কাক মোট চার পর্যন্ত গুনতে পারে: নতুন গবেষণা
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, কাক মোটামুটি এক থেকে চার পর্যন্ত গুনতে পারে।
জার্মানির টুবিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল ফিজিওলজি ল্যাবের একদল গবেষকের করা এই গবেষণায় জানা গেছে, আশ্চর্য এই প্রাণী কেবল গুনতেই পারে না, এক থেকে চারের মধ্যে সংখ্যার পার্থক্যও বুঝতে পারে তারা। তবে চার-এর বেশি পরিমাণের ক্ষেত্রে গুলিয়ে ফেলে কাকেরা।
কাকের সংখ্যা চেনা এবং গণনা প্রক্রিয়া মানুষের মতোই। মানুষ ও কাক উভয়ই শিশুকালে গণনা করতে এবং খুব দ্রুত চারপাশের সব বস্তু শনাক্ত করতে শেখে। বলা যায়, কাকের একধরনের নাম্বার-সেন্স বা সংখ্যা-বোধ আছে। তাই তারা এক, দুই,তিন, চার পর্যন্ত বুঝতে পারে। এরপর যা-ই আসুক তা তাদের জন্য 'বেশি' হয়ে যায় এবং তারা বিভ্রান্ত হয়ে যায়।
বৃহস্পতিবার সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণার ফলাফলে আমাদের কাকের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানতে সহায়তা করেছে।
ম্যাসাচুসেটসের উইলিয়ামস কলেজের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক ও প্রাণী বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ হিদার উইলিয়ামস বলেছেন, 'শুধু মানুষই সংখ্যাগত ধারণা, বিমূর্ততা, সরঞ্জাম তৈরি এবং আগাম পরিকল্পনার মতো দক্ষতা কাজে লাগায় না; কাকেরাও যথেষ্ট 'স্মার্ট'।
প্রাণীজগতে শুধু কাকই গণনা করতে পারে তা কিন্তু নয়। মানুষের মতো শিম্পাঞ্জিরাও তাদের শিশুদের ক্রমানুসারে গণনা করতে এবং সংখ্যার মান বুঝতে শেখায়।
এছাড়া, সঙ্গীকে আকৃষ্ট করতে কিছু পুরুষ ব্যাঙ তার প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাঙটি কতবার ডাকছে তা গুনে রাখে, তারপর যখন তার পালা আসে সে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর সমান বা তারচেয়ে একবার বেশি ডেকে নারী ব্যাঙটিকে মুগ্ধ করতে চায়।
বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, পিঁপড়ারা কত পা হাঁটছে তা গুনে গুনে ফের তাদের বাসস্থানে ফিরে আসে। তবে এই পদ্ধতিটি সবসময় সঠিক হয় না।
কাক কি শিশুর মতো গণনা করতে পারে?
সর্বশেষ গবেষণায় দেখা গেছে, মানব শিশুর মতো কাকেরাও সংখ্যার মান বুঝতে এবং জোরে জোরে গণনা করতে পারে।
গবেষকদলের প্রধান এবং টুবিঙ্গেন ল্যাবের জ্যেষ্ঠ গবেষক ডায়ানা লিয়াও বলেন, শিশুদের গণনা শেখার পদ্ধতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে এই গবেষণা করা হয়েছে। নতুন নতুন গুনতে শেখার পর বাচ্চারা তাদের সামনে থাকা সব বস্তুর সংখ্যা গণনা করে। যেমন: যদি তাদের সামনে তিনটি খেলনা থাকে তাহলে তারা 'এক, দুই, তিন' বা 'এক এক এক' এভাবে গণনা করে। তারা এক দেখায় বুঝতে পারে না এখানে তিনটি খেলনা আছে।
শিশুদের এই গণনা পদ্ধতিতে অনুপ্রাণিত হয়েই লিয়াও গবেষণায় উদ্বুদ্ধ হন।
কতবার ডাকবে শুরুতেই তার সংখ্যা নির্ধারণ করে নেয় কাকেরা
লিয়াও এবং তার সহকর্মীরা ১৬০টিরও বেশি সেশনে আমেরিকান কাকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত একটি ইউরোপীয় প্রজাতির তিনটি ক্যারিয়ন ক্রোকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।
প্রশিক্ষণ চলাকালীন পাখিগুলোকে ১ থেকে ৪ পর্যন্ত সংখ্যা লেখা দেখে সে কয়বার ডাকতে শেখানো হয়।
যেমন: গবেষকরা উজ্জ্বল নীল রঙে লেখা সংখ্যা দেখায় এবং স্পিকারে সেই সংখ্যার সমান ডাক শোনানো হয়, এরপর ১০ সেকেন্ডের মধ্যে তাদের সে কয়বার ডাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়। বারবার এভাবে করে কোন সংখ্যা আসলে কয়বার ডাকতে হবে কাকগুলোকে তা শেখানো হয়েছিল। দেখা যায় খুব ভালোভাবেই কাকগুলো কোন সংখ্যা দেখে কয়বার ডাকতে হবে, তা বুঝে যায়।
স্পিকারে ডাক শোনা এবং সেই অনুযায়ী সমান সংখ্যক বার ডাকার পর কাকগুলো টাচস্ক্রিনে 'এন্টার' কি-তে ঠোকর দিত। এতে বোঝা যেত তারা বোঝাতে চাইছে তাদের কাজটি শেষ। পাখিগুলো সঠিক সংখ্যা অনুযায়ী ডাকতে পারলে তাদের একটি করে ট্রিট দেওয়া হতো।
