যে কারণে বাইডেন প্রশাসন থেকে পদত্যাগ করেন এই কূটনীতিক
অভিজ্ঞ মার্কিন কূটনীতিক হালা রারিত প্রথম কূটনীতিক যিনি মার্কিন নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন। তার এ সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনি ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, কিছু মার্কিন নীতির জন্য "আরব বিশ্বের একটি প্রজন্ম ওয়াশিংটনের ওপর তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।"
তিনি আরো বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলে অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা দেয়া অব্যাহত রাখায় সেটি একটি মানবিক সংকট তৈরি করছে এবং আরব বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেছেন, স্টেট ডিপার্টমেন্টের অভ্যন্তরে কূটনীতিকরা আনুষ্ঠানিক নীতিমালার বিরুদ্ধে গিয়ে বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে ভয় পান। অথচ শক্তিশালী আলোচনাই সেখানে মূল আদর্শ হতে পারতো।
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এটিকে অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে তার পদত্যাগের সুনির্দিষ্ট বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, তিনি ভিন্নধর্মী মতামতকে স্বাগত জানান।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন হামাসকে ইসরায়েলের প্রস্তাবিত সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি-মুক্তি চুক্তি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। হামাসের রাজনৈতিক দপ্তরের চেয়ারম্যান ইসমাইল হানিয়াহ এক বিবৃতিতে বলেছেন, হামাস মিশরের আয়োজিত আলোচনাকে 'ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি' থেকে দেখে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সংকট মোকাবেলার পদ্ধতি নিয়ে রারিতের সমালোচনা ওয়াশিংটনের ভেতরের গভীর বিভাজনকে তুলে ধরে। এমনকি মধ্যপন্থি ডেমোক্র্যাটরাও গাজায় ইসরায়েলের পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে এবং পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সামরিক সাহায্য বন্ধ করার কথা ভাবছে।
সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভ চলছে। ব্লিঙ্কেন যখন যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেন এবং ফিলিস্তিনিদের আরও সাহায্য পাঠান, তখন ইসরায়েলি নেতারা পরিণতি যাই হোক না কেন রাফাহ আক্রমণ করতে চান। এটি এমন একটি পদক্ষেপ যা বাইডেন এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের কাছে ধ্বংসাত্মক মনে হচ্ছে।
রারিত যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটি তাকে একাই করতে হয়েছে কারণ তার অধিকাংশ সাবেক সহকর্মী মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পান। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, তার সহকর্মীরা মনে করে যে নীতির বিরুদ্ধে কথা বললে স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিবে।
বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলকে ক্রমাগত অস্ত্র সরবরাহের নির্দেশ দিয়েছে যেখানে ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা ত্রাণকর্মী, শিশু ও অন্যান্য বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা ও তাদের নিহত হওয়ার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, চলমা যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৩৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
মার্কিন প্রশাসনের নীতির প্রতিবাদে স্টেট ডিপার্টমেন্টের আরো দুজন কর্মচারী পদত্যাগ করেছিলেন। একজন হলেন সাবেক বেসামরিক কর্মচারী জশ পল যিনি বিদেশি সামরিক সহায়তায় কাজ করেছিলেন এবং অন্যজন অ্যানেল শেলিন যিনি ব্যুরো অফ ডেমোক্রেসি, হিউম্যান রাইটস এন্ড লেবারের পররাষ্ট্র বিষয়ক কর্মকর্তা হিসাবে এক বছর কাজ করেছিলেন।
রারিত বলেছিলেন, "আমি ভেতর থেকে জিনিসগুলো পরিবর্তন করার ব্যাপারে বিশ্বাসী। আমি কূটনীতির মাধ্যমে ভালো করার শক্তিতে বিশ্বাস করি। আমি এখনো এটিতে বিশ্বাস রাখতে চাই।" তিনি গত সপ্তাহ পর্যন্ত স্টেট ডিপার্টমেন্টের দুবাই-ভিত্তিক আরবি ভাষার মুখপাত্র ছিলেন।
তিনি আরো বলেছেন, "অনেক আলোচনার পরে শেষ পর্যন্ত এটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, বিভাগের অভ্যন্তরে সচিব ছাড়া কোনো ফরেন সার্ভিস অফিসার সত্যিকার অর্থে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।"
