যেভাবে বাল্টিমোরে সেতুর সঙ্গে সংঘর্ষ হলো কার্গো জাহাজ ডালির
'তোমাদের একজন দক্ষিণ দিকে, আরেকজনকে উত্তর দিকে যাও। কি ব্রিজের দিকে যাওয়া সব গাড়ি থামাও। একটা জাহাজ এ মাত্র স্টিয়ারিং ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, ওটা ব্রিজের দিকে যাচ্ছে,' এক পুলিশ কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে সম্প্রতি একটি সেতুর গায়ে জাহাজের ধাক্কার পর সেতুটি ভেঙে পড়ে। ওই দুর্ঘটনায় জরুরিভিত্তিতে সেবাদাতা কর্মীদের একটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, বাল্টিমোরের সবচেয়ে বড় সেতু ফ্রান্সিস স্কট কি বিধ্বস্ত হওয়ার আগমুহূর্তে কীভাবে প্রত্যুৎপন্নমতির সঙ্গে কাজ করে বিরাট প্রাণহানি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন এ কয়েকজন কর্মকর্তা।
সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী জাহাজ ডালি'র মেডে কল শোনার পর সাড়া দেন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তারা সেতু অভিমুখী গাড়ি চলাচল বন্ধ করার কাজে নেমে পড়েন। প্রাথমিক সাড়ার দেড় মিনিটের মাথায় একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, 'সি-১৩ ডিসপ্যাচ! পুরো সেতুটি এ মাত্র ভেঙে পড়েছে!'
প্রথম অফিসার জিজ্ঞেস করেন, 'সব গাড়ি থামানো গিয়েছে? কেউ কিছু জানো?' উত্তরে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, 'অন্য পাশে যেতে পারছি না, স্যার, সেতু পড়ে গেছে।'
মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) মেরিল্যান্ডের গভর্নর ওয়েস মুর এ পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রশংসা করে বলেন: 'এরা হিরো। গতরাতে তারা অনেক প্রাণ বাঁচিয়েছেন।'
৯৮৪ ফুট দৈর্ঘ্যের কার্গো জাহাজ এমভি ডালি যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় রাত ১টার দিকে বন্দর ত্যাগ করে। ২৮ দিনের যাত্রায় এটির শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে যাওয়ার কথা ছিল।
বাল্টিমোরের ব্রিজ দুর্ঘটনার তদন্ত এখনো চলমান। জাহাজের ব্ল্যাক বক্স পাওয়া গেলে আরও বেশি তথ্য জানা যাবে। তবে এটা জানা গেছে যে, নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর জাহাজের নাবিকেরা স্থল কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন।
এছাড়া জাহাজটির মালিক সিনার্জি মেরিন প্রাইভেট লিমিটেড মেরিটাইম অ্যান্ড পোর্ট অথোরিটি অব সিঙ্গাপুর (এমপিএ)-কে জানিয়েছে যে, 'দুর্ঘটনার ঠিক আগ মুহূর্তে জাহাজটির সঞ্চলনশক্তি [প্রপালশন] কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল'।
'ফলে জাহাজটি নির্দিষ্ট গতিপথ ধরে রাখতে পারেনি এবং ফ্রান্সিস স্কট কি সেতুর সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে পড়ে,' এক বিবৃতিতে জানিয়েছে এমপিএ। এটি আরও জানিয়েছে, জরুরি পদক্ষেপের অংশ হিসেবে সেতুর গায়ে ধাক্কা লাগার আগে নোঙর ফেলেছিল জাহাজটি।
এমপিএ বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে, কার্গো জাহাজটি দুর্ঘটনার সময় বন্দরের এক বা একাধিক পাইলটের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বন্দরের পাইলটেরা বন্দরে জাহাজের প্রবেশ ও বহির্গমন নিরাপদ করতে জাহাজকে নির্দেশনা দেন।
দুর্ঘটনায় মোট ছয়জন মারা গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাহাজের ভেতর থাকা ২২ নাবিকের সবাই নিরাপদে আছেন।
সংঘর্ষের সময় সেতুর ওপর আটজন নির্মাণশ্রমিক কাজ করছিলেন। এল সালভাদর, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস ও মেক্সিকোর এ কর্মীদের নিয়োগ দিয়েছিল ব্রনার বিল্ডার্স নামক একটি কোম্পানি। দুর্ঘটনার মুহূর্তে সেতু থেকে সরার কোনো সতর্কবার্তা পাননি ওই শ্রমিকেরা।
উদ্ধারকারীরা পানি থেকে দুই শ্রমিককে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। একজন কোনো আঘাত পাননি, আরেকজনকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকি ছয়জন এখনো নিখোঁজ।
দুর্ঘটনার পর দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাওয়ায় এবং পানির তাপমাত্রা বিবেচনায় মার্কিন কোস্ট গার্ড তাদেরকে মৃত ধরে নিয়ে সক্রিয় উদ্ধার অভিযান বন্ধ ঘোষণা করেছে।
দুর্ঘটনার সময় জাহাজটি আট নট বা ঘণ্টায় প্রায় ১৫ কিলোমিটার বেগে চলছিল। স্থানীয় সময় রাত ১টা ২৭ মিনিটে জাহাজটি কোর্স পরিবর্তন করে অজানা কারণে সেতুর পিলারের দিকে যেতে শুরু করে। সেতুর কাছে যাওয়ার সময় জাহাজের বাতিগুলো জ্বলা-নেভা করছিল। এছাড়া জাহাজ থেকে গলগল করে কালো ধোঁয়া বেরোতেও দেখা যায়।
রাত ১টা ২৮ মিনিটে ভারী জাহাজটি পিলারের গায়ে ধাক্কা মারে। মাত্র ৩০ সেকেন্ড; তারপরই সব শেষ—পুরো সেতুটিই ধসে পানিতে পড়ে। সেতুর একটি অংশ জাহাজের ডেকে পড়লেও এতে কেউ হতাহত হননি।
সেতুটির সর্বশেষ সরকারি পরিদর্শন হয়েছিল জুন মাসে। সেখান সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছিল, সেতুর অবকাঠামো ভালো অবস্থায় আছে। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্সপোর্টেশন সেক্রেটারি পিট বাটিগিগ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'এত বড় কোনো জাহাজের সরাসরি আঘাত সামলে দাঁড়িয়ে থাকার মতো করে কোনো ব্রিজ কখনো বানানো হয়েছে বলে আমার জানা নেই।'
ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতু এখন পানিতে নৌযান চলাচলে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে বন্দরটি। কখন এ বন্দরে নৌযান চলাচল পুনরায় শুরু হবে তার কোনো সম্ভাব্য সময় জানাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশস সেফটি বোর্ড (এনটিএসবি) এ দুর্ঘটনার তদন্তের নেতৃত্ব দিচ্ছে। মঙ্গলবার বোর্ডের প্রেসিডেন্ট সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ২৪ জন বিশেষজ্ঞকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সিঙ্গাপুরের ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো এবং এমপিএ-এর তদন্তকর্তারা মার্কিন কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করতে বাল্টিমোরে যাচ্ছেন।
মার্কিন অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দাসংস্থা এফবিআই [ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন] জানিয়েছে, এ দুর্ঘটনা ইচ্ছাকৃত, তার কোনো ইঙ্গিত দেখতে পায়নি এটি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বলছেন, এখন পর্যন্ত সবকিছু বলছে, এটি একটি 'ভয়ংকর দুর্ঘটনা' ছিল এবং এটি ইচ্ছাকৃত তা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
চিলির নৌবাহিনী ২০২৩ সালের জুনে চিলির একটি বন্দরে এমভি ডালি জাহাজটি পরিদর্শন করে। সেখানে জাহাজের 'প্রপালশন ও সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতিতে' সমস্যা দেখতে পায় এটি।
এ সমস্যার কারণে জাহাজরে গেজ ও থার্মোমিটার ঠিকমতো কাজ করছিল না। জাহাজ বন্দর ছাড়ার আগে সেগুলো ঠিক করা হয়।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে জাহাজটির সর্বশেষ পরিদর্শন হয়। তখন জাহাজের কোনো ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যায়নি।