দেখা যায়, স্পিকারে ডাকের সংখ্যা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাকগুলো চুপ করে থাকত, সবগুলো ডাক শেষ হওয়ার পরে তারা একবারে ডাকা শুরু করত। অর্থাৎ, কাকেরা প্রথমে পরিকল্পনা করে নেয় তারা কতবার ডাকবে, এরপর ডাকতে শুরু করে।
লিয়াও লিখেছেন, এতে বোঝা যায় যে কাকগুলো তাদের ঠোঁট খোলার আগেই কতবার ডাকবে তা পরিকল্পনা করে নেয়।
এমনকি সূক্ষ্ম ধ্বনিগত পার্থক্য পর্যবেক্ষণ করে তাদের প্রথম কা ডাকের ধ্বনি শুনেই গবেষকেরা বুঝতে পারতেন পাখিটি কতবার ডাকার পরিকল্পনা করে ডাক শুরু করেছে।
উইলিয়ামস বলেন, 'তারা বিমূর্ত সংখ্যা বোঝে ... এবং সংখ্যা দেখার পরে তার মান অনুযায়ী সেই কয়বার ডাকার পরিকল্পনা করে।'
তিনি বলেন, 'এমনকি কাকেরা নিজেদের ভুল শনাক্ত করতে পারছিল। দেখানো সংখ্যার চেয়ে বেশিবার ডেকে ফেললে তাৎক্ষণিক তারা বুঝে ফেলত, কারণ অতিরিক্ত ডাকগুলোতে ধ্বনিগত পার্থক্য দেখা যেত। এমনকি সংখ্যা দেখে বুঝতে না পারলে একই ধ্বনিতে তারা তোতলাতো বা তাদের মুখ থেকে অপূর্ণ ডাক ডাকতো।
উইলিয়ামস বলেন, 'মানুষও এ ধরনের ভুলে একই রকম আচরণ করে।'
আমরা এখনও জানার চেষ্টা করছি কাক কতটা বুদ্ধিমান প্রাণী
আগে ভাবা হতো পাখি এবং অন্যান্য অনেক প্রাণী শুধুমাত্র তাদের আশেপাশের পরিবেশের উদ্দীপনার উপর ভিত্তি করে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়।
বিংশ শতাব্দীর প্রাণী আচরণবিদ বি.এফ. স্কিনার এই তত্ত্বটিকে জনপ্রিয় করেছিলেন।
কিন্তু লিয়াও এবং তার সহকর্মীদের সাম্প্রতিক গবেষণায় কাকের সংখ্যাকে অনুধাবন করে শব্দ তৈরির ক্ষমতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
এছাড়া বোঝা যায় শুধু তাৎক্ষণিক উদ্দীপনা নয়, তারা কিছু দক্ষতা অর্জন করে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তার ব্যবহারও করতে পারে।
নিউইয়র্কের ইথাকায় কর্নেল ল্যাব অব অর্নিথোলজির গবেষক কেভিন ম্যাকগোয়ান বলেন, এই গবেষণার ফলাফল অত্যন্ত সুস্পষ্ট, তবে এটি একসময়ের সাধারণ বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করছে। একসময় ভাবা হতো সব প্রাণী শুধু তাৎক্ষণিক উদ্দীপনা অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখায়।
ম্যাকগোয়ান দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বন্য কাক নিয়ে গবেষণা করেছেন। তবে তিনি এই গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না।
ম্যাকগোয়ান সিএনএনকে বলেছেন, গবেষণাটি প্রমাণ করে যে কাক শুধু তার পারিপার্শ্বিক উদ্দীপনা অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া জানানো সরল, বুদ্ধিহীন কোনো যন্ত্র নয়। তারা আগাম চিন্তা করে এবং একটি কাঠামোবদ্ধ ও পূর্বপরিকল্পিত উপায়ে যোগাযোগ করার ক্ষমতা রাখে।'
ম্যাকগোয়ান বলেন, কাকের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেশ কয়েক দশক ধরে গবেষণা করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা নিউ ক্যালেডোনিয়ান কাকদের তাদের নিজস্ব যৌগিক সরঞ্জাম তৈরি করে তা খাবার সংগ্রহ করার ক্ষমতা নিয়ে গবেষণা করেছেন।
তিনি জানান, ২০১৩ সালের নভেম্বরের একটি গবেষণায় জানা যায়, কাক নির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করে এবং সেসব নিয়ম মেনে চলে। এই গবেষণায় তার সহকারী ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব টুবিঙ্গেন ল্যাবের প্রধান গবেষক আন্দ্রেয়াস নিডার।
সেই গবেষণায় জানা যায়, ব্যাপকভাবে পরিবর্তনশীল স্বর এবং অভিব্যক্তির কারণে বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা কাকের ভাষা বুঝতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছেন।
প্রাণী জ্ঞান বিশেষজ্ঞ আইরিন পেপারবার্গ বলেছেন, কাক সংখ্যার মান বুঝতে পারে কি না তা নিয়ে লিয়াও এবং তার সহকর্মীদের গবেষণাটিই প্রথম না। ১৯৬৮ সালে নিকোলাস থম্পসন প্রথম এই গবেষণা শুরু করেন।
থম্পসনই প্রথম ধারণা করেছিলেন যে কাক সংখ্যার মান বুঝতে পারে।
তিনি লিখেছেন, কাকের গণনার ক্ষমতা শুধু 'প্রকৃতিতে টিকে থাকার প্রয়োজনীয়তার চেয়েও বেশি কিছু বলে মনে হয়।'
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি