সহসাই কীভাবে খারকিভের দিকে এগোতে পারল রুশ সেনারা
যুদ্ধে সবসময়েই অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে আভদিভকা দখলে নেয় রাশিয়া। এই সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে রুশ বাহিনী পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে তাদের গ্রীষ্ম বা বসন্তকালীন আক্রমণ অভিযান শুরু করবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। যদিও এটা এখনো যেকোনো সময়েই ঘটতে পারে, কিন্তু তারমধ্যেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রুশ সেনারা ইউক্রেনের উত্তরপূর্বের খারকিভ অঞ্চলে অপ্রত্যাশিত এক আক্রমণ শুরু করেছে।
মাত্র কয়েক দিনেই রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্ত দিয়ে পাঁচ ব্যাটালিয়ন রুশ সেনা খারকিভ অঞ্চলের ভেতরদিকে প্রায় পাঁচ মাইল এগিয়েছে। দখলে নিয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রাম। চকিত এই আক্রমণের মুখে ইউক্রেনের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের দ্রুত পিছু হটতে হয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এটাই হয়তো রুশ বাহিনীর সবচেয়ে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার ঘটনা।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা প্রধান কিরিলো বুদানভ এ পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, (ইউক্রেনের সেনারা) 'কোণঠাসা' হয়ে পড়ার মুখে, (পরিস্থিতি) ক্রমশ 'গুরুতর হচ্ছে'।
রুশ সেনারা যদি এভাবে এগোতেই থাকে, তাহলে খুব শিগগিরই তাঁদের কামানের পাল্লার মধ্যে চলে আসবে খারকিভ শহর। ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহরে গত মার্চে যখন যাই, তখনই দেখেছিলাম কামানের গোলা কী মারাত্মক ধবংসের হাতিয়ার।
২০২২ সালের রুশ আক্রমণের সময় ধবংস হওয়া ভবন আর স্থাপনা দেখেই এটা বুঝতে পারছিলাম। ওই আক্রমণের চাক্ষুষ প্রমাণ দেখেছি খারকিভ শহরের পরিত্যক্ত অনেক বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট এবং শহরের উপকন্ঠের এলাকায়। তাই আবারও আর্টলারির আক্রমণের শিকার হলে ভয়াবহ অবস্থা হবে শহরটির।
তার চেয়েও বাজে পরিস্থিতি হবে খারকিভের পতন হলে। তেমনটা ঘটার সম্ভাবনা কম হলেও – শহরটিকে রক্ষায় ডনবাসের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সেনা আনতে হচ্ছে ইউক্রেনকে। ফলে ওই অঞ্চলে অগ্রসর হওয়াটা সহজ হবে রাশিয়ার জন্য। এই অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে, সহসাই এই সাফল্য কীভাবে পেল রুশরা? ব্যাখ্যা হচ্ছে, এটি রাশিয়ার সামরিক দক্ষতা এবং ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের করা ভুলগুলোরই সামষ্টিক পরিণতি।
যুদ্ধের শুরুর দিকে লড়াইয়ের সক্ষমতা ও সামর্থ্যে দুর্বলতা ছিল রুশ বাহিনীর, যা তারা বর্তমানে কাটিয়ে উঠেছে। তাদের যুদ্ধ কৌশলেও হয়েছে উন্নতি। যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে উদ্যোগ নেওয়া শিখেছে। যেমন ইউক্রেনের প্রতিরোধ সারির দিকে এগোতে তাঁরা মোটরসাইকেল ব্যবহার করছে। এতে অপেক্ষাকৃত ধীরগতির ভারী ট্যাঙ্ক বা সাঁজোয়া যানের চেয়ে দ্রুত এগোতে পারছে। ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যানগুলোকে সহজেই ড্রোন দিয়ে ধবংস করতে পারে ইউক্রেনীয়রা।
আবার গ্লাইড বোমা নিক্ষেপ করে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষার লাইন। আর রুশ বাহিনী তাঁদের নিজস্ব ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ব্যবস্থার সাহায্যে ইউক্রেনীয় ড্রোন ও রকেট জ্যাম করছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সরঞ্জাম পেতে দীর্ঘ দেরীর ফলে অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে ইউক্রেনীয় বাহিনীর সক্ষমতা। এরমধ্যে গোলাবারুদের অভাবই সবচেয়ে বড় বিষয়। তারা যদি একটি গোলা ছোড়ে, তাহলে রাশিয়া ছুঁড়ছে ১০টি।
ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেপণাস্ত্র মজুতও তলানিতে ঠেকেছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদন বলছে, "গেল ছয় মাসে প্রায় ৪৬ শতাংশ রুশ মিসাইল প্রতিরোধ করেছে ইউক্রেন, সে তুলনায় আগের ছয় মাসে এই হার ছিল ৭৩ শতাংশ… গত মাসে প্রতিরোধ হার ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে।"
যুদ্ধের সম্মুখভাগের সেনাদের বিমান হামলা থেকে রক্ষা করতে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিকল্প নেই। কিন্তু, ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্রের অভাবে ইউক্রেন তাঁদের যথেষ্ট নিরাপত্তা দিতে পারছে না। এই সুযোগে রাশিয়ার বিমানবাহিনী বর্তমানে উল্লেখযোগ্যভাবে হামলার মাত্রা বাড়িয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পরে প্রথমবারের মতো বিমান থেকে আক্রমণে এতোটা সফল হচ্ছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার প্যাকেজ অনুমোদনের পর অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান পেতে শুরু করেছে ইউক্রেন। ৬১ বিলিয়ন ডলারের এই প্যাকেজের আওতায় ইউক্রেনের সব বাহিনীই যুদ্ধ সরঞ্জাম পাবে। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহের জন্য কয়েক মাস লাগতে পারে। মাঝখানে ইউক্রেনের যে দুর্বল দশা – সেটারই সুযোগ নিচ্ছে রাশিয়া।
লেখক: আমেরিকার চিন্তক সংস্থা কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স এর সিনিয়র ফেলো হচ্ছেন ম্যাক্স বুট। তিনি ওয়াশিংটন পোস্টের একজন কলাম লেখক এবং পুলিৎজার পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত মনোনয়নও পেয়েছিলেন।
অনুবাদ: নূর মাজিদ