মিয়ানমারজুড়ে বিদ্রোহীদের হামলা, রাখাইনের উপকূলীয় শহরের দখল নিয়ে তীব্র লড়াই
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উপকূলীয় রামরি শহরে দেশটির সরকারি জান্তা বাহিনীর ওপর হামলা করছে আরাকান আর্মি (এএ)।
তাদের প্রতিহত করতে জান্তা বাহিনীর বিমান ও গানবোট থেকে রামরি শহর ও আশপাশের গ্রামগুলোতে বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে। এতে শহরের আট হাজার বাসিন্দার বেশিরভাগই বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অনেক বাড়িঘর, স্কুল, বাজার ও একটি হাসপাতাল ধ্বংস হয়ে গেছে বলে স্থানীয়রা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
আরাকান আর্মি ও স্থানীয় বাসিন্দারা সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে শহরটিতে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করার দাবি করলেও– জান্তা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, সরকারের পালটা হামলা ও বিমান হামলার কারণে আরাকান আর্মি হেরে যাচ্ছে।
গত তিন দিনে, রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বেশিরভাগ ঘাঁটি আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে। এপর্যন্ত সংঘাতে জান্তা বাহিনীর অন্তত ৬২ জন সৈন্য নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) এবং সশস্ত্র সংগঠনগুলো (ইএও) মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চল ও রাজ্য, সাগাইং, মগওয়ে এবং মান্দালয় অঞ্চলের পাশাপাশি কাচিন ও কারেন রাজ্যে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে তাদের হামলা জোরদার করার কারণে এই হতাহতের ঘটনা ঘটছে।
সংঘাতের বর্তমান অবস্থা
সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি তাদের আক্রমণ জোরদার করায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী একাধিক অঞ্চলে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। মিয়ানমার সরকার পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) থেকে সাগাইং অঞ্চলের শোয়ে পাই আয়ে শহর পুনর্দখলের চেষ্টা করলেও– দশ দিন পর অভিযান ত্যাগ করতে বাধ্য হয় তারা। সংঘাতে জান্তা সেনাদের মধ্যে ১৫ জন নিহত এবং ৪০ জন আহত হয়েছে।
মগওয়ে অঞ্চলেও একই ধরনের সংঘাতের খবর পাওয়া গেছে। ইয়েসাগিও পিডিএফ জান্তা বাহিনীর উপর ড্রোন হামলা চালিয়েছে এবং বাড়িঘর লুট করেছে, এতে দুজন নিহত এবং ছয়জন আহত হয়েছে।
মান্দালয় অঞ্চলে, মিংইয়ান ব্ল্যাক টাইগার পিডিএফ একটি সামরিক ট্রাকে অতর্কিত হামলা চালালে দুই সরকারি সেনা নিহত হয়।
এছাড়া, কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ) কাচিন রাজ্যের হপাকান্ত টাউনশিপে একটি জান্তা ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে, এতে আট জান্তা সেনা নিহত হয়েছে।
পিডিএফ এবং কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (কেএনএলএ) যোদ্ধারা কারেন রাজ্যের থানডাংগি টাউনশিপে মাইন লুইন জান্তা ঘাঁটি দখল করে, ২০ জনেরও বেশি জান্তা সৈন্যকে হত্যা করেছে।
সংঘাতের শুরু কবে?
থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অংশ আরাকান আর্মি, গত বছর ২৭ অক্টোবর থেকে অপারেশন ১০২৭ নামে জান্তাবিরোধী অভিযান শুরু করেছে। অভিযানে এ পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের প্রায় ২০টি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। ১৩ নভেম্বরে বিদ্রোহী এ বাহিনী রাখাইন রাজ্যে হামলা শুরু করে। আরাকান আর্মি দাবি করছে, সরকারি বাহিনীর ভারী সমরাস্ত্র ও বিমান হামলার মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও তারা মিনবায়া টাউনশিপে অবস্থিত একটি লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নের সদর দফতর, রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিতওয়ের নিকটবর্তী পাউকতাও শহর এবং প্রতিবেশী চিন রাজ্যের পালেতওয়া টাউনশিপসহ ১৬০টিরও বেশি সামরিক অবস্থানের দখল নিয়েছে।
আর উত্তর রাখাইন রাজ্যের মিনবায়া, ম্রাউক ইউ, কিয়াউকতাও এবং রাথেডং টাউনশিপে অবশিষ্ট সব সামরিক সদর দফতর দখলে তাদের প্রচেষ্টা চলমান বলে জানিয়েছে তারা।
সীমান্তের এ পাড়ে কী অবস্থা?
মিয়ানমারে সরকারি ও বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে সংঘাতের আঁচ মিয়ানমারের সীমান্ত ছাপিয়ে বাংলাদেশে এসেও পড়েছে। মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে ঘুমধুম সীমান্তের জলপাইতলীর বাসিন্দা হোসনে আরাসহ (৬০) দুজন নিহত হয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, গত শনিবার রাত ৩টায় ঢেঁকিবনিয়ার পাশে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) তুমব্রু রাইট ক্যাম্প দখলকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে গোলাগুলি শুরু হয়। তুমব্রু রাইট ক্যাম্প সীমান্তচৌকিটি বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার লোকালয়ের খুব কাছাকাছি।
ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি থেকে বাংলাদেশের লোকালয়ের দূরত্ব প্রায় ৮০০ মিটার। এ কারণে তুমব্রু রাইট ক্যাম্পে গোলাগুলির সময় বাংলাদেশের বসতঘরে গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়েছে।
এছাড়া, সংঘর্ষের জেরে রবিবার সকাল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত বিজিপির ৯৫ জন সদস্য অস্ত্রসহ তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বিজিবি তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছে এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চলতি সপ্তাহে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে জানানো হয়, রাখাইনের লড়াই নির্ধারণ করবে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে জয়া-পরাজয়। আরাকান আর্মি এই রাজ্যের দখল নিতে মরণপণ লড়বে, অন্যদিকে জান্তারও পিছু হঠার উপায় নেই। কারণ, রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ হারালে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে বিদ্রোহ দমন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে, যেখানে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স বা পিডিএফের যোদ্ধারা বেশি সক্রিয়। মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার জাতিগোষ্ঠীর গণতন্ত্রকামীদের দ্বারা গঠিত এই বিদ্রোহী বাহিনী সেনা শাসনের অবসান চায়। এজন্য তাঁরা জাতিগত বিদ্রোহী দলগুলোর থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
ইরাবতীর একাধিক প্রতিবেদন থেকে সংকলন ও অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবণ