৪ হাজার বছরের পুরোনো শিশিতে প্রাচীন লাল লিপস্টিক, বলছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা
দক্ষিণ-পূর্ব ইরানে আবিষ্কৃত হয়েছে একটি ছোট পাথরের শিশি। আর এই শিশিতেই পাওয়া গিয়েছে এক ধরনের লাল প্রসাধনী। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ভাষ্যমতে, সম্ভবত প্রায় ৪ হাজার বছর আগে ঠোঁটের রং হিসাবে ব্যবহৃত হতো এই প্রসাধনী।
বিরল এই আবিষ্কারটি সম্ভবত লিপস্টিকের প্রাচীনতম উদাহরণ; যা বৈজ্ঞানিকভাবে নথিভুক্ত ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষকরা ফেব্রুয়ারিতে 'সায়েন্টিফিক রিপোর্ট' জার্নালে দেয়া প্রতিবেদনে এই প্রসাধনীর এভাবেই বর্ণনা দিয়েছেন।
দেখা যায়, নমুনায় প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি উপাদান প্রাথমিকভাবে হেমাটাইট নামক এক ধরনের খনিজ পদার্থ। এই পদার্থের উপস্থিতিই গভীর লাল রঙের জন্য দায়ী। মিশ্রণটিতে আরো আছে ম্যাঙ্গানাইট ও ব্রাউনাইট; যা একে এক ধরনের গাঢ় রং দিয়েছে। সেইসাথে প্রসাধনীটিতে শাকসবজি ও অন্যান্য জৈব পদার্থ থেকে প্রাপ্ত অন্যান্য খনিজ, মোমজাতীয় পদার্থের উপস্থিতিও লক্ষণীয়।
গবেষকদের মতে, "লাল রঙের খনিজ ও মোমজাতীয় পদার্থের তীব্রতা আশ্চর্যজনকভাবে সমসাময়িক লিপস্টিকের উপাদানগুলোর সাথে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ।"
ইতালির ইউনিভার্সিটি অফ পাডুয়ার কালচারাল হেরিটেজ বিভাগের প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষণার প্রধান লেখক ম্যাসিমো ভিডালের মতে, প্রসাধনীটিকে অন্য কাজে ব্যবহারের সম্ভাবনাকে একেবারে নাকচ করা যায় না। ব্লাশের কাজেও ব্যবহার হতে পারে এই প্রসাধনী। তবে তার মতে, সমজাতীয় গভীর লাল রং, ব্যবহৃত যৌগসমূহ ও শিশির আকারের কারণেই ধারণা করা হচ্ছে যে, প্রসাধনীটি ব্যবহৃত হতো ঠোঁট রাঙাতেই।"
এটি প্রাচীন, লাল রঙের কোন প্রসাধনী সামগ্রী নিয়ে প্রথম দিকের গবেষণাগুলোর মধ্যে একটি। তিনি আরো জানান, প্রত্নতাত্ত্বিক রেকর্ডে লিপস্টিকের মতো প্রসাধনী বা এসব প্রসাধনীর প্রস্তুতপ্রণালির নথি কেন দুর্লভ এ বিষয়টি একেবারেই পরিষ্কার না।
ভিদাল জানান, "এই মুহূর্তে এ নিয়ে আমাদের কোন ধারণা নেই। আমরা যে গাঢ় লাল রং পেয়েছি এটাই আমাদের প্রথম পাওয়া কোন গাঢ় রঙের প্রসাধনী। যদিও এর আগে খোঁজ পাওয়া গিয়েছে বেশ কয়েকটি হালকা রঙের ফাউন্ডেশন এবং আই শ্যাডোর।"
ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক জোয়ান ফ্লেচারের মতে, চূর্ণ করা লাল গেরুয়া হেমাটাইটের ব্যবহার নিওলিথিকের শেষের দিকের পাথরের প্রসাধনী প্যালেটের পাশাপাশি প্রাচীন মিশরীয় প্রসাধনী হিসেবেও নথিভুক্ত রয়েছে। তবে ইরান থেকে আসা শিশিটি প্রাচীন লিপস্টিক ছিল কি-না বা নতুন এই আবিষ্কারটি আসলে কী কাজে ব্যবহার করা হতো তার উপর নির্ভর করে অনেক কিছু।"
