ভারতের মেহরাউলির এক মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো, আশ্রয় হারাল এতিম শিশুরা
দুই বছর আগে হঠাৎ মারা যান ফাওয়াদের (১২) বাবা-মা। এরপর শিশু ফাওয়াদের আশ্রয় হয় ভারতের রাজধানী দিল্লির আখুন্দজি মসজিদে। সেখানকার মাদ্রাসাতেই চলছিল তার লেখাপড়া।
সবজ গাছপালায় ঘেরা ৬০০ বছর বয়সি আখুন্দজি মসজিদের রংও সবুজ। শুধু মসজিদ নয়, তার সংলগ্ন মাদ্রাসাটির রংও সবুজ। আর ফাওয়াদের সবচেয়ে প্রিয় রংও সবুজ। তাই দিল্লিতে এই 'ঘর' তার খুব পছন্দের ছিল।
নতুন শহরে পরিচিত এই রঙের মাঝে ফাওয়াদ খুঁজে পেয়েছিল নিরাপত্তা। কিন্তু এখন সেই মসজিদের কথা ভাবলেও তার কান্না পায়।
মসজিদটি অবৈধ স্থাপনা—এই অভিযোগে গত ৩০ জানুয়ারি জায়গাটি গুঁড়িয়ে দেয় কেন্দ্র-পরিচালিত নগর পরিবকল্পনা সংস্থা দিল্লি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ডিডিএ)। শুধু মসজিদই নয়, গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার লাগোয়া মাদ্রাসাটিও । সেখানে ফাওয়াদসহ আরও ২৫ শিশু থাকত। এই শিশুদের অধিকাংশই এতিম। মসজিদসংলগ্ন একটি করবস্থান আর মসজিদ প্রাঙ্গণের একজন সুফি সাধকের মাজারও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
দিল্লিতে সাতটি শহর মধ্যযুগের ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রেখেছে। সেগুলোর একটি মেহরাউলি। এখানকার ৭৮৪ একর বনভূমির সঞ্জয় ভ্যান এলাকাতেই ছিল আখুন্দজি মসজিদ।
এক বিবৃতিতে ডিডিএ বলছে, মসজিদটি ছিল 'অবৈধ স্থাপনা', যা বিনা বাধায় ধ্বংস করা হয়েছে।
কিন্তু মসজিদের ইমাম জাকির হুসাইন ও তাদের আইনজীবী শামস খাজার এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, আখুন্দজি মসজিদ ছিল দিল্লির ইসলামিক সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা দিল্লি ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি।
জাকির হুসাইনের দাবি, স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়ার আগে কর্তৃপক্ষ তাদের কোনো লিখিত নোটিশ দেয়নি। তিনি অভিযোগ করেন, উচ্ছেদ অভিযানে অনেকগুলো কোরআন শরীফ নষ্ট হয়েছে, এতিম শিশুদেরকে তাদের জিনিসপত্রও সঙ্গে নিতে দেওয়া হয়নি। এছাড়া মসজিদটি যে বৈধ, সেই কাগজপত্র তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
ডিডিএ অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, মসজিদটি যে জমিতে ছিল, সেটি তাদের সম্পত্তি।
ডিডিএর হর্টিকালচার বিভাগের প্রধান কমিশনার রাজিব কুমার তিওয়ারি বিবিসিকে বলেন, 'জায়গাটি পরিষ্কার করার সময় আমরা কিছু বই পেয়েছি। সেগুলো আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যেতে বলেছি মসজিদ কর্তৃপক্ষকে।'
বিষয়টি নিয়ে দিল্লি হাইকোর্টেও শুনানি চলছে। আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, দিল্লিতে 'পর্যাপ্ত স্থাপনা আছে, শহরের বন ফিরিয়ে আনার পথে সেগুলোর বাধা হয়ে দাঁড়ানো উচিত নয়।
আদালত আরও বলেন, শুধু আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়ার স্বীকৃতি পাওয়া স্থাপনাই সংরক্ষণ করা হবে।
ডিডিএ মেহরাউলির আরও কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থাপনাও ধ্বংস করেছে। এর মধ্যে দিল্লিতে আসা প্রথমদিকের সুফি সাধকদের একজনের মাজারও রয়েছে বলে দাবি অনেকের।
এ কাজে ক্ষুব্ধ সংরক্ষণবাদী ও ইতিহাসবিদরা বলেছেন, এমন 'অমানবিকভাবে' প্রাচীন ঐতিহ্য ধ্বংস করে শহরের আত্মায় আঘাত করা হয়েছে।
দিল্লির ইতিহাস-সমৃদ্ধ নগরী। এ শহরে আধুনিক পাব আর রেস্তোরাঁর পাশাপাশি চোখে পড়ে ১২ শতকের স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা স্থাপনা।
দিল্লির বনভূমি ও আবাসস্থলের চেয়েও প্রাচীন এসব স্থাপনাকে অবৈধ আখ্যা দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সমালোচকরা। পরিকল্পিত এই উচ্ছেদ অন্যায়ভাবে শুধু মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করেই চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের। ডিডিএর তথ্য অনুযায়ী, সঞ্জয় ভ্যান এলাকায় যে ২০টি ধর্মীয় স্থাপনা উচ্ছেদের পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার মধ্যে ১৬টিই মসুলিম সাধকদের মাজার, আর বাকি চারটি মন্দির।
ইতিহাসবিদ সোহাইল হাশমি বলেন, '(এ উচ্ছেদের) একটা স্পষ্ট প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে। আর যে দেশে সব ধর্মকে সমানভাবে দেখা হয়, সেখানে এটি উদ্বেগজনক।'
তবে রাজিব কুমার তিওয়ারি বলেন, 'সম্পূর্ণ আইনি' একটি উদ্যোগের গাঁয়ে ধর্মীয় রং চড়ানো হচ্ছে। সরকারি জমি দখলের বিরুদ্ধে ডিডিএ নিয়মিতই অভিযান চালিয়ে আসছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এসব অভিযানে অনেক মন্দিরও ভাঙা পড়ছে বলে উল্লেখ করেন রাজিব। আখুন্দজি মসজিদ ধ্বংসের দিনে ওই এলাকায় অবৈধ পাঁচটি মন্দিরও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি তার।
ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, আখুন্দজি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কোনো ঘোষণা ছাড়াই, বিশৃঙ্খলভাবে। মসজিদে থাকত, এমন নয়টি শিশুর সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। ওই শিশুরা বলেছে, সেদিন ভোর পাঁচটায় নামাজের জন্য ঘুম থেকে উঠতেই তারা একটি বিকট শব্দ শুনতে পায়।
ওমর নামের এক শিশু বলে, কয়েক ডজন পুলিশ, কয়েকটি বুলডোজার আর 'কিছু ক্রুব্ধ চেহারার' লোক দেখতে পায় সে। তারা চিৎকার করে তাদেরকে বাইরে আসতে বলছিল।
এরপর দৌড়ে আসেন ইমাম জাকির হুসাইন। তিনি চিৎকার করে শিশুদের বলেন, 'দৌড়াও, দৌড়াও! যা পারো, তা নিয়ে দৌড় দাও!'
ওমর হাতে করে শুধু একটি জ্যাকেট আর জুতা নিতে পেরেছিল। তার বন্ধু মুরিদ তা-ও নিতে পারেনি, খাল পায়েই বেরিয়ে আসতে হয় তাকে। ১০ বছর বয়সি আরও পাঁচটি শিশু জ্যাকেট কিংবা জুতা কোনোটাই নিতে পারেনি।
জাফর নামে আরেক শিশু বলে, 'আমি ভাগ্যবান, অন্তত খাবারের প্লেট আর প্রিয় ব্যাটটা নিতে পেরেছি।'
এ ঘটনায় শুধু যে শিশুরাই আশ্রয়হীন হয়েছে, তা নয়। মসজিদসংলগ্ন একটি বাড়িতে সপরিবারে থাকতেন ইমাম জাকির হুসাইন। তিনিও ঘরহারা হয়েছেন। এখনও তিনি প্রতিদিন ওই জায়গায় যান। তবে পুলিশ প্রহরা থাকায় ভাঙা মসজিদটির খুব বেশি কাছে যেতে পারেন না।
মাদ্রাসার ইংরেজি ও হিন্দির শিক্ষক মুজাম্মিল সালমানি বলেন, মসজিদের পাশের কবরস্থানে তারা চাচার কবর আছে। উচ্ছেদের পর সেখানে গিয়ে তারা শুধু কবরের নামফলকের কিছু ভাঙা টুকরো পেয়েছেন।
তিনি বলেন, 'মানুষ বুঝতে পারছে না—এটা স্রেফ মসজিদ, কবরস্থান কিংবা মাদ্রাসা ছিল না—এটা ছিল একটি আশ্রয়স্থল।'
মসজিদটির ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায় না। কেউ কেউ বলে, ১৩ শতকে রাজকন্যা রাজিয়া সুলতানা এ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। আবার অনেকে বলে, মসজিদটি এরচেয়েও পুরনো। ইতিহাসবিদ হাশমি বলেন, স্থাপনাটিতে ব্যবহৃত গ্রে স্টোন দেখে বোঝা যায়, মসজিদটি ৬০০-৭০০ বছর আগে সুলতানি আমলে তৈরি হয়ে থাকতে পারে।
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়ার তথ্যানুসারে, ১৮৫৩ সালে, শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সময় মসজিদটি সংস্কার করা হয়েছিল। ইতিহাসবিদ রানা সাফভি বলেন, মসজিদটিতে সম্রাটের নিজের হাতে লেখা একটি শিলালিপিও ছিল।
পরে মসজিদটির কাঠামোতে যুগোপযোগী সংস্কার করা হয়েছে। রাঙা সাফভি বলেন, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই মসজিদটি সংরক্ষণ করা উচিত ছিল।
তবে ডিডিএ বলে, তাদের কাছে মসজিদটির ঐতিহাসিক কোনো রেকর্ড নেই। রাজিব কুমার তিওয়ারি বলেন, 'মসজিদটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর জানতে পারি, ইতিহাসবিদরা এমন দাবি করছেন। স্থাপনাটি দেখতেও আধুনিক ছিল, মোটেও পুরনো মনে হয়নি।'
মসজিদটি মেহরাউলির মানুষের সামাজিকতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ও নিরাপদ আশ্রয় ছিল বলে জানান উসামা নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা।
তিনি বলেন, 'বনের ভেতরে হলেও জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কেন্দ্র ছিল। সব ধরনের মানুষ এখানে একত্র হতে পারত। শুধু ঐতিহাসিকই দিকে থেকেই নয়, বাস্তবিকই জায়গাটি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।'
দিল্লির যে কটি সবুজ স্থান টিকে আছে, তার অন্যতম সঞ্জয় ভ্যান এলাকা। দ্রুত নগরায়নের হুমকি থেকে রক্ষার্থে ১৯৯০ সালে এলাকাটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর ডিডিএ বেশ কয়েকবার এ এলাকায় অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে।
তবে ইতিহাসবিদরা বলছেন, এলাকাটিকে সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণার অনেক আগে থেকেই আখুন্দজি মসজিদটি ছিল সেখানে। কাজেই মসজিদটিকে অবৈধ স্থাপনা বলার সুযোগ নেই।
সুহাইল হাশমি বলেন, 'বনভূমি গুরুত্বপূর্ণ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বন আর ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকাও উচিত নয়, দুটোই সংরক্ষণ করা উচিত।'
২০২৩ সালে হাইকোর্টে দেওয়া এক প্রতিবেদনে ডিডিএ বলে, মেহরাউলিতে দিল্লি ওয়াকফ বোর্ডের অধীন মসজিদ, কবরস্থান ও অন্য কোনো বৈধ সম্পত্তি তারা ধ্বংস করবে না। কারণ সেগুলো বোর্ডের সম্পত্তি এবং ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
গত সপ্তাহে ডিডিএ বলে, এ ধরনের বিষয়গুলো দেখভালের জন্য গঠন করা একটি ধর্মীয় কমিটি মসজিদটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার 'অনুমতি' দিয়েছিল। আদালতে এই দাবি চ্যালেঞ্জ করে মসজিদ কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে, ডিডিএ আদালতের ২০২২ সালের একটি রুলিং লঙ্ঘন করেছে। ওই রুলিংয়ে ওয়াকফ মালিকানাধীন ভূমি চিহ্নিত এবং কোনো স্থাপনা ধ্বংসের আগে, তার সীমানা নির্ধারণ করা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল ডিডিএকে।
আইনজীবী ও অধিকারকর্মী প্রশান্ত ভূষণ বলেন, এ ঘটনায় বিদ্যমান আইনকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করা হয়েছে মনে হচ্ছে। 'ডিডিএ যদি বন আইনেরও প্রয়োগ করে, সেক্ষেত্রেও আগে এসব এলাকায় বসবাসকারী মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে,' বলেন তিনি।
তবে রাজিব কুমার তিওয়ারি বলছেন, জায়গাটি ডিডিএর সম্পত্তি, কাজেই এক্ষেত্রে 'এ আইন প্রযোজ্য নয়'।
এসব ঝুটঝামেলার বাইরে থাকা শিশু ফাওয়াদ অবশ্য আরেকটি মসজিদে আশ্রয় পেয়েছে। নতুন জায়গাটি তার খুব একটা অপছন্দ নয়, তবে এখানে সবুজ রঙের দেখা মেলে না তেমন একটা।
'তবে আমি হয়তো নতুন কোনো প্রিয় রং পাব এখানে,' বলে সে।