পাকিস্তানের অর্থনীতির ক্ষত সারানোর দায়িত্ব পাওয়া কে এই আওরঙ্গজেব?
পাকিস্তানের নতুন মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন রাজনীতির বাইরের লোক মোহাম্মদ আওরঙ্গজেব। দেশটির অর্থনীতির বহুমুখী সংকট থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ তার সামনে।
অভিজ্ঞ ও ঋদ্ধ ব্যাংকার আওরঙ্গজেব মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব নেওয়ার আগে ছিলেন পাকিস্তানের বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর একটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও চেয়ারম্যান। চারবারের অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারসহ আরও কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে বাদ দিয়ে হাবিব ব্যাংক লিমিটেডের (এইচবিএল) সাবেক প্রধানকে দেশটির ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সরকার তাকে নিয়োগ দিয়েছে। শাহবার ও তার দল পিএমএল-এন ক্ষমতায় এসেছে পাকিস্তান পিপলস পার্টিসহ (পিপিপি) কয়েকটি দলের সঙ্গে জোট করে।
ইউনিভার্সিটি অভ পেনসিলভানিয়ার হোয়ারটন স্কুল অভ বিজনেস-এর স্নাতক আওরঙ্গজেব ছয় বছর এইচবিএলে কাজ করেছেন। এর আগে সিটিব্যাংক ও জেপি মরগ্যানের মতো বেশ কিছু বড় আন্তর্জাতিক ব্যাংকে চাকরি করেছেন।
পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য দ্বৈত নাগরিক আওরঙ্গজেবকে তার ডাচ নাগরিকত্ব ছাড়তে হয়েছে। তিনি এখনও পার্লামেন্টের সদস্য নন। তবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দায়িত্ব চালিয়ে জন্য পার্লামেন্টের সদস্য হতে তার হাতে ছয় মাস সময় আছে। পাকিস্তানের নিয়ম অনুসারে, মন্ত্রিসভার সব সদস্যকে পার্লামেন্টের সদস্য হতে হয়।
আওরঙ্গজেব বার্ষিক ৩৫২ মিলিয়ন পাকিস্তানি রুপি (১.২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বেতনের চাকরি ছেড়ে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি ছিলেন দেশটির সর্বোচ্চ বেতন পাওয়া সিইওদের একজন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি এর দশ ভাগের এক ভাগ বেতন পাবেন।
আওরঙ্গজেবের নেতৃত্বে ২০২৩ সালে এইচবিএল রেকর্ড ১১৩.৬ বিলিয়ন পাকিস্তানি রুপি (৪০৭ মিলিয়ন ডলার) মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৪৭ শতাংশ বেশি। এছাড়া ব্যাংকটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
ব্যাংকটির ব্যালান্স শিট ৫.৫ ট্রিলিয়ন পাকিস্তানি রুপির। ব্যাংক অনুপাতে অন্যতম কম জনসংখ্যার এক দেশে ভালো ব্যবসা করেছে এইচবিএল।
এইচবিএলের সিইও হিসেবে আওরঙ্গজেব সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন উদ্যোগে কাজ করেছে। এসবের মধ্যে আছে করোনা মহামারিকালে ৭.৫ মিলিয়ন সুবিধাভোগীর মধ্যে ৯০ বিলিয়ন রুপি বিতরণ করা।
আওরঙ্গজেব এর আগে প্রবৃদ্ধির জন্য প্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, এইচবিএলের তার লক্ষ্য হচ্ছে ব্যাংকটিকে ব্যাংকিং লাইসেন্সধারী প্রযুক্তি কোম্পানি হিসেবে পরিচিত করে তোলা।
আওরঙ্গজেবই অবশ্য পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া প্রথম ব্যাংকার নন। তার আগে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের আমলে (১৯৯৯–২০০৭) আট বছর অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন শওকত আজিজ।
পরে সাবেক ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) অধীনে অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন আরেক ব্যাংকার শওকত তারিন। পিটিআইকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগে এক বছর এ পদে ছিলেন তিনি।
আওরঙ্গজেব এমন এক সময়ে নিয়োগ পেলেন, যখন পাকিস্তান তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত। পাকিস্তানকে এ সংকট থেকে বের করে আনা অন্যরকম চ্যালেঞ্জ হবে। স্বাধীনতার পর থেকে গত ৭৬ বছরে দেশটিকে ২০ বার আইএমএফের সহায়তা প্যাকেজের দ্বারস্থ হতে হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আওরঙ্গজেবের প্রথম কাজ হবে জরুরি ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে নতুন ঋণপ্রাপ্তি নিয়ে আলোচনায় বসা। কারণ আগের নয় মাস মেয়াদি ৩ বিলিয়ন ডলারের বেইলআউট প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হচ্ছে এপ্রিল মাসে।
তাই অবিলম্বে বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থাটির কাছ থেকে নতুন ঋণ পাওয়া পাকিস্তানের জন্য জরুরি। পাকিস্তানের মাথায় এখন ১৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক ঋণের বোঝা রয়েছে—যা কিনা দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অন্তত এক-তৃতীয়াংশ।
চলতি বছরের জুনের মধ্যে ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করার কথা ছিল পাকিস্তানের। তবে রোলওভারের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতাদের কাছ থেকে কিছুটা বাড়তি সময় পেয়েছে। দেশটিকে এখন অর্থবছরের জুনের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে।
এদিকে পাকিস্তানের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এখন মাত্র ৭.৮ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে প্রায় আট সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।
গত দুই বছরে পাকিস্তানের মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। এখন দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ২৩ শতাংশের বেশি, ২০২৩ সালে প্রায় ৪০ শতাংশে ঠেকেছিল। সেইসঙ্গে জ্বালানি ও মৌলিক খাদ্যপণ্যের দামও দ্রুত বেড়ে গেছে।
অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, পাকিস্তানের ঋণ চ্যালেঞ্জের নিরিখে আন্তর্জাতিক ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজারে আওরঙ্গজেবর অভিজ্ঞতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট পলিসি ইন্সটিটিউট ইন ইসলামাদের (এসডিপিআই) সিনিয়র অর্থনীতিবিদ সাজিদ আমিন জাভেদ বলেন, আওরঙ্গজেবকে নিয়োগ দিয়ে সরকার ইঙ্গিত দিল যে তারা অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেই সংস্কারগুলো রাজনৈতিকভাবে অজনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও।
তবে অর্থনীতিবিদ খুররম শেহজাদের মতে, অর্পিত দায়িত্ব পালনে সফল হতে হলে এতসব অভিজ্ঞতার সঙ্গে আরও বেশি কিছুর দরকার হবে আওরঙ্গজেবের।
তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী কে, তা মূল বিষয় নয়—ওই ব্যক্তি কী করবেন, তার লক্ষ্য কী এবং দীর্ঘমেয়াদি কোন চিন্তা করছেন, তা-ই গুরুত্বপূর্ণ।
এসডিপিআইয়ের জাভেদ বলেন, যেকোনো প্রধানমন্ত্রীর জন্যই সময়টা এখন কঠিন। তবে আওরঙ্গজেব কোনো রাজনৈতিক থেকে উঠে না আসায় এটি তার পক্ষে কাজ করতে পারে।
তিনি বলেন, 'আমরা হয়তো রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার বদলে আইএমএফের সঙ্গে আরও সংস্কারমুখী কাজ দেখতে পাব।'
আওরঙ্গজেব একটু গভীরে অর্থনৈতিক নীতিসমূহ সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে পারেন বলে মন্তব্য করেন জাভেদ।
- অনুবাদ: মারুফ হোসেন