যদি ইরানের কাছে এরমধ্যেই পারমাণবিক বোমা থাকে!
মধ্যেপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ইরান, দেশটি প্রায়ই নানান ঘটনার ধারাবাহিকতায় সংবাদের শিরোনামে থাকছে। বিশেষত গত কয়েক মাসে ইরানকে কেন্দ্র করে ঘটেছে চাঞ্চল্যকর সব ঘটনা/ দুর্ঘটনা। এরমধ্যে পাকিস্তান ও ইসরায়েলের সাথে পাল্টাপাল্টি হামলা থেকে শুরু করে – হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিহত হওয়ার মতো লোহমর্ষক ঘটনা তো ছিলই। কিন্তু, সবচেয়ে গুরুতর পরিবর্তন হয়তো ঘটেছে- লোকচক্ষুর আড়ালে। খুবই সঙ্গোপনে।
গোপন এমন একটি পরিবর্তন, যা বেশ দেরীতে সবাই লক্ষ করছে তা হলো – ইরানের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিনের নীতি থেকে সরে এসে – এখন প্রকাশ্যেই পারমাণবিক বোমা তৈরি এবং এর পরীক্ষা চালানোর হুমকি দিচ্ছেন।
এ মাসের শুরুর দিকে, ইরানের সাবেক একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল খারাজি বলেছেন, তাঁর দেশের একটি (পরমাণু) বোমা তৈরির সামর্থ্য আছে। অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার মতো বিপদ দেখা দিলে, পরমাণু নীতির পরিবর্তন হতে পারে।
গত ৯ মে আল জাজিরা অ্যারাবিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে খারাজি বলেন, "ইসরায়েল যখন অন্য দেশগুলোকে হুমকি দিচ্ছে, তখন তারাও নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না।"
এটা যে নিছক ফাঁপাবুলি নয়, তা বুঝিয়ে দিতে তেহরানে অনুষ্ঠিত এক ইরান-আরব সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন তিনি।
কামাল খারাজি নেহাত কোনো কূটনীতিক নন। ইরানের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান তিনি। এই পরিষদ সরাসরি রিপোর্ট করে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা– আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির কাছে।
ইরানের ইসলামি পরামর্শক পরিষদ (মজলিস) এবং গার্ডিয়ান কাউন্সিলের মধ্যে বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তিতে ভূমিকা পালন করা এক্সপেডিয়েন্সি কাউন্সিলেও খারাজিকে নিয়োগ দিয়েন খামেনি। সুতরাং, সর্বোচ্চ নেতার অনুমোদন নিয়েই তিনি একথা বলেছেন, এমনটা ধরে নেওয়ার জোরালো কারণ আছে।
পরমাণু বোমার মতো গণবিধ্বংসী অস্ত্র ইসলামি মূল্যবোধের পরিপন্থী, বরং শান্তিপূর্ণ বেসামরিক উদ্দেশ্যে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে – এমন অবস্থান তেহরান বারবার তুলে ধরেছে। সেই মূল্যবোধ থেকে সরে এসে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতেও পারে– ইরানি কর্মকর্তাদের এমন সম্ভাবনার কথা প্রকাশ্যে বলাটা এককথায় পর্বতসম পরিবর্তন।
২০০২ সালে ইরানের অত্যন্ত গোপন পারমাণবিক কর্মসূচির সন্ধান পায় পশ্চিমা গোয়েন্দারা। তখন থেকে ইরানের সরকার প্রধানেরা বারবার বলে এসেছেন, এই কর্মসূচি বেসামরিক, এবং এর সামরিক কোনো উদ্দেশ্য নেই। এমনকী খামেনি এর আগে দাবি করেছিলেন, তিনি ফতোয়া জারি করে, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি বা এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছেন। তবে প্রবাসী ইরানি সাংবাদিক ও আটলান্টিক কাউন্সিলের সদস্য খসরু ইসফাহানির মতে, এধরনের কোনো নির্দেশনা আদৌ জারি হয়েছিল কিনা– তার কোনো প্রমাণ নেই।
এই ফতোয়ার মধ্যেও ফাঁক রয়েছে। কারণ শিয়া ইসলামে আয়াতুল্লাহ বা সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতাদের বেশিরভাগ ফতোয়া বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে। ফলে 'এবিষয়ে ফতোয়া থাকায় আমরা কখনো (পরমাণু) বোমা বানাতে পারব না' এই দাবি এমনকী ধর্মীয় বিধানের দিক থেকেও দুর্বল ছিল।
ইরানের কর্মকর্তারা বারবার ফতোয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে, পারমাণবিক বোমা তৈরিকে একটি নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও শক্তিধর অন্য পাঁচটি দেশের সাথে আলোচনার সময়েও এই ধারণা দেওয়া হয়েছে। ফলে ২০১৫ সালে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বিশ্বশক্তিগুলোর সাথে ঐতিহাসিক এক চুক্তি হয়েছিল। ২০১৮ সালে এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরপর নবউদ্যোমে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরুও করে ইরান, তখনো কিন্তু এ ধরনের হুমকি দেওয়া হয়নি।
কিন্তু গত দু-তিন বছর ধরে প্রচ্ছন্ন পারমাণবিক হুমকি দিতে শুরু করেছেন ইরানি কর্মকর্তারা। ২০২১ সালে ইরানের তৎকালীন গোয়েন্দাবিষয়ক মন্ত্রী মাহমুদ আলাভি বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো ইরানকে কোণঠাসা করে ফেললে– ইরানও মরিয়া আচরণই দেখাবে। "তারা যদি আমাদের সেদিকে নেয়, সেটা আমাদের দোষ নয়" – নিজ দেশের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েই একথা বলেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে এসে হুমকির সেই প্রচ্ছন্নভাবও দূর হয়েছে। এখন দেশটির একাধিক কর্মকর্তা সরাসরি পরমাণু বোমা তৈরির সম্ভাবনার কথা বলছেন খারেজির মতো করে। তাঁদের কেউ কেউ দাবি করেছেন, ইরান চাইলে এ মুহূর্তেই বোমাটি তৈরি করতে পারবে। এরা হচ্ছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা সামরিক ইউনিটের প্রধান, একজন আণবিক পদার্থবিদ এবং ইরানের পরমাণু সংস্থার সাবেক এক প্রধান।
সবচেয়ে মারাত্মক দাবিটি হচ্ছে, ইরানের কাছে পারমাণবিক বোমা ইতোমধ্যেই রয়েছে, কেবল তা পরীক্ষা করা হয়নি। গত ১০ মে এমন দাবি করেছেন, দেশটির পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটির সাবেক এক সদস্য।
গত মাসে ইসরায়েল সিরিয়ার দামাস্কাসে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা করে। এই ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। এসময়ে ইরানের শাসকগোষ্ঠীর সমর্থকরা যেসব মন্তব্য করেছেন, তা আগে ছিল কল্পনাতীত।
এমন একজন বিশ্লেষক বলেন, জাতিসংঘ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে, "পারমাণবিক কর্মসূচি বিষয়ে সমস্ত আলোচনা থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত ইরানের এবং সুন্দর ইরানি বালকটিকে এবার সামনে আনা উচিত।" ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমায় লিটল বয় নামের যে আণবিক বোমাটি নিক্ষেপ করেছিল– ইরানি বিশ্লেষকের 'বালক' উক্তি ছিল এ ইঙ্গিত দিয়ে।
ইরানের একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্কের প্রধান মেহদি খারাতিয়ান সম্প্রতি বলেছেন, "পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যদি মনে করে, যেকোনো পরিস্থিতিতেই ইরান একটি বোমা তৈরির দিকে এগোবে না, তাহলে ভুল করবে।" দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমগুলোও এখন আলী খোমেনির 'কৌশলগত সংযমের' নীতি নিয়ে আলোচনা করছে, যেখান থেকে দেশটি এখন সক্রিয় প্রতিরক্ষার দিকে এগোচ্ছে বলে আভাস দিচ্ছে তারা।
এসব আলোচনা নেহাত ধোঁকা নাকি ইরানের নাকি সামরিক নীতির প্রকৃত পরিবর্তন– বিশেষজ্ঞদের মধ্যে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে বোঝাটা পশ্চিমাদের কাছে বরাবরই দুরূহ ছিল– এক্ষেত্রেও তাই। প্রকৃত ঘটনা বুঝতে, ইরানি শাসকগোষ্ঠীর হুঙ্কারের সাথে প্রকৃত সামর্থ্যের পার্থক্যটা জানতে হবে। অবশ্য শাসকগোষ্ঠীর প্রকৃত উদেশ্য যাই হোক– তাঁদের ধারাভাষ্যের এই পরিবর্তনও নিঃসন্দেহে গুরুত্ব সহকারে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলীর পর্যবেক্ষক মাত্রই জানেন, ইরানের শাসকগোষ্ঠীর মৌলিক আদর্শে রয়েছে জায়নবাদী ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিনাশ। নিহত ইরানি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসির জানাজায় দেওয়া বক্তব্যেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরো কঠোর পরিণতির হুমকি দিয়েছেন খামেনি। তিনি হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়ার সাথেও বৈঠক করেন। বিশ্ব ইসরায়েলের অস্তিত্বের বিলুপ্তি এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেখবে বলে এসময় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন খামেনি।
পরমাণু শক্তিধর ইরান হবে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও পশ্চিমা স্বার্থের জন্য গুরুতর এক হুমকি। তবে ভূরাজনীতির বাস্তববাদী তাত্ত্বিক কেনেথ ওয়ালজের মতে, এতে মধ্যপ্রাচ্য আরো স্থিতিশীল হবে।
মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের উদ্দেশ্য বা স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করবে শক্তির এই নয়া ভারসাম্য।
দ্য আটলান্টিক থেকে পরিমার্জনা ও সংক্ষিপ্ত ভাবানুবাদ: নূর মাজিদ
লেখক: আরশ আজিজি যুক্তরাষ্ট্রের ক্লেমসন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক।