প্রতি বছর লক্ষাধিক গাধা হত্যা করা হচ্ছে ওষুধ তৈরির জন্য
আফ্রিকা দেশ কেনিয়ার স্টিভ পানি বিক্রি এবং জীবিকার জন্য তার গাধাগুলোর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল। গাধাগুলো তিনি ঠেলাগাড়ি টানার কাজে ব্যবহার করতেন। এই ঠেলাগাড়িতে করেই তিনি গ্রাহকদের কাছে বিক্রির উদ্দেশ্যে পণ্য আনা নেওয়া করতেন। কিন্তু চামড়ার জন্য যখন তার গাধাগুলোকে চুরি ও হত্যা করা হয় তখন সবকিছুই বদলে যায়।
একদিন সকালে তিনি নাইরোবির উপকণ্ঠে তার বাসা থেকে বের হইয়ে সাথে যান তার গাধাগুলো আনার জন্য। কিন্তু তিনি সেখানে গাধাগুলো খুঁজে পাননি।
তিনি বলেন, "আমি সেগুলোকে দেখতে পাইনি। "আমি সারা দিন, রাত এবং পরের দিন সেগুলোর খোঁজ করি।
তিন দিন পর তার এক বন্ধু ফোন দিয়ে জানায়, প্রাণীগুলোর কঙ্কালের খোঁজ পাওয়া গেছে।
স্টিভ বলেন, "গাধাগুলোকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে এবং সেগুলোর চামড়া ছিল না।"
এই ধরনের গাধা চুরি আফ্রিকার অনেক দেশেই সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে। এমনকি বিশ্বের যে সকল দেশেই প্রাণীর বিশাল সংখ্যা রয়েছে সেখানেই এমন ঘটনা ঘটছে। স্টিভ এবং তার গাধাগুলো মূলত গাধার চামড়া নিয়ে হওয়া একটি বিতর্কিত বৈশ্বিক বাণিজ্যের শিকার।
গাধার চামড়ায় যে জেলাটিন পাওয়া যায় তা দিয়ে চীনে একটি ঐতিহ্যবাহী ওষুধ তৈরি করা হয়। ইজিয়াও নামে পরিচিত এই ওষুধের দেশটিতে অনেক চাহিদা রয়েছে।
এই ওষুধ স্বাস্থ্য বর্ধক এবং এতে বয়স ধরে রাখার মত গুণাবলি রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। জেলাটিন বের করার জন্য গাধার চামড়া সিদ্ধ করা হয়। তারপর এই জেলাটিন দিয়ে পাউডার, বড়ি বা তরল বানিয়ে সেটি খাবারে যোগ করা হয়।
এই বাণিজ্যের বিরুদ্ধে প্রচারণাকারীরা জানিয়েছেন, স্টিভের মতো যে সকল লোকেরা গাধার উপর নির্ভরশীল তারা ইজিয়াওর মত ওষুধের উপাদানের চাহিদা মেটানোর জন্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতির শিকার হয়।
একটি নতুন প্রতিবেদনে দ্য ডাংকি স্যাংকচুয়ারি (২০১৭ সাল থেকে এই ধরনের বাণিজ্যের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে) নামে একটি দাতব্য সংস্থা দেখিয়েছে, বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ৫.৯ মিলিয়ন গাধা প্রতি বছর ইজিয়াওর চাহিদা মেটানোর জন্য জবাই করা হয়।
কিন্তু বিবিসি স্বাধীনভাবে সেই পরিসংখ্যান যাচাই করতে পারেনি।
ইজিয়াও শিল্পের জন্য ঠিক কতগুলো গাধা হত্যা করা হয় তার একটি সঠিক চিত্র পাওয়া কঠিন।
আফ্রিকাতে বিশ্বের ৫৩ মিলিয়ন গাধার মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পাওয়া যায় এবং মহাদেশটিতে এই নিয়ে কিছু নিয়ম আছে। কোনো কোনো দেশে গাধার চামড়া রপ্তানি বৈধ এবং কিছু দেশে অবৈধ। কিন্তু চামড়ার উচ্চ চাহিদা এবং উচ্চ মূল্যের জন্য গাধা চুরি করা হচ্ছে।
দ্য ডাংকি স্যাংকচুয়ারি বলেছে, পশুদের আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে এমন স্থানে নেওয়া হয় যেখানে এই ধরণের ব্যবসা বৈধ।