নেভাডা এবং ক্যালিফোর্নিয়াতে বেড়ে ওঠা রারিত জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং মধ্য প্রাচ্য গবেষণা নিয়ে অধ্যয়ন শেষ করেই স্টেট ডিপার্টমেন্টে যুক্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, "আমি আমার দেশকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। আমি অন্য দেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী করতে চেয়েছিলাম।"
কর্মজীবনে তিনি কাতারে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে অর্থায়নের ব্যবস্থা করা, দক্ষিণ আফ্রিকার ভয়াবহ চরমপন্থা বন্ধ করার কাজে নিয়োজিত থাকার পাশাপাশি এবং ইয়েমেনে রাজনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
কিন্তু অক্টোবরের শুরুতে রারাত বলেছিলেন, তিনি গাজা সম্পর্কে আরব সংবাদ মাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলে কারণ তিনি অনুভব করেছিলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বললে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়ে আরো উত্তপ্ত হবে।
তিনি বলেছিলেন, "তারা (মার্কিন প্রশাসন) প্রায়ই ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করত। প্রথম দিকে শুধু 'ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে' এটাই বলতো। হ্যাঁ, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার কোনো উল্লেখ ছিল না। আমার বিবেকের দংশন থেকে আমি আরব টেলিভিশনে কথা বলতে যেতে পারতাম না।"
তিনি বলেন, "আমি চাই না আমার কথা শুনে কেউ আমেরিকাকে আরো বেশি ঘৃণা করুক।" রারিত ভয় পেতেন হয়ত যুদ্ধের জন্য অভিভাবক হারানো কোন ফিলিস্তিন শিশু হয়ত 'শেষমেশ প্রতিশোধ নিতে হাতে অস্ত্র তুলে নিবে'। তিনি বলেন, "আমরা প্রজন্মভিত্তিক প্রতিশোধের ব্যবস্থা করে দিয়েছি যা থেকে ইসরায়েল কখনোই নিরাপদ থাকতে পারবে না।"
গাজা নীতি সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দেওয়ার পরিবর্তে রারিত মার্কিন নীতির প্রচারণার ব্যাপারে অভ্যন্তরীণভাবে রিপোর্ট করার জন্য আরবি ভাষার সংবাদমাধ্যম পর্যবেক্ষণ করা সহ তার অন্যান্য কাজগুলোতে মনোনিবেশ করেছিলেন।
তিনি বলেন, "আমি প্রতিদিন আরব দেশে ভাইরাল হওয়া মৃত শিশুদের ছবি দেখতাম। কীভাবে এগুলো মানুষ হিসেবে, একজন মা হিসেবে আপনাদের গায়ে লাগতো না? এবং আমাদের বোমা হামলাতেই তারা মারা যাচ্ছে এটা ভেবে আমার আরো খারাপ লাগতো। আমরা এখনো আরো অস্ত্র পাঠাচ্ছি কারণ আমাদের ধারোনা এটাই সমাধান। এটা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই না। আমাদের দরকার পররাষ্ট্র নীতি, অস্ত্র না।"
স্টেট ডিপার্টমেন্টের অভ্যন্তরে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির সমালোচনা করা কঠিন কাজ। তিনি জানিয়েছেন, কুটনীতিকদের মধ্যে এর বেশি 'ভয় এবং অস্বস্তি' তিনি আগে কখনো দেখেননি। তিনি বলেছিলেন, তিনি আরব-আমেরিকান হওয়ার কারণে তার সহকর্মীরা তাকে ভিন্ন চোখে দেখত।
কিছু বিপরীত মতামত প্রশাসনের ভেতরে দেখা গেছে। অনেক কূটনীতিক প্রতিশোধের ভয় ছাড়াই সরকারি নীতির বিরুদ্ধে আপত্তি জানানোর জন্য স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভিন্নমত চ্যানেল ব্যবহার করেছেন। ব্লিঙ্কেন তাদের কয়েকজনের সাথে দেখা করেছেন এবং ভিন্নমতকে সম্মান দেখানোর কথা বলেছেন। ইউএস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের কর্মচারীরা প্রশাসক সামান্থা পাওয়ারকে (যিনি গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করেছেন) অনুরোধ করেছিলেন, মার্কিন নীতিতে পরিবর্তন আনার বিষয়ে চাপ দেয়ার জন্য।
রারিতের পদত্যাগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল এটিকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি ভিন্নমতের চ্যানেলের গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে বলেছিলেন, স্টেট ডিপার্টমেন্টের সচিব শক্তিশালী নীতিনির্ধারণের সুবিধার্থে প্রতিটি ভিন্নমতের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা করেন।
রারিত ভিন্নমত চ্যানেলের কার্যকারিতা সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন, এটি মূলত প্রতীকী যার মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করার কোন ক্ষমতা নেই।
তিনি কূটনীতিকদের কর্মজীবনে মানুষ কীভাবে তাদের কথায় প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটি ভেবে ভয় পেতে দেখেছেন। স্টেট ডিপার্টমেন্টের মধ্যে মার্কিন নীতির বিষয়ে অর্থপূর্ণ কথোপকথনের অভাব লক্ষ্য করেছেন রারিত যেটি তার ১৮ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়