ফ্লেচার আরও বলেন, "শিশিতে থাকা উপাদানটি ঠোঁটের রং হিসাবে ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এগুলো গালে রং দেওয়ার জন্য বা অন্য কোনও উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা হতে পারে। শিশিটি অনেকটা আধুনিক লিপস্টিক টিউবের মতো দেখায়।"
কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব হিস্টোরি, আর্কিওলজি এন্ড রিজিওনের প্রাচীন ইতিহাসের অধ্যাপক এবং গ্রিক ও রোমান বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ লরেন্স টোটেলিন বলেন, "এটি মনে করা খুবই যুক্তিসংগত যে, আর্টিফ্যাক্টটি আসলে লিপস্টিক হিসেবেই ব্যবহৃত হতো৷ লেখকরা যা বলেছে, আর্টিফ্যাক্টটিতে থাকা লাল রঙের প্রস্তুত প্রণালির সাথে আধুনিক লিপস্টিকের প্রস্তুত প্রণালি তেমন আলাদা নয়। ঠোঁটে সাঁজাতেই ব্যবহার করা হতো গভীর লাল রংটি। এমনটাই আশা করছি আমরা।"
টোটেলিন আরো বলেন, "তবে প্রাচীন ওষুধ তৈরিতেও নিয়মিত পাওয়া যায় এই উপাদানগুলো। শিশির এই আকৃতি ঔশধের শিশি হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। ফলে এটা কোন ধরনের ঔষধ তা ভেবে নেওয়াটাও খুব একটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না।"
বন্যা যেভাবে নিদর্শণটির খোঁজ দিয়েছে
এর আগে অনুরূপ অন্যান্য অনেক দ্রব্যাদি মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে। এসবের মধ্যে কালো কাজল বা আইলাইনার এবং হালকা রঙের যৌগ সমৃদ্ধ 'আই শ্যাডো' বা 'ফাউন্ডেশন' নিয়ে গবেষণা করেছে প্রত্নতাত্ত্বিকরা। আবিষ্কৃত অন্যান্য প্রাচীন প্রসাধনী থেকে ভিন্ন এই শিশির উপাদানসমূহের মধ্যে সীসার পরিমাণ বেশ কম পাওয়া গেছে।
সীসা মাত্রায় কম হওয়ার কারণ হিসেবে গবেষকরা ধারণা করছে, লিপস্টিক প্রস্তুতকারিরা বিপজ্জনক এই পদার্থটি শরীরে প্রবেশ করার অপকারিতা বুঝতে পেরেছিল। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া এই বিষাক্ত ধাতু অসংখ্য স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
ভিডাল বলেন, "প্রসাধনীতে ব্যবহৃত সীসার বিষাক্ততার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একটি দীর্ঘ এবং জোরালো বিতর্ক রয়েছে।"
ভিডাল যে অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সাথে জড়িত ছিলেন সেই একই অঞ্চলে পূর্বে প্রাপ্ত আর্টিফ্যাক্ট বা নিদর্শনগুলোর উপর করা গবেষণা থেকে পাওয়া যায় যে, ৫ হাজার বছর আগে মুখের প্রসাধনী হিসেবে যে 'ফাউন্ডেশন' ব্যবহার করা হতো তার মূল উপাদান ছিল সাদা সীসা।
কিন্তু নতুন নিদর্শন হিসেবে প্রাপ্ত শিশিতে থাকা গাঢ় লাল রঙের প্রস্তুতপ্রণালীতে সীসার উপস্থিতির মাত্রা খুবই কম। সম্ভবত ঠোঁটের জন্য তৈরি এই লাল যৌগ বলতে গেলে এক প্রকার প্রায় সীসা মুক্ত। সীসার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার কাজটা হয়ত সচেতনভাবেই করা হয়েছিল বলে মনে করেন ভিডাল।
