মানুষের মতো হাতিরাও একে অন্যকে নাম ধরে ডাকে: গবেষণা
মানুষ নিজেদের যেভাবে স্বতন্ত্র নামে আলাদা করে ডাকে, ঠিক তেমনি স্বতন্ত্র ডাকের মাধ্যমে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে কেনিয়ার বন্য আফ্রিকান হাতিরা। সোমবার (১০ জুন) নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, হাতিরা যেসব ডাক ব্যবহার করে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত ডাকটিকে বলা হয় রাম্বল (গর্জন)। এই ডাকটির তিনটি প্রকারভেদ রয়েছে: দূরবর্তী যোগাযোগের জন্য 'কন্ট্যাক্ট (যোগাযোগ) রাম্বল', ঘনিষ্ঠ সাক্ষাতের জন্য 'গ্রিটিং (অভ্যর্থনা) রাম্বল' এবং স্ত্রী হাতিরা নিজেদের বাচ্চার সাথে যোগাযোগ করতে ব্যবহার করে 'কেয়ারিগিভিং (যত্ন) রাম্বল'।
গবেষকরা মেশিন-লার্নিং মডেল ব্যবহার করে হাতির তিন ধরনের রাম্বল বিশ্লেষণ করেছেন। তারা ১৯৮৬ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কেনিয়ায় অবস্থিত অ্যাম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্ক ও বাফেলো স্প্রিংস রিজার্ভে থাকা বন্য স্ত্রী হাতি ও বাচ্চা হাতির ৪৬৯টি ডাকের রেকর্ডিং পরীক্ষা করে দেখেছেন। প্রতিটি হাতিকে কানের আকৃতির ওপর ভিত্তি করে শনাক্ত করা যায় কারণ সেগুলোকে কয়েক দশক ধরে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল।
নিউইয়র্কের কর্নেল ইউনিভার্সিটির একজন প্রাণী আচরণবিদ ও পোস্টডক্টরাল ফেলো এবং গবেষণার প্রধান লেখক মিকি পারডো গবেষণার কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, হাতির ডাক নামের মতো একইভাবে কাজ করে কিনা তা নির্ধারণ করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। নির্দিষ্ট হাতির ডাকের একুস্টিক (শাব্দিক) বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে অন্য কোন হাতির উদ্দেশ্যে সেই হাতিটি ডাক দিয়েছে সেটি নির্ণয় করার চেষ্টাই তারা করেছেন।
তারা দেখেছেন, প্রতিটি হাতি একে অন্যকে ডাকার সময় শাব্দিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা ছিল।
পারডো সিএনএনকে জানিয়েছেন, মেশিন-লার্নিং মডেল এর মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা ডাকের ২৭.৫ শতাংশ সঠিক ছিল। অর্থাৎ ডাকগুলো নির্দিষ্ট হাতির উদ্দেশ্যেই ছিল। তারা মেশিন-লার্নিং মডেল দিয়ে যতটুকু ডেটা সঠিক হবে বলে ধারণা করেছিলেন, তার থেকে বেশি শতাংশ ডেটা সঠিক হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে হাতির ডাকে এমন কিছু রয়েছে যা থেকে মেশিন-লার্নিং মডেল নির্দিষ্ট কোন হাতিকে ডাকা হচ্ছে তা শনাক্ত করতে পেরেছে।
গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন, হাতি যোগাযোগ করার সময় একে অন্যের ডাকের অনুকরণ করে না।
গবেষকরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করছে এমন দুটো হাতির জোড়াকে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পেয়েছেন, দুটো হাতি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করার সময় ভিন্ন ডাক ব্যবহার করে।
তার ১৭টি হাতির ডাক বিভিন্ন হাতিকে শোনানোর পর হাতিগুলো সেই ডাকে জোরালোভাবে সাড়া দিয়েছিল। এর থেকে বোঝা যায়, ডাকটি সেই হাতিকেই উদ্দেশ্য করে দেয়া হয়েছে কিনা তা শনাক্ত করার ক্ষমতা হাতিগুলোর রয়েছে।
জৈব- একুস্টিক অধ্যাপক কোয়েন এলেমানস (যিনি গবেষণায় সরাসরি জড়িত নন) গবেষণার ফলাফলকে খুবই বিস্ময়কর বলে মনে করছেন কারণ প্রাণীদের মধ্যে নামের ব্যবহার থাকার বিষয়টি আগে অজানা ছিল।
তিনি বলেন, "কিছু প্রাণী টিয়া পাখি এবং ডলফিনের নির্দিষ্ট ডাক থাকে যা অন্যরা অনুকরণ করার চেষ্টা করে। তবে এটি মানুষকে নামে ধরে যেভাবে ডাকা হয় তার সমতুল্য নয়।"
গবেষণায় বলা হয়েছে, হাতিরা অন্য হাতির সাথে আজীবন সামাজিক বন্ধন তৈরি করে এবং প্রায়ই তাদের ঘনিষ্ঠ সামাজিক বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গবেষকদের মতে, মানুষ তার নাম ধরে ডাকলে যেরকম ইতিবাচক সাড়া দেয় তেমনি দূরে চলে যাওয়া হাতিরা একে অন্যকে ডাকলে সেগুলো অন্যের ডাকের প্রতি ইতিবাচক সাড়া দেয়।
মেশিন-লার্নিং মডেলটি মা হাতির সাথে বাচ্চার যোগাযোগের সময় ব্যবহৃত ডাককে আরো সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে। গবেষকরা মনে করছেন, মা হাতি সন্তানকে ডাকার সময় আরো বেশী করে নাম ব্যবহার করায় সেটি আরো সঠিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
গবেষণার প্রধান লেখক মিকি পারডো বলেছেন, যেহেতু মানুষ, হাতি কিংবা ডলফিনের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণী একে অন্যকে ডাকার জন্য নামের ব্যবহার করে সেহেতু ভাষার বিবর্তনের সাথে এটি সম্পর্কিত।
তবে গবেষণার লেখকরা নিশ্চিত হতে পারেননি, বিভিন্ন হাতি একটি নির্দিষ্ট হাতিকে ডাকার জন্য নির্দিষ্ট নাম অথবা ভিন্ন নাম ব্যবহার করে কিনা। আবার ডাক দেয়ার সময় হাতিটি ঠিক কোন মানসিক বা শারীরিক অবস্থা প্রকাশ করতে চেয়েছে সেটিও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
এটি নিয়ে ভবিষ্যতে আরো বিস্তারিত গবেষণা করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন মিকি পারডো।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়