সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগ থেকে বাঁচতে মিয়ানমার থেকে পালানোর চেষ্টা করছে তরুণরা
একটি পাসপোর্ট অফিসের বাইরে পদদলিত হয়ে দুইজনের মৃত্যু এবং দূতাবাসের বাইরে অসংখ্য তরুণের লাইন - এটি সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগের ঘোষণা আসার পর থেকে মিয়ানমারে যা ঘটছে তার বর্তমান চিত্র। কিন্তু পরিস্থিত আরো গুরুতর হয়ে উঠছে দেশটির তরুণদের জন্য।
মিয়ানমারের সামরিক সরকার সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রতিরোধের কাছে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছে এবং বিদ্রোহীরা দেশটির অনেক অঞ্চলের দখল নিয়েছে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। এরপর থেকেই জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। এতদিন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো বিচ্ছিন্নভাবে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু গত বছরের ২৭ অক্টোবর থেকে বিদ্রোহীদের তিনটি সংগঠন মিলে 'ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স' নামে জোট গড়ে মিয়ানমারের বিভিন্ন জায়গায় জান্তাদের ওপর হামলা চালিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে।
এই সংঘাতে দেশটির হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং জাতিসংঘ অনুমান করেছে প্রায় ২.৬ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে।
তরুণ বার্মিজরা জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও এখন বলা হচ্ছে তাদের সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে যোগদান করতে হবে।
অনেকেই বিশ্বাস করেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিদ্রোহীদের কাছে পরাজিত হওয়ার কারণে নিজেদের লোকবল বাড়াতে এবং বিরোধী দলগুলোর থেকে চাপ আসার কারণে জান্তা সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
২৪ বছর বয়সী অ্যাক্টিভিস্ট রবার্ট বিবিসিকে বলেন, "এই সময়ে সামরিক বাহিনীতে চাকরি করাটা বোকামি কারণ আমরা বিদেশিদের সাথে যুদ্ধ করছি না। আমরা একে অপরের সাথে যুদ্ধ করছি। আমরা যদি সামরিক বাহিনীতে চাকরি করি তাহলে আমরা তাদের নৃশংসতায় অবদান রাখব।"
অনেকেই এখন দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন।
রেঙ্গুনের থাই দূতাবাসের সামনে অপেক্ষারত একজন তরুণী জানিয়েছিলেন, "আমি সাড়ে তিনটায় এখানে এসেছি এবং ইতোমধ্যেই প্রায় ৪০ জন ভিসার আবেদন করার জন্য টোকেনের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল"। তিনি জানান, ১ ঘণ্টার মধ্যেই দূতাবাসের সামনে তিনশর বেশি মানুষের ভীর জমে যায়।
বিবিসিকে জানানো হয়েছে, মান্দালের পাসপোর্ট অফিসের বাইরে দুইজন পদদলিত হয়ে নিহত হওয়ার পাশাপাশি আরো অনেকেই মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন।
ডেনিশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মায়ানমারের গবেষক জাস্টিন চেম্বারস বলেছেন, বাধ্যতামূলক নিয়োগ বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী তরুণ বেসামরিক নাগরিকদের অপসারণের একটি উপায়৷
তিনি বলেন, "আমরা বিশ্লেষণ থেকে দেখতে পাই, নিয়োগ আইন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বর্তমান দুর্বলতার প্রতীক। এটি শেষ পর্যন্ত জীবন ধ্বংস করার লক্ষ্যেই করা... কেউ কেউ পালাতে সক্ষম হবে কিন্তু অনেকেই তাদের স্বদেশিদের বিরুদ্ধে মানব ঢাল হয়ে দাঁড়াবে।"
২০১০ সালের প্রথমবারের মত সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগের আইনটি চালু করা হয়েছিল। কিন্তু এই বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি জান্তা সরকার ঘোষণা দিয়েছে, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সব পুরুষ এবং ১৮ থেকে ২৭ বছর বয়সী সব নারীকে বাধ্যতামূলকভাবে দুই বছর সামরিক বাহিনীতে সেবা দিতে হবে।
সামরিক সরকারের মুখপাত্র মেজ-জেন জাও মিন তুন এক বিবৃতিতে বলেছেন, দেশের ৫৬ মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ এই আইনের অধীনে সামরিক চাকরির জন্য যোগ্য।
জান্তা সরকার পরবর্তীতে জানিয়েছে, 'বর্তমানে' নারীদের বাধ্যতামূলক নিয়োগের পরিকল্পনা নেই কিন্তু এর অর্থ কী তা নির্দিষ্ট করেনি।
জান্তা সরকারের মুখপাত্র বিবিসি বার্মিজকে জানিয়েছে, এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বার্মিজ নববর্ষ উপলক্ষ্যে থিংয়ান উৎসবের পর নিয়োগ শুরু হবে এবং প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
এই ঘোষণা মিয়ানমারের তরুণদের জন্য একটি বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে কারণ এই তরুণদের অনেকেরই শিক্ষা কার্যক্রম অভ্যুত্থানের জন্য ব্যাহত হয়েছিল।
মিয়ানমার শিক্ষক ফেডারেশনের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে জান্তা সরকার ১ লাখ ৪৫ হাজার শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের বিরোধীদের সমর্থন দেওয়ার জন্য বরখাস্ত করেছিল। পাশাপাশি বিরোধী নিয়ন্ত্রিত এলাকার কিছু স্কুল যুদ্ধ বা বিমান হামলায় ধ্বংস হয়েছে।
তারপরে যারা আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত দিয়ে পালিয়েছে তাদের মধ্যে অনেক তরুণ পরিবারকে সমর্থন দিতে চাকরি খুঁজছে।
নিয়োগ আইনের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, তারা সন্ন্যাসী হয়ে যাবেন অথবা সামরিক সেবা এড়াতে বিয়ে করে ফেলবেন।
জান্তা সরকার জানিয়েছে, ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্য, বিবাহিত নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, সামরিক চাকরির জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত এবং 'নিয়োগ বোর্ড থেকে অব্যাহতি পাওয়া' ব্যক্তিদের শুধু স্থায়ীভাবে ছাড় দেওয়া হবে। বাকিদের সামরিক বাহিনীতে যোগদান না করলে ৩ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি অর্থদণ্ড দেওয়া হবে।
কিন্তু রবার্টের সন্দেহ আছে জান্তা সরকার এইভাবে ছাড় দিবে না। তিনি বলেন, "জান্তা যাকে খুশি তাকে গ্রেফতার ও অপহরণ করতে পারে। আইনের কোন শাসন নেই এবং তাদের কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না।"
ধনী পরিবারগুলো তাদের পরিবারের সদস্যদের বিদেশে পাঠানোর কথা ভাবছে। থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুর তাদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। তবে কেউ কেউ আইসল্যান্ডের মতো ইউরোপের দেশগুলোতেও চেষ্টা করছে যাতে তাদের সন্তানরা চাকরিতে ঢোকার বয়সের মধ্যেই সেখানে স্থায়ী নাগরিকত্ব পায়।
অল বার্মা ফেডারেশন অফ স্টুডেন্ট ইউনিয়নের অং সেট বলেছেন, অন্যরা বিদ্রোহী বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে। অংয়ের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
২৩ বছর বয়সী নির্বাসিত অং বিবিসিকে বলেন, "আমি যখন শুনলাম যে আমাকে সামরিক বাহিনীতে কাজ করতে হবে তখন আমি সত্যিই হতাশ হয়েছিলাম। একই সাথে জনগণের জন্য, বিশেষ করে যারা আমার মতো তরুণদের কথা ভেবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম। অনেক তরুণ এখন জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিদ্রোহী বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে।"
কিছু পর্যবেক্ষক বলছেন, এই আইনের মাধ্যমে দেশের উপর জান্তা বাহিনীর প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়ছে সেটি প্রকাশ পাচ্ছে।
সামরিক অভ্যুত্থানের পর গত অক্টোবরে জান্তা সরকার সবচেয়ে বর ধাক্কা খেয়েছে। জাতিগত বিদ্রোহীদের একটি জোট ভারত ও চীন সীমান্তে কয়েক ডজন সামরিক ফাঁড়ি দখল করেছে। সরকার বাংলাদেশ ও ভারতীয় সীমান্তে বিদ্রোহীদের কাছে বিশাল এলাকা হারিয়েছে।
জাতীয় ঐক্য সরকারের মতে (যারা নিজেকে মিয়ানমারের নির্বাসিত সরকার বলে), মিয়ানমারের ৬০ শতাংশের বেশি ভূখণ্ড এখন প্রতিরোধী শক্তির নিয়ন্ত্রণে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিস-এর বার্মা প্রোগ্রামের কান্ট্রি ডিরেক্টর জেসন টাওয়ার বলেছেন, "জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর কাছে একের পর এক ধ্বংসাত্মক এবং অপমানজনক পরাজয়ের পর জোরপূর্বক নিয়োগ শুরু করার মাধ্যমে সামরিক বাহিনী প্রকাশ্যে দেখিয়ে দিয়েছে সেটি কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে।"
টাওয়ার আশা করেন, জান্তার বিরুদ্ধে বৃদ্ধি পাওয়া অসন্তোষের কারণে পদক্ষেপটি ব্যর্থ হবে।
তিনি বলেন, "অনেক তরুণের নিয়োগ থেকে বাঁচার জন্য প্রতিবেশী দেশে পালানো ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। এর ফলে থাইল্যান্ড, ভারত, চীন এবং বাংলাদেশে মানবিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পাশাপাশি শরণার্থী সংকট বাড়তে পারে। এর ফলে, প্রতিবেশী দেশগুলো জান্তাকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করতে পারে।"
তিনি আরো বলেন, এমনকি সামরিক বাহিনী জোর করে সৈন্য সংখ্যা বাড়ালেও ভেঙ্গে পড়া মনোবলকে খুব কমই মোকাবেলা করতে পারবে। তিনি নতুন সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিতেও কয়েক মাস সময় লাগবে।
উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারের গ্লোবাল ফেলো ইয়ে মায়ো হেইন বলেছেন, আইন প্রণয়নের আগেও জান্তার 'বলপূর্বক নিয়োগ' এর দীর্ঘ ইতিহাস ছিল।
তিনি বলেন, "সুতরাং আইনটি জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে নতুন নিয়োগের জন্য একটি উপায় হিসাবে কাজ করতে পারে। জনবলের তীব্র ঘাটতির পাশাপাশি নতুন সৈন্য নিয়োগের দীর্ঘ এবং ধীর প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করার সময় নেই জান্তা বাহিনীর। তাই এটি সেনা কর্মকর্তাদের এই আইনের মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করার জন্য প্ররোচিত করতে পারে।"
এমনকি যারা পালাতে সক্ষম হবে তাদের জন্যও অনেকেই সারাজীবন ক্ষত ও মানসিক যন্ত্রণা বহন করতে হবে।
ছাত্র নেতা অং সেট বলেছেন, "মায়ানমারের তরুণদের নতুন আইনটি শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমরা আমাদের স্বপ্ন, আমাদের আশা এবং আমাদের যৌবন হারিয়ে ফেলেছি। এটা আগের মতো হতে পারে না।"
তিনি আরো বলেন, "এই তিন বছর এমন ভাবে চলে গেছে যেন কিছু হয়নি। জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় আমরা আমাদের বন্ধু ও সহকর্মীদের হারিয়েছি এবং অনেক পরিবার তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছে। এটি এই দেশের জন্য একটি দুঃস্বপ্ন। আমরা তাদের নৃশংসতা দেখেছি। আমি এটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।"
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়