এই লিপস্টিকের প্রস্তুতি প্রণালীতে কোয়ার্টজ কণা রয়েছে। গবেষণায় ধারণা করা হয়, সম্ভবত সাধারণ বালি বা খনিজের স্ফটিক থেকে তা যোগ করা হয়েছে এতে।
লিপস্টিকে ঝিলমিলে বা চিকচিকে কিছু হিসাবে যোগ করা হয়। যদিও ক্লোরাইট নামের সবুজাভ পাথর থেকে সুক্ষ্মভাবে তৈরি করা হয়েছিল এই লিপস্টিকের শিশিটি। তাই চিকচিকে ভাব সেখান থেকেও আসতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
প্রসাধনীটির আসল ঘনত্ব ঠিক তরল না-কি আরো কঠিন ছিল তা নিয়ে সুস্পষ্ট কোন ধারণা নেই বলে জানায় ভিডাল।
তিনি বলেন, "শিশিটির সরু আকৃতি ও সীমিত পুরুত্ব থেকে বোঝা যায় যে, একে তামা বা ব্রোঞ্জের আয়নার হাতলসহ এক হাতে সুবিধাজনকভাবে ধরে রাখা যেত। যাতে করে অন্য হাতে ব্রাশ বা অন্য ধরনের কোন প্রয়োগকারী জিনিস ব্যবহার করা সম্ভব হয়।"
মূলত খ্রিষ্টপূর্ব ১২ শতকের একটি প্রাচীন মিশরীয় প্যাপিরাসে আঁকা একটি যুবতী নারীর ঠোঁট সাজানোর প্রক্রিয়া থেকেই এমন ধারণা পেয়েছেন গবেষকেরা।
ইরানের জিরফ্ট অঞ্চলের ব্রোঞ্জ যুগের সমাধি থেকে আবিষ্কৃত হাজার হাজার আইটেমের মধ্যে ছিল এই নিদর্শনটি। কবরগুলো 'মারহাসি' নামে পরিচিত এক প্রাচীন রাজ্যের অংশ ছিল। ২০০১ সালে এক বন্যার সময় এই কবরগুলোর খোঁজ পাওয়া যায়। স্থানীয়রা এখান থেকে মূল্যবান সব সামগ্রী লুট করে বিক্রি করে। পরবর্তীতে শিশিসহ অনেক পাথর ও তামার জিনিসপত্র উদ্ধার করে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী।
শিশিটি জিরফ্টের জাতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে রাখা আছে। এখান থেকেই গবেষক দলটি নমুনা সংগ্রহ করে।
ভিডাল বলেন, "একেবারে আকস্মিকভাবেই এই সভ্যতাটি আবিষ্কৃত হয়েছিল। ভয়ংকর এক বন্যা প্রাচীন এসব কবরস্থানে আঘাত করে। এতেই উন্মোচিত হয় প্রত্নতাত্ত্বিক সব সম্পদ। এখন এই অঞ্চলটি বেশ ভালোভাবে সুরক্ষিত। যদিও গুরুতর কিছু ক্ষতি ইতোমধ্যেই হয়ে গিয়েছে।"
ভিদাল আরও বলেন, "তবে এই মুহূর্তে আমরা এই সভ্যতা নিয়ে বেশ কিছু তথ্য জানি। এটি মেসোপটেমিয়ার মতো উন্নত এক সভ্যতা, যারা দূরদূরান্তের বাণিজ্য এবং সামরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে ধারণা করা হয়। তারা নিজস্ব লিখন পদ্ধতিও ব্যবহার করতো। এছাড়া বড় শহর এবং শক্তিশালী ও কর্তৃত্বশীল শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল এই সভ্যতা। আরো নতুন খননের মাধ্যমে বেরিয়ে আসছে বাকি ইতিহাস।"
এই লিপস্টিক কে বা কোন অবস্থায় ব্যবহার করতো তাও স্পষ্ট নয়। তবে ভিডাল বলেন, "আমরা যতদূর জানি, সেই সময়ের কবরে মৃত ব্যক্তির মুখের কাছাকাছি রাখা হতো এই ধরনের প্রসাধনী।"
তবে কবর লুট ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় গবেষকরা নিদর্শনটি কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির দেহাবশেষের সাথে সম্পর্কিত কি-না তা যাচাই করতে সক্ষম হয়নি।
অনুবাদ: জেনিফার এহসান