কিন্তু এতে দ্রুত পরিবর্তন আসতে পারে কারণ প্রতিটি আফ্রিকান দেশের সরকার এবং ব্রাজিলের সরকার কমে যাওয়া গাধার সংখ্যা বন্ধ করতে গাধা জবাই এবং রপ্তানি নিষিদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
দ্য ডাংকি স্যাংকচুয়ারির জন্য কাজ করা নাইরোবির অধিবাসি সলোমন ওনিয়াঙ্গো বলেন, "আমরা অনুমান করি, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে কেনিয়ার প্রায় অর্ধেক গাধাকে চামড়ার ব্যবসার জন্য জবাই করা হয়েছে।"
এই প্রাণীগুলো মানুষ, পণ্য, পানি ও খাদ্য গ্রহণ করে এবং দরিদ্র ও গ্রামীণ সম্প্রদায়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই চামড়া ব্যবসার দ্রুত বৃদ্ধি বিশেষজ্ঞদের শঙ্কিত করেছে। এটি কেনিয়ার অনেক মানুষকে চামড়া ব্যবসার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করেছে।
আফ্রিকাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য গাধার চামড়া ব্যাবসাইয় নিষেধাজ্ঞা আরপ করার প্রস্তাবটি আফ্রিকান ইউনিয়ন সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে রয়েছে। ১৭ এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই সম্মেলনে আফ্রিকার সকল দেশের নেতারা একত্রিত হবেন।
আফ্রিকায় এই সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে স্টিভ বলেছেন, তিনি আশা করেন এটি প্রাণীগুলোকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে না হলে 'পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কোন গাধা থাকবে না'।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, আফ্রিকা এবং ব্রাজিলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে এই বাণিজ্য অন্যত্র স্থানান্তরিত হবে কি না?
ইজিয়াও উৎপাদনকারীরা আগে চীনে পাওয়া যায় এমন গাধার চামড়া ব্যবহার করত। কিন্তু সেখানকার কৃষি ও গ্রামীণ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতে, দেশটিতে ১৯৯০ সালে গাধার সংখ্যা যেখানে ১১ মিলিয়ন ছিল সেখান থেকে ২০২১ সালে সংখ্যাতে কমে মাত্র দুই মিলিয়নেরও নিচে নেমে আসে। একই সাথে ইজিয়াও একটি বিশেষ বিলাসী পণ্য থেকে একটি জনপ্রিয় এবং সহজলভ্য পণ্য হয়ে উঠে।
চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে চামড়া আমদানি করতে চেয়েছিল। এই কারণে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়ার কিছু অংশে গাধা জবাই ও চামড়া সংগ্রহ করতে কসাইখানা গড়ে উঠেছে।
ইথিওপিয়াতে গাধার মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ এবং জনগণের বিক্ষোভ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিবাদের কারণে ২০১৭ সালে দেশটিতে দুটো গাধার কসাইখানার একটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
তানজানিয়া এবং আইভরি কোস্টের মত দেশগুলোতে ২০২২ সালে গাধা জবাই এবং চামড়া রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু চীনের প্রতিবেশী পাকিস্তান এই বাণিজ্যকে টিকিয়ে রেখেছে। গত বছরের শেষের দিকে সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, দেশটিতে 'গাধার প্রজনন খামার' করা হয়েছে।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চীন-আফ্রিকা সম্পর্কের অধ্যাপক লরেন জনস্টনের মতে, থেকে, চীনের ইজিয়াও বাজারের মূল্য ২০১৩ সালে প্রায় ৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে গিয়ে ২০২০ সালে প্রায় ৭.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।
এটি জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা, প্রাণী কল্যাণ প্রচারক এবং এমনকি আন্তর্জাতিক অপরাধ তদন্তকারীদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গাধার চামড়ার চালানের সাথে অন্যান্য বন্যপ্রাণীর অবৈধ পণ্য বহন করা হয়।
অনেকেই উদ্বেগ দেখিয়েছেন, বাণিজ্যের উপর জাতীয় নিষেধাজ্ঞা এই ব্যাবসাকে আরও গোপনীয় করে তুলবে।
দ্য ডাংকি স্যাংকচুয়ারির প্রধান পশুচিকিৎসক ফেইথ বার্ডেন বলেছেন, প্রাণীগুলি বিশ্বের অনেক অংশে গ্রামীণ জীবনের জন্য 'অনেক গুরুত্বপূর্ণ'। এগুলো শক্তিশালী, অভিযোজিত প্রাণী। একটি গাধা সম্ভবত ২৪ ঘণ্টা পানি ছাড়া থাকতে পারে এবং কোন সমস্যা ছাড়াই খুব দ্রুত রিহাইড্রেট করতে পারে।"
কিন্তু গাধা সহজে বা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। তাই অনেকেই আশঙ্কা করছেন, যদি বাণিজ্য কমানো না হয় তাহলে গাধার সংখ্যা ক্রমাগত কমতে থাকবে এবং আরও দরিদ্র মানুষদের ক্ষতি হবে।
ওনিয়াঙ্গো ব্যাখ্যা করেছেন, "আমরা কখনই গাধাকে এভাবে গণহারে মেরে ফেলবার জন্য প্রজনন করিনি।"
২০১১ সালের চীনা টিভি শো 'এমপ্রেসেস ইন দ্য প্যালেস' ইজিয়াওকে জনপ্রিয় করে তোলে।
অধ্যাপক জনস্টন বলেন, "শোতে থাকা মহিলারা সুন্দর এবং সুস্থ থাকার জন্য, তাদের ত্বকের উজ্জ্বলতা এবং তাদের উর্বরতার জন্য প্রতিদিন ইজিয়াও খেতেন। এটি অভিজাত নারীর পণ্য হয়ে উঠেছে। হাস্যকরভাবে, এটি এখন অনেক আফ্রিকান নারীর জীবন ধ্বংস করছে।"
২৪ বছর বয়সী স্টিভ এখন তার গাধাগুলোকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেছেন, "আমি আসলে দিশেহারা হয়ে পড়েছি।"
দ্য ডাংকি স্যাংকচুয়ারির জনেকে মার্কক্স বলেছেন, "আমরা যা দেখতে চাই তা হল ইজিয়াও কোম্পানিগুলো একসাথে গাধার চামড়া আমদানি বন্ধ করেছে এবং টেকসই বিকল্প যেমন সেলুলার এগ্রিকালচারে (ল্যাবে কোলাজেন তৈরি করা) বিনিয়োগ করছে। এটি করার জন্য নিরাপদ এবং কার্যকরী উপায় রয়েছে।"
দ্য ডাংকি স্যাংকচুয়ারির উপপ্রধান নির্বাহী ফেইথ বার্ডেন গাধার চামড়ার ব্যবসাকে 'অস্থিতিশীল এবং অমানবিক' বলে অভিহিত করেছেন।
দাতব্য সংস্থা ব্রুক এখন স্টিভকে একটি নতুন গাধা দিয়েছেন। এটি একটি মহিলা গাধা যার নাম রাখা হয়েছে তিনি জয় লাকি। কারণ গাধাটি পেয়ে স্টিভ আনন্দিত হয় এবং নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে শুরু করে।
স্টিভ বলেন, "আমি জানি গাধাটি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে সাহায্য করবে এবং আমি নিশ্চিত করব এটি সুরক্ষিত আছে।"