্রশাসন হিসেবে কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং দক্ষিণ কোরিয়াতে কার্যালয় রয়েছে এনইউজির। পিডিএফ এবং এনইউজির সাথে সম্পৃক্ততা রয়েছে সশস্ত্র জোট থ্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্সের (থ্রিবিএইচএ)।
২০২১ সালে থ্রিবিএইচএ, নাকফান শহর থেকে সরকারি বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর ১০ হাজার যোদ্ধা নিয়ে শান অঞ্চলের পুলিশ এবং সরকারপন্থী মিলিশিয়া বাহিনীর অবস্থানগুলোতে হামলা চালায় তারা। প্রায় ১০০ এর উপরে সামরিক ঘাঁটি ধবং বা দখল করে তারা। চীন সীমান্তের কাছাকাছি চিন সো হাও এবং মাঙ কো, শহরগুলো নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে জোটটি। এছাড়াও গোষ্ঠীটি হোপায়াং হিসেং, পাং হিসেং এবং হোসেনউই গ্রামও দখল কিরেছে বলে দাবি করেছে।
এদিকে শান প্রদেশের সবচেয়ে বড় শহর– লাশিওতে, চীন এবং মায়ানমারের মধ্যকার সংযোগকারী রাস্তা এবং সেতু দখল করেছে এই সশস্ত্র গোষ্ঠী।
অপারেশন ১০২৭, মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে নতুন গতি এনেছে। গত নভেম্বরে, মধ্য মিয়ানমারের কাউলিন শহরে সামরিক বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে পিডিএফ নিয়ন্ত্রণ নেয় অঞ্চলটির।
তবে, সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান-বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে নির্বিচারে বিমান হামলা করছে, এবং অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে শক্তিশালী প্রতিরোধও তৈরি করেছে। খাদ্য, অর্থ তহবিল, বুদ্ধিমত্তা এবং সৈন্য নিয়োগ, এই চার বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি বাধা সৃষ্টি করে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার।
এর ফলে গত ২৬ অক্টোবর থেকে ৮ডিসেম্বর পর্যন্ত নতুনভাবে প্রায় ৫৭ হাজার ৮০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এছাড়া এই সংঘাত চলাকালে প্রায় ২০ লাখ মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। গত অক্টোবর থেকে এপর্যন্ত প্রায় ৩৬৩ জন সাধারণ নাগরিক মারা গেছেন এবং ৪৬১ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
অপারেশন ১০২৭ থেকে ধারণা করা হয়, সশস্ত্র জোটটির পেছনে চীনের সমর্থন রয়েছে।
মিয়ানমারে চলামান যুদ্ধ পরিস্থিতি, দেশটির বাণিজ্য খাতকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে এবং হাজার হাজার শরণার্থীকে চীনের ইউনান প্রদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। এ অবস্থায় বেইজিং, মিয়ানমারের সরকার এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সক্রিয় এমএনডিএএ'র মধ্যে শান্তিচুক্তির উদ্যোগ নেয়। গত ১২ই জানুয়ারি, সামরিক সরকার এবং সশস্ত্র জোটের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য মধ্যস্থতা করেছে বলে জানিয়েছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।