কাশ্মীরে বিরল তুষারবিহীন শীত, দিচ্ছে অশনি সংকেত
১৭ বছর ধরে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ছবির মতো শহর গুলমার্গে একটি হোটেল চালাচ্ছেন মনজুর আহমদ। এই সতেরো বছরে তুষারপাত ছাড়া কোনো শীত কাটতে দেখেননি তিনি।
কিন্তু এ বছর অবস্থা একেবারেই অন্যরকম—অন্যবার এ অঞ্চলের তুষারাবৃত পর্বতগুলো এবার বেখাপ্পা রকমের বাদামি ও ন্যাড়া।
এই ঘটনাকে 'নজিরবিহীন' আখ্যা দিয়ে ৫০ বছর বয়সি মনজুর জানালেন, পর্যটকরা তার হোটেলে রিজার্ভেশন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
প্রতি বছর স্কি করতে এবং নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করতে হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমায় কাশ্মীরে। কিন্তু এ বছর তুষারপাত না হওয়ায় হোঁচট খেয়েছে এ অঞ্চলের পর্যটন খাত।
গত বছরের জানুয়ারিতে প্রায় ১ লাখ পর্যটক কাশ্মীর ভ্রমণ করেছিলেন। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারিতে সেই সংখ্যা অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুষারবিহীন শীত এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলবে। কারণ জম্মু-কাশ্মীরের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৭ শতাংশ। এছাড়া তুষার না পড়ায় ভূগর্ভস্থ পানির মজুত ফের পূরণ না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষি এবং পানি সরবরাহও।
পরিবেশবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলে, এতে দেখা যাচ্ছে বৈরী আবহাওয়া—শীত ও গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমেই দীর্ঘ সময় বৃষ্টিপাতবিহীন থাকতে হচ্ছে। জম্মু ও কাশ্মীরের আবহাওয়ার বিভাগের তথ্য বলছে, ডিসেম্বরে ৭৯ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে ১০০ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে এ অঞ্চলে।
এ উপত্যকার আবহাওয়াও উষ্ণ হয়ে উঠেছে। চলতি শীতে কাশ্মীরের অধিকাংশ স্টেশনে তাপমার ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়ার বৃদ্ধির রেকর্ড করা হয়েছে।
হোটেল মালিকরা জানাচ্ছেন, পর্যটকরা রিজার্ভেশন বাতিল করছেন। এছাড়া স্কি করতে না পারা কিংবা স্লেজে চড়তে না পারায় জম্মু-কাশ্মীরে এসেও ফিরে গেছেন অনেক পর্যটক।
গুলমার্গ হোটেলিয়ার্স ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আকিব ছায়া বলেন, '৪০ শতাংশের বেশি হোটেল রিজার্ভেশন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, নতুন বুকিংও বন্ধ আছে।'
মহারাষ্ট্র থেকে সপরিবারের প্রথমবারের মতো কাশ্মীরে বেড়াতে এসেছিলেন রাজকুমার। কিন্তু এখানে এসে তারা হতাশ হয়েছেন বলে জানালেন।
রাজকুমার বলেন, 'আমরা এখানে এসেছিলাম তুষারপাত দেখতে আর ক্যাবল কারে চড়তে…কিন্তু বরফবিহীন গুলমার্গ দেখে আমরা হতাশ।'
পর্যটক কমে যাওয়ার ধাক্কা লেগেছে স্থানীয় ব্যবসায়। শীতের সময় টিকে থাকতে স্থানীয় ব্যবসার বড় একটা পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল।
গুলমার্গের টাট্টু ঘোড়া সমিতির প্রধান তারিক আহমদ লোনি বলেন, গত তিন মাসের তাদের তেমন আয়-রোজগার হয়নি। টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে এ অঞ্চলের চড়াই-উৎরাইয়ে ঘুরে বেড়ানো পর্যটকদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়।
তারিক বলেন, 'আমাদের জীবিকা নির্ভর করে তুষারের ওপর। তুষারবিহীন মৌসুম আমাদের সবার পরিবারে দুঃখ-কষ্ট ডেকে আনবে।' অধিকাংশ টাট্টু ঘোড়ার মালিক কয়েক দশক ধরে এ পেশার সঙ্গে যুক্ত বলে তাদের পক্ষে অন্য পেশায় যাওয়াও সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
তারিক আহমদের মতো একই হতাশার প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল গুলমার্গের স্কি অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান শওকত আহমদ রাথারের কথায়ও।
তিনি বলেন, 'গত ২৭ বছর ধরে আমি স্কি ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছে। আমি তো অন্য পেশায় যেতেও পারব না।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুষারপাত না হওয়ার কারণে পর্যটন খাত ছাড়াও জলবিদ্যুৎ ও মাছ উৎপাদনের পাশাপাশি চাষাবাদও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জম্মু-কাশ্মীরের পাশের এলাকা আরেক জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা লাদাখ। সেখানেও চলতি শীতে তুষার পড়েনি।
পরিবেশবিদ সোনম ওয়াংচুক বলেন, 'এখানকার কৃষিকাজ হিমবাহের ওপর নির্ভরশীল। হিমবাহ দ্রুতগতিতে গলছে। ভরা [শীত] মৌসুমেও কোনো তুষারপাত না হওয়ার অর্থ হচ্ছে বসন্তের সময় পানি বড় সমস্যা হবে।'
লেহ-এর মেটেওরোলজিক্যান সেন্টার-এর পরিচালক সোনম লোটাস বলেন, 'এটাই এই হিমালয়ান অঞ্চলের অন্যতম শুষ্ক সময়।'
ভরা শীতের সময় এ অঞ্চলে সাধারণত তীব্র তুষারপাত হয়। ২১ ডিসেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত এই ৪০ দিন এ অঞ্চলে ভরা শীতের সময়। এই সময় পাহাড়-পর্বত ও হিমবাহ ধবধবে সাদা তুষারে ঢেকে যায়। এই বরফ সারা বছরের পানি সরবরাহ নিশ্চিত করে।
কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চলে তুষারপাত কমে আসছে।
ভূবিজ্ঞানী শাকিল আহমদ রমশু বলেন, '১৯৯০-এর দশকের আগে আমরা তীব্র তুষারপাত দেখতাম। ৩ ফুট পুরু হয়ে তুষার পড়ত। বসন্তের আগে সেই বরফ গলত। কিন্তু এখন আমরা উষ্ণ শীতকাল দেখছি।'
তিনিসহ আরও অনেকেই বিশ্বাস করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের 'ধাক্কা' সইছে কাশ্মীর।
'অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় আমাদের মাথাপিছু গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ অনেক কম। কাশ্মীরের মানুষ একেবারেই সাদামাটা, বাহুল্যবর্জিত জীবন যাপন করে। আমরা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ভুক্তভোগী,' বলেন তিনি।
শাকিল ও তার দলের এক গবেষণা বলছে, চলতি শতাব্দীর শেষদিকে লাদাখসহ এ অঞ্চলের তাপমাত্রা 'বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মাত্রায়' পৌঁছে যেতে পারে। শতাব্দী শেষে এ অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়তে বাড়ে ৩.৯৮ থেকে ৬.৯৩ ডিগ্রি সেলসিয়া।
এদিকে স্থানীয় অধিবাসীরা চলতি শীতে অলৌকিকভাবে তুষার পড়ার জন্য প্রার্থনা করছে।
আবহাওয়া বিভাগ অবশ্য ২৪ জানুয়ারির আগে ভারী তুষারপাতের পূর্বাভাস দেয়নি।