‘পছন্দের খেলার মাঠ’: ইরাক থেকে মার্কিন সেনা খেদানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান!
গত বছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভা। এতে যোগ দিতে নিউইয়র্কে আসেন ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-সুদানি। তখন ইরাকের ওপর সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী দুই বিদেশি শক্তি– ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নাজুক এক সন্ধি ধরে রাখার চেষ্টা ছিল।
ইরাকের ইরান সমর্থিত আধা-সামরিক বাহিনীগুলো তখন দেশটিতে অবস্থান করা মার্কিন সেনাদের ওপর হামলা বন্ধ রেখেছিল। বৈরী দুই পক্ষের এই অঘোষিত সন্ধির মধ্যেই নিউইয়র্কে পৌঁছান ইরাকি নেতা। জালানি-তেল সমৃদ্ধ হলেও কয়েক দশকের যুদ্ধ-সংঘাতে বিপর্যস্ত ইরাকি অর্থনীতি, তাই সাধারণ পরিষদের সম্মেলনের সাইডলাইনে নতুন বিনিয়োগ পেতে আল-সুদানি পশ্চিমা ব্যবসায়ী ও কূটনীতিকদের সাথে বৈঠক করেন।
এরপর কেটে গেছে চার মাস। ইরাকি প্রধানমন্ত্রী এখন তাঁর দেশে মারাত্মক হামলা চালানোর জন্য ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই সমালোচনা করছেন। এমনকী সাম্প্রতিক সময়ে, সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে দেওয়া বক্তব্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ইরাক ত্যাগ করার দাবি জানান।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে সফল এক সামরিক অভিযান চালায় গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ করা হামাস। এরপরেই শুরু হয় রক্তস্নাত এক যুদ্ধ। যেখানে নির্বিচার ইসরায়লি হামলায় নিহত হচ্ছেন হাজারো ফিলিস্তিনি।
হামাসের প্রতি তেহরানের রয়েছে অটুট সমর্থন। অন্যদিকে, ওয়াশিংটন সমর্থন করছে ইসরায়েলকে। এই প্রেক্ষাপটে ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইরাকে অবস্থান করা মার্কিন সেনাদের ওপর অন্তত ৭০টি হামলা চালিয়েছে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়ারা।
চলতি জানুয়ারিতে এসব হামলার সবচেয়ে শক্তিশালী পাল্টা-আঘাত হেনেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাগদাদে চালানো ওই ড্রোন হামলায় নিহত হন পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিটের সিনিয়র কমান্ডার মুশতাক তালেব আল-সাইদি। ইরাকের রাষ্ট্রীয় অর্থায়নপুষ্ট ও ইরান সমর্থিত সশস্ত্র শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর এটি মূল সংগঠন।
বাগদাদে এই হামলা ছিল ইরাকের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র সদম্ভে এই হামলার দায় স্বীকার করার কয়েক ঘণ্টা পরেই – ইরানও একই কাজ করে বসে। ইরানি মিসাইল আঘাত হানে ইরাকের ইরবিল শহরে। এতে ধনকুবের এক কুর্দি আবাসন ব্যবসায়ী ও তাঁর শিশু কন্যাসহ নিহত হন অন্তত চারজন।
ইরান দাবি করে, তারা মোসাদের একটি গোয়েন্দা কার্যালয় ধবংস করেছে। তবে এই দাবিকে নাকচ করে দেয় বাগদাদ। ডাভোসে ইরানের হামলাকেও 'সুস্পষ্ট আগ্রাসন' বলে নিন্দা জানান আল-সুদানি। ইরাক তেহরান থেকে তাঁদের রাষ্ট্রদূতকেও প্রত্যাহার করে, এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এনিয়ে অভিযোগ করবে বলেও জানায়।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের পক্ষ থেকে ইরাকের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘনের দুটি ঘটনাই প্রমাণ করেছে, ইরাককে নাজুক এক ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হচ্ছে। দিন দিন তা আরো কঠিন হয়েও পড়ছে, কারণ ভূমধ্যসাগর তীরে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার সীমানা পেরিয়ে উত্তেজনা ক্রমে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
পুরো অঞ্চলজুড়ে পেশিশক্তির প্রদর্শন করছে তেহরান ও ওয়াশিংটন। দিচ্ছে একে-অন্যকে মোকাবিলার কঠোরতর হুমকি, যা ভয়াল এক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। উভয়পক্ষের মধ্যে চলমান প্রক্সি লড়াই একারণেই স্থানীয় ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার বিভিন্ন দিকও সামনে আনছে।
যেমন লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ ঠেকাতে কূটনৈতিক চেষ্টা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে উভয়পক্ষই বৃহত্তর এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা করছে।
অন্যদিকে, ইসারায়েলি গণহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়ে ইসরায়েল-সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচলে বাধ সাধায়– যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে ইয়েমেনের হুথিরা। বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর তাদের হামলা ঠেকাতে ইয়েমেনে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
তবে সংঘাতের এই চরিত্র– সবচেয়ে তীব্র ও জটিল ইরাকের মাটিতে।
যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত থিঙ্ক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউজের ইরাক ইনিশিয়েটিভ এর পরিচালক রিনাদ মনসুর বলেন, "ইরাকের সরকার দুর্বল, বিভাজিত এবং কার্যত নিজ দেশের সীমানার মধ্যেই বিদেশি শক্তিদের দ্বারা সংঘটিত কোনো সংঘর্ষ ঠেকানোর ক্ষমতা রাখে না। ইরাক হয়ে উঠেছে এসব বহিঃশক্তির পছন্দের খেলার মাঠ। কারণে, এখানে একে-অন্যের বিরুদ্ধে করা হামলা থেকে তাদের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত কম। পাশাপাশি তারা এই শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতাও করছে।"
ইরাক হারালে, হাতছাড়া হতে পারে সিরিয়া
ইরাকের সরকারে ইরান সমর্থিত বা তার স্থানীয় মিত্রদের আধিপত্য আছে। গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তাঁরা ইরাক থেকে মার্কিন সেনা হটানোর এক দারুণ উপলক্ষ্য পেয়ে গেছে।
সাবেক একজন মার্কিন কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে বলেন, এই লক্ষ্য অর্জনে (ইরাকের) ইরান-সমর্থিত মিশিলিয়া গোষ্ঠীগুলোর সাথে লেবাননের হিজবুল্লাহ'র সমন্বয় জোরালো হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সংবাদ অনুযায়ী, ইরাকি মিলিশিয়াদের সামরিক তৎপরতার সার্বিক তদারকি করতে চলতি মাসের শুরুতেই বাগদাদে এসেছে হিজবুল্লার একজন শীর্ষ কর্মকর্তা।
হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সাবেক মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পরিচালক আন্ড্রু ট্যাবলার বলেন, "ইরাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সরাসরি ইসরায়েলে আক্রমণ করার পরিবর্তে– মিলিশিয়ারা মার্কিন বাহিনীর উপরেই বেশি হামলা করছে।"
ইরাক সরকারের ওপরও মার্কিন বাহিনী বহিষ্কারের চাপ বাড়ছে। মুশতাক তালেব আল-সাইদির হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ইরাকি জনগণও জোরেশোরে এই দাবি তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী আল-সুদানি যদি তা মেনে নেন, তাহলে সেটা হবে ইরানের জন্য বড় কৌশলগত জয়। এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইরাকি সেনাদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিতে দেশটিতে প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। তাঁদের মূল ঘাঁটিগুলো– বাগদাদ এবং উত্তর ইরাকের স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি অঞ্চলে অবস্থিত। কুর্দি অঞ্চলের ঘাঁটিতে রয়েছে ৯০০ এর মতো মার্কিন সেনা। স্থলপথে উত্তরপূর্ব সিরিয়ায় থাকা মার্কিন সেনাদের রসদ সরবরাহের জন্য এই অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
তাছাড়া, সিরিয়ায় মার্কিন সেনাদের অবস্থান করার আইনি ভিত্তিও ওয়াশিংটন পেয়েছে বাগদাদের সাথে একটি সমঝোতার মাধ্যমে। ফলে ইরাক থেকে বিতারিত হলে– সিরিয়ার ভূখণ্ড দখলে রাখারও কোনো বৈধ যুক্তি অবশিষ্ট থাকবে না আমেরিকানদের।
ট্যাবলার বলেন, সিরিয়ায় মার্কিন সেনাদের সমর্থন দেওয়ার জন্য ইরবিল (ইরাকি কুর্দিস্থানের প্রাদেশিক রাজধানী) অপরিহার্য। ইরাক থেকে স্থলপথে সিরিয়ায় সেনা ও রসদ সরবরাহের জন্যই তার দরকার আছে যুক্তরাষ্ট্রের।"
তবে সুদানির বক্তব্য ওয়াশিংটনের উদ্বেগকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার ডাভোসে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী বলেন, "ইরাকি জনগণের জন্য আর হুমকি নয় আইএসআইএস... তাই ইরাকের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থেই আন্তর্জাতিক জোট বাহিনীর মিশন শেষ হওয়া দরকার।"
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখন উপায়- ইরাককে অর্থ সাহায্য দিয়ে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা। কিন্তু, আল-সুদানি যে প্রচণ্ড চাপের মুখে রয়েছেন তাতে তিনি এই প্রস্তাব গ্রহণ করলে ইরাকের ঘরোয়া রাজনীতিতে আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে তিনি সেই ঝুঁকি নেবেন কিনা- সেটিই এখন দেখার বিষয়।