মোদির প্রত্যাশায় ধস নামার পর আলোচিত ইউটিউবার ধ্রুব রাঠি কেন আলোচনায়?
ভারতের একজন জনপ্রিয় ইউটিউবার ধ্রুব রাঠি, গত মার্চে ভারতের নির্বাচন কমিশন যখন লোকসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে, ঠিক ওই মাসেই বিস্ফোরক এক ভিডিও নিয়ে দর্শকদের সামনে হাজির হন ধ্রুব।
বরাবরের মতো কলারহীন টিশার্ট পরেছিলেন ওই ভিডিওর জন্য, আধো-হাসিমুখে ক্যামেরার সামনে এসেই সোজা চলে যান মূল প্রসঙ্গে। দর্শকদের উদ্দেশ্যে গুরুতর এক প্রশ্ন: "ভারত কি একনায়কতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে?"- রেখে শুরু করেন তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ।
২৯ বছরের এই ইউটিউবার এরপর বলতে থাকেন, বাহ্যিকভাবে ভারতকে একটি গণতন্ত্র বলেই মনে হয়। যেখানে অনেক রাজনৈতিক দলের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে নাগরিকদের। কাকে ভোট দেবেন সেই সিদ্ধান্তও তারা নিতে পারছে। তবে বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল।
এরপর সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতি, রাষ্ট্রের যেসব সংস্থার স্বাধীনভাবে কাজ করার কথা– বিরোধীদের দমনে সেগুলোর অপব্যবহার, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দমনসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন রাঠি। যেসব অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই মোদির বিরোধী ও সমালোচকরা করে আসছিলেন।
২৯ মিনিটের ওই ভিডিওতে রাঠি অ্যানিমেশন ও ইনফোগ্রাফের সাহায্যে তুলে ধরেন এসব অভিযোগের স্বপক্ষে নানান যুক্তি-প্রমাণ।
মোদির সরকার পরিকল্পিতভাবে দেশের নিরপেক্ষ গণমাধ্যম ও বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে আক্রমণ করছে এমন অভিযোগ তোলেন তিনি।
অন্যদিকে, মোদির পক্ষে মূলধারার গণমাধ্যম যে নানান ইস্যু ধামাচাপা দিচ্ছে, সরকারের ঢোলই দিনরাত বাজাচ্ছে সেকথাও বলেছেন। উদাহরণ দেন উত্তরপূর্বের মনিপুর রাজ্যে এক বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক সংঘাতের। এতে ২০০ জনের বেশি মানুষ নিহত এবং হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত হলেও– মূলধারার গণমাধ্যম ও জনপরিসরে যার আলোচনা হয়নি।
এভাবে ভারতের এক ভয়ানক চিত্র সামনে আনেন ধ্রুব রাঠি। মোদির নেতৃত্বে ভারত বিস্ময়কর সাফল্যে অর্জন করছে বলে সরকারি প্রচার-প্রচারণা এবং গণমাধ্যমে যে ছবি দেখানো হচ্ছে, তার সাথে বাস্তবের আমূল তফাৎটা কোটি কোটি ভারতীয়র কাছে এই ভিডিওর মাধ্যমে পৌঁছে দেন এই ইউটিউবার।
ধ্রুব রাঠি বিজেপি ও আরএসএসের সামাজিক মাধ্যমের অপপ্রচার সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শিকার না হয়ে, দেশের প্রকৃত সমস্যাগুলো নিয়ে তাদের ভাবার পরামর্শ দেন। লোকসভা নির্বাচনের আগে করা ওই ভিডিওতে তিনি সকল ভোটারের প্রতি দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষায় ভোট প্রদানের আহ্বান জানান। ইউটিউবে ভিডিওটি ২৪ লাখ বার দেখা হয়েছে।
নির্বাচনের আগে মোদি ও বিজেপিকে নিয়ে বেশকিছু ভিডিও প্রকাশ করেন তিনি। এগুলো সারা ভারতের কোটি কোটি মানুষ দেখেছে। কেউবা গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে প্রজেক্টর দিয়ে দেখিয়েছে ধ্রুব রাঠির ভিডিও।
ইউটিউবে ধ্রুব রাঠির চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ১৬ লাখ। বিজেপি ও মোদির রাজনীতির বিশ্লেষণ করা তার আরেকটি ভিডিও "অরবিন্দ কেজরিওয়াল জেইলড! ডিক্টেটরশিপ কনফার্মড" দেখা হয়েছে ৩০ লাখ বার। প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ের ওপর তাঁর ভিডিও- "রিয়েলিটি অব আনইমপ্লয়মেন্ট ক্রাইসিস", "দ্য হোয়াটসঅ্যাপ মাফিয়া অ্যান্ড ইলেক্টোরাল বন্ডস স্ক্যাম", "রিয়েলিটি অব মেরা আব্দুল- দ্য হিন্দু মুসলিম ব্রেইনওয়াশ এজেন্ডা" এবং "লাদাখ ইজ ডায়িং" - কোটি কোটি ভারতবাসী দেখেছে।
গত ১ জুন শেষ হওয়া ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে ধ্রুব রাঠির ভিডিওগুলো গভীর প্রভাব ফেলেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই নির্বাচনে বিজেপি ৪০০'র বেশি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের আশা করেছিল। কিন্তু, গতকাল আনুষ্ঠানিক যে ফল আসে তাতে হতাশই হতে হয়েছে বিজেপিকে।
চূড়ান্ত ফলাফলে ২৪০ আসনে জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। ৯৯টি আসনে জয় পেয়েছে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। সরকার গঠনের জন্য দরকার ছিল ৫৪৩ আসনের লোকসভার ২৭২টি আসন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সরকার গঠনে গত দুই দশকে প্রথমবারের মতো এনডিএ জোট শরীকদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে বিজেপিকে।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরে তাঁর এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে ধ্রুব রাঠি লিখেছেন, 'একজন সাধারণ মানুষের শক্তিকে কখনো খাটো করে দেখ না।"
ধ্রুব রাঠি রাজনীতিক নন, এই নির্বাচনে প্রার্থিতাও করেননি কোনো আসনে, তবু তিনিই মোদির সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিলেন বলে এখন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এই ঘটনা মূলধারার গণমাধ্যমের বাইরে সামাজিক মাধ্যম ও নতুন ডিজিটাল প্লাটফর্মের শক্তিকে তুলে ধরেছে, জনমত গঠন এবং রাজনৈতিক পরিণতি বদলানোর ক্ষমতাও যা রাখে।
ধ্রুব রাঠির পরিচয়
ধ্রুব রাঠি বর্তমানে জার্মানিতে বসবাস করছেন। পড়াশোনা করেছেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ইউটিউবার হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু হয় ভ্রমণ, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিও বানিয়ে। কিন্তু, সময়ের সাথে সাথে ভারতের রাজনীতি নিয়েও কথা বলতে শুরু করেন। লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকে মোদি প্রশাসনের নানান পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং সেগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন।
উপস্থাপনার গুণ তাঁর অসাধারণ। যেকোনো বিষয়ে কথা বলার সময় দর্শকদের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পারেন সেদিকে। রাজনীতির জটিল সব সমীকরণ সহজভাবে ব্যাখ্যা ও উপস্থাপনেও তাঁর জুড়ি নেই।
তাঁর করা ভিডিওগুলোয় রাজনীতি নিয়ে যেমন কটাক্ষ থাকে, একইসাথে এগুলো যথেষ্ট গবেষণার মাধ্যমে তথ্যবহুলভাবে তৈরিও করেন।
রাজনীতির বাইরে সামাজিক নানান বিষয়েও সরব ধ্রুব ইউটিউবে। দিনে দিনে তাঁর চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার যত বেড়েছে, ততোই বেড়েছে তাঁর প্রভাব বিস্তারের শক্তি।