জেফ বেজোস কেন সবসময় সবার শেষে কথা বলেন (আপনারও তা-ই করা উচিত?)
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, নেতা হিসেবে আপনি কখন কথা বলছেন তার উপর নির্ভর করে অনেক কিছু। তথ্য-উপাত্ত, যুক্তি-তর্ক কিংবা বিশ্লেষণ; সবকিছুর ওপর ভিত্তি করেই আমরা সামাজিক জীব। আমরা একে অপরের সাথে মিলে মিশে থাকতে চাই। একসাথে ঘুরে বেড়াতে চাই।
তাহলে ঠিক কীভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের সর্বকনিষ্ঠ বা সবচেয়ে অনুজ ব্যক্তিটি সবচেয়ে ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির সাথে কোনো অস্বস্তি ছাড়া দ্বিমত পোষণ করবে?
লেক্স ফ্রিডম্যানের পডকাস্টে জেফ বেজোস সম্প্রতি বলেছেন, "আমি প্রতিটা মিটিং এ সবসময় শেষে কথা বলি। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমি যদি আগে কথা বলি তাহলে সভায় উপস্থিত অনেক বলিষ্ঠ, উচ্চ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন এবং খুবই বিচক্ষণ ব্যক্তিটিও ভাবতে পারে যে, তিনি যা ভেবে মিটিং এ এসেছিলাম তা বোধহয় ভুল।"
আপনি যদি কোথাও সবচেয়ে ঊর্ধ্বতন বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি হন তাহলে আপনার উচিত হবে সবার শেষে কথা বলা। অন্য সবাইকে আগে কথা বলার সুযোগ করে দিন। সবচেয়ে ভালো হয় যদি সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি সবার আগে বলবে এবং ক্রমেই ওপরের দিকে উঠতে থাকবে। এতে করে সবাই সবার আসল মতামত জানানোর সুযোগ পায়।
আপনি যে ব্যক্তিকে আসলেই সম্মান করেন, তিনি যদি কিছু বলেন তা আপনার মতামত কিছুটা হলেও পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে।
আপনার মাথায় যদি কোনো চিন্তা আসে কিংবা আপনি কোনো কিছুর সমাধান করতে পেরেছেন বলে মনে করেন- আপনি সরাসরি তা প্রকাশ না করলেও, কোনো জানা বা মূল কিছু প্রশ্ন করা সহজ হয়। তবে কোনো বিষয়ে নিজের কোন ধারণা আগেই থেকে থাকলে অন্য কারো কোনো কথা শোনাও কঠিন হয়ে যায়।
সাইমন সিনেকের মতে, অন্য সবার কথা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের মতামত না বলার মত দক্ষতা বা নৈপুণ্যতা থাকা প্রয়োজন। এতে করে দুটি জিনিস হয়ে থাকে।
প্রথমত, এতে করে প্রত্যেকের কথা শোনা হয়েছে বলে তারা মনে করে। তারা মনে করেন, কোনো কিছুর সমাধানে তারা অবদান রাখতে পেরেছেন।
দ্বিতীয়ত, সবার মতামত শোনার পর নিজের চিন্তাকে আরও পরিশোধিত/পরিশুদ্ধ করার সুবিধা পাওয়া যায়। দক্ষতা এটাই যে, নিজের মতামতকে নিজের কাছে রাখা।
বিজ্ঞানও তাই মনে করে। ২০১৩ সালের 'সায়েন্স' এ প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রে এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়। প্রথমত, মতামত পরবর্তীতে আসা মতামতকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে। গবেষকেরা একে 'পঞ্জীভূত একত্রীকরণ' বলে থাকে, যেহেতু শুরুতে আসা মতামত দলগত মতামতকে প্রভাবিত করে।
১৯৯৮ সালে, 'জার্নাল অব রিস্ক এন্ড আনসারটেইনিটি' পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয় যে, ঊর্ধ্বতন কোনো ব্যক্তির মতামত প্রধান এবং শেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের মতামত প্রথমে এলে, পরবর্তীতে একই ধরনের মতামত আসার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
ধরুন, বেজোসের কোনো চিন্তা বা ধারণা পছন্দ হয়েছে? অন্যরা তা পছন্দ করতে বাধ্য হয়ে যায়। এমনকি প্রথমে এই একই ধারণা সম্পূর্ণভাবে অপছন্দ হলেও।
তাহলে আপনি যে অন্যের কথা শুনেছেন তা কীভাবে নিশ্চিত করবেন? নিজের মতামত দেয়ার আগে সবার আসল ধারণাগুলো জানতে পারার উপায় কী?
১। কোনো পরিস্থিতি বা সমস্যা যার সমাধান করা প্রয়োজন। আপনার কাছে তার সমাধান আছে বা হয়ত নেই । কিন্তু এই অবস্থায় আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট উত্তরের আশায় কোনো প্রশ্ন করে থাকেন তা এর পরবর্তী আরো অনেক ভালো চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করে।
ধরুন, আপনি জিজ্ঞেস করছেন, "আমরা তো আমাদের নির্দিষ্ট সময় থেকে পিছিয়ে আছি। আমাদের কি এই প্রোজেক্টটা বন্ধ করে দেয়া উচিত?" এ ধরনের প্রশ্ন সবাইকে আপনার সাথে বিরোধিতা করতে বাধ্য করে। (এ ধরনের প্রশ্ন এটাই প্রকাশ করে যে আপনি চাচ্ছেন এই প্রোজেক্টটি বন্ধ করে দেয়া হোক)। এতে করে হয়ত কিছু মানুষ এর বিরোধিতা করবে। কিন্তু অধিকাংশই ভাববে এটাই আপনি চাচ্ছেন, তাই আপনার মতামতের সাথে তাল মিলিয়েই তারা তাদের মতামত দিবে।
এর বদলে আপনি এটা জিজ্ঞেস করতে পারেন, "আমরা এই প্রোজেক্টের বিষয়ে কী করতে পারি?" এই উপায়ে আপনি কোনো সম্ভাব্য উত্তর না দিয়েই সমস্যাকে চিহ্নিত করলেন। যা অন্য সবাইকে তাদের নানা মতামত প্রকাশের সুযোগ করে দেয়।
২। এমন কোনো প্রশ্ন করুন যা অনেকভাবে চিন্তা করা যেতে পারে। নানা উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেমন, আমাদের কি প্রোজেক্টটি বন্ধ করা উচিত? অথবা আমাদের কি প্রোজেক্টটা আপাতত স্থগিত রাখা উচিত? এ ধরনের প্রশ্ন সরাসরি দুটি উপায় বলে দেয় যেখান থেকে যেকোনো একটি বাছাই করতে বাধ্য হবে সবাই। এতে করে আরো নতুন কোন উপায় বা মতামত আসার পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বরং এভাবে জিজ্ঞেস করুন, আমরা যেহেতু আমাদের নির্দিষ্ট সময়ের পেছনে আছি, আমাদের কি উচিত এ অবস্থায়? কেউ হয়ত বলবে প্রজেক্ট বন্ধ করে দিতে, কেউ বলবে পরবর্তী সহায়তা না আসা পর্যন্ত প্রজেক্ট স্থগিত থাকুক। কেউ হয়ত বলবে আমাদের নির্দিষ্ট কোন জিনিসের ওপর জোর দেয়া উচিত। অন্য কেউ হয়ত আরো কোনো ভালো বুদ্ধি নিয়ে আসবে।
নিজের মতামত প্রকাশ করার আগে অন্যরা মতামত দিতে পারে এমন প্রশ্ন করুন। "কী চিন্তা করছেন?", "আপনি কি করতেন এ অবস্থায়?" অথবা "আমাদের কীভাবে এটা সামাল দেয়া উচিত হবে বলে মনে করেন?" নিজেই উত্তর না দিয়ে চুপ করে মানুষকে ভাববার সময় দিন।
৩। শুধু নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতেই কথা বলুন। কোনো নেতৃত্বস্থানীয় স্থানে থেকে প্রশ্ন করাটা আপনার দুর্বলতা হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে। ফলে আপনি যা বুঝতে পারছেন না তা জিজ্ঞাসা করাটাও কঠিন হয়ে পড়েছে আপনার জন্য। বিশেষত যখন আপনার বিষয়টা জানার কথা ছিল।
আপনার জন্য আছে অভিনব এক পন্থা। আপনি ব্যাখ্যা চেয়ে প্রশ্ন করতে পারেন। "আমি খুবই অভিভূত। এখন আপনি মনে করুন যে আমি এটা কীভাবে কাজ করে তার কিছুই জানেন না। আপনি আমাকে এর বিস্তারিত বলুন।"
অথবা "এইটা তো বেশ ভালো। আমি যাতে কিছুই বাদ না দিই তা নিশ্চিত করতে চাচ্ছি। আমাকে পুরোটা একবার বিস্তারিতভাবে বলতে পারবেন কি?"
কিন্তু আপনি যখন কিছু একটা বুঝতে পারছেন না, কখনোই এমন ভান করবেন না। এতে করে আপনার এবং অন্যদের উভয়েরই সময় নষ্ট হয়।
তাহলে আগামী মিটিংয়ের জন্য আপনি প্রস্তুত কি-না দেখে নেয়া যাক:
১। স্বল্প কথায় প্রশ্ন জিজ্ঞেস করুন। কোনো সমস্যা কিংবা ঝামেলা বিস্তারিতভাবে বললেও প্রশ্ন খুব ছোট হওয়াই ভালো। এক বা দুই লাইনের প্রশ্নই ভালো। কোন নির্দিষ্ট দিকে পরিচালিত না করে, বিভিন্ন মতামত বা চিন্তা আসার সুযোগ করে দেয়া উচিত।
২। নিজের ইচ্ছা বা মতামত প্রকাশ পায় এমন কোনো মন্তব্য না করাই ভালো। আপনার কোনো চিন্তা থাকলেও সবার মতামতের অপেক্ষা করুন। আপনি নিজেই সব কিছু চিন্তা করেছেন এর সুযোগ খুবই কম।
৩। নিজের কাছে ধারণাটি স্পষ্ট কি-না শুধু তার জন্যই প্রশ্ন করুন। কোনো ধরনের বিবেচনা ছাড়াই মতামত শোনাটা জরুরি। কারণ কোনো ধরনের ভুল মন্তব্য পরবর্তীতে যেকোনো মতামত আসার পথে বাধা দেয়।
৪। সবসময় শেষে কথা বলুন। আপনি অনেক কিছুই জানেন কিন্তু আপনার লক্ষ্য হলো অন্যরা কি জানে তা জানা। সুতরাং সব কিছু চুপ করে শুনুন । যেকোনো জায়গা থেকে আপনার শেখার রয়েছে অনেক কিছু।
বিশেষত, আপনার অবস্থান যদি বেজোসের মতো নেতৃত্বস্থানীয় হয়, তাহলে আপনার অবশ্যই উচিত সবার শেষে কথা বলা।