সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য নতুন কারেন্সি সোয়াপ কাঠামো চালু করল ভারত
গত বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই) এক বিজ্ঞপ্তিতে ২০২৪ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন—সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য নতুন কারেন্সি সোয়াপ কাঠামো ঘোষণা করেছে। এতে নানা ধরনের ছাড় সুবিধা মিলবে।
এছাড়া পৃথক সোয়াপ উইন্ডোর মাধ্যমে মার্কিন ডলার ও ইউরোতে ২ বিলিয়ন ডলার মুদ্রা বিনিময় চুক্তিও বজায় রাখবে আরবিআই।
এ কাঠামোর অধীনে আরবিআই সেই সার্ক কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলির সাথে দ্বিপাক্ষিক বিনিময় চুক্তি করবে, যারা মুদ্রা বিনিময় বা সোয়াপ সুবিধা গ্রহণ করতে চায়। সার্কভুক্ত দেশগুলো হচ্ছে—বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তান।
ভারতের এ উদ্যোগের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতের এই সোয়াপ ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশ এখন ডলার নিতে পারে। তারা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের মধ্যে ব্যাপক পরিমাণ আমদানি বিল যদি সোয়াপ করে পরিশোধ করা যায়, তাহলে একটি সুবিধা সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বৈশ্বিক মানি মার্কেটে কারেন্সি সোয়াপ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পদ্ধতি। 'রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সৃষ্টি হওয়া ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে বড় বড় রাষ্ট্রগুলো এই পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। সবাই-ই তাদের ট্রেড পার্টনারদের সাথে বিকল্প লেনদেনের সুযোগ রাখতে চেষ্টা করছে। ভারত, চীনেরও সে ধরনের উদ্যোগ রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ ভারতের এই উদ্যোগে অংশ নেবে কি না, সেটি পর্যালোচনার বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ম্যানেজমেন্টের একটি টিম রয়েছে। ভারত বাংলাদেশের বড় বাণিজ্য অংশীদার হলেও ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের স্বার্থে যে ধরনের পদক্ষেপ নিলে ভালো হয় সেটি করবে।'
ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। ভারত থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলারের মতো পণ্য আমদানি হয়। বিপরীতে ভারতে রপ্তানি হয় ২ বিলিয়ন ডলারের কম।
ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার টিবিএসকে বলেন, মুদ্রা বিনিময় যদি করতেই হয়, তাহলে ডলারেই করা উচিত। কারণ ডলার যেকোনো দেশের সঙ্গে বিনিময় করার সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে রুপি সোয়াপ করলে শুধু ভারতের সঙ্গেই সেটি বিনিময় করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ডলার সোয়াপ করতে গেলে যদি খরচ একটু বেশি হয়, এই মুহূর্তের জন্য সেটা মেনে নেওয়া যেতে পারে। কারণ দেশের এখন ডলার প্রয়োজন।
সার্ক মুদ্রা বিনিময় সুবিধা চালