ইসরায়েলকে গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড রোধে ব্যবস্থার নির্দেশ আইসিজে’র, যুদ্ধবিরতির কথা নেই রায়ে
আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ইসরায়েলকে গাজায় গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড [অ্যাক্টস অভ জেনোসাইড] প্রতিরোধ করতে দেশটির ক্ষমতার মধ্যে থাকা সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
আদালত তার রায়ে বলেন, ইসরায়েলকে নিশ্চিত করতে হবে যেন তার বাহিনী গণহত্যা না চালায় এবং কথিত গণহত্যার প্রমাণ সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়া গণহত্যার প্রত্যক্ষ উসকানি প্রতিরোধ এবং এ ধরনের উসকানির জন্য শাস্তির ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দেন বিচারক।
শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) এ রায় ঘোষণার সময় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের ১৭ জন বিচারকের মধ্যে ১৬ জন আদালতের উপস্থিত ছিলেন।
আল জাজিরা জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক এ আদালত ইসরায়েলকে গাজা উপত্যকায় মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করার নির্দেশ দিলেও কোনো ধরনের যুদ্ধবিরতির আদেশ দেননি।
ইসরায়েল গাজায় গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে তার ক্ষমতার মধ্যে থাকা সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ পালনের জন্য কী করছে — তা এক মাসের মধ্যে আদালতকে জানাতেও দেশটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
আইসিজে প্রেসিডেন্ট, বিচারক জোন ডনাহিউ বলেন, আদালতের এই রায় ইসরায়েলের জন্য আন্তর্জাতিক আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছে।
রায় পড়ার সময় আইসিজে প্রেসিডেন্ট বলেন, আদালত ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দেন।
আদালত বলেন, গাজা উপত্যকায় জরুরিভাবে প্রয়োজনীয় মৌলিক পরিষেবা এবং মানবিক সহায়তার ব্যবস্থা করতে ইসরায়েলকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আইসিজে প্রেসিডেন্ট বলেন, গণহত্যার এ মামলার জন্য বিতর্কিত যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। গাজায় গণহত্যার জন্য ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করে করা মামলাটি আদালত বাদ দিয়ে দেবেন না।
এ বিচারক আরও বলেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আনা কিছু অভিযোগ জেনোসাইড কনভেনশনের বিধানের মধ্যে পড়ে।
বিচারক বলেন, আদালত দেখেছে, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের ফলে প্রচুর মৃত্যু এবং আহত হয়েছে। সেইসঙ্গে এ অভিযানের কারণে ব্যাপকভাবে বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে, জনসংখ্যার বিশাল অংশ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং বেসামরিক অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
জোন ডনাহি জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মার্টিন গ্রিফিথসের একটি বিবৃতি উদ্ধৃত করে আরও বলেন, 'গাজা একটি মৃত্যুপুরী ও হতাশার স্থানে পরিণত হয়েছে'।
আদালতের রায়ের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এটি আইসিজে'র আদেশকে স্বাগত জানিয়েছে। এ আদেশগুলোকে কোনো রাষ্ট্রই আইনের ঊর্ধ্বে নয় তার 'গুরুত্বপূর্ণ অনুস্মারক' বলে অভিহিত করেছে মন্ত্রণালয়।
এদিকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক ভিডিওবার্তায় বলেছেন, ইসরায়েলের এ যুদ্ধ 'একটি অন্যতম ন্যায়যুদ্ধ'।
তিনি আরও বলেন, ইসরায়েল দেশ আন্তর্জাতিক আইন মেনে নিজেকে এবং তার নাগরিকদের রক্ষা করতে থাকবে।
আইসিজে-তে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়। সেখানে তেল আবিবের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যার অভিযোগ আনে দেশটি।
দক্ষিণ আফ্রিকা এ রায়কে আন্তর্জাতিক আইনের শাসনের জন্য 'নির্ধারণকারী বিজয়' বলে অভিহিত করেছে।
আইসিজেকে দ্রুত রায়ের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে দেশটির সরকার বলেছে, এটি অস্থায়ী ব্যবস্থাকে স্বাগত জানায়। দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তরিকভাবে আশা করে যে ইসরায়েল আদালতের আদেশ পালনে অনীহা দেখাবে না
প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এটি আরও বলেছে, এ রায়টি ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
হামাসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সামি আবু জুহরি আদালতের সিদ্ধান্তকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে অভিহিত করে বলেন এ রায় ইসরায়েলকে বিচ্ছিন্ন করতে এবং গাজায় তাদের অপরাধ প্রকাশে অবদান রাখবে।
তিনি রয়টার্সকে বলেন, 'আদালতের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আমরা দখলদারদের [ইসরায়েল] বাধ্য করার আহ্বান জানাই।'
এ মামলায় শুনানি শুরু হয় গত ১১ জানুয়ারি। যদিও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এই অভিযোগকে মিথ্যা আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিযোগ করে, দক্ষিণ আফ্রিকা 'ইসরায়েল রাষ্ট্রকে ধ্বংসের' আহ্বান জানাচ্ছে। একইসঙ্গে দেশটির আনা গণহত্যার অভিযোগের 'বাস্তব ও আইনগত ভিত্তি' উভয়ই নেই বলে মন্তব্য করে ইসরায়েল।
অন্যদিকে আইসিজে-কে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ থেকে গাজায় ফিলিস্তিনিদের অধিকারকে 'আসন্ন অপূরণীয় ক্ষতির হাত থেকে' রক্ষা করার জন্য 'অস্থায়ী ব্যবস্থা' গ্রহণ করতে অনুরোধ করা হয়।
ইসরায়েল গণহত্যার বিরুদ্ধে থাকা ১৯৪৮ সালের কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ। এতে গণহত্যাকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলোকে এটি প্রতিরোধে বাধ্য করার কথা বলা হয়েছে।
আইসিজে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত। নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে এটি অবস্থিত। এর রায়গুলো তাত্ত্বিকভাবে আদালতের পক্ষগুলোর জন্য আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক; যার সদস্য হিসেবে রয়েছে ইসরায়েল ও দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে আদালত এটি পালন করতে দেশগুলোকে বাধ্য করতে পারে না।
২০২২ সালে আদালতটির পক্ষ থেকে রাশিয়ায় প্রতি ইউক্রেনে দ্রুত সামরিক কার্যক্রম বন্ধের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটিকে তোয়াক্কা করেনি মস্কো।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি)-এর মতো আইসিজে গণহত্যার অপরাধের জন্য ব্যক্তির বিচার করতে পারেন না। তবে এর মতামত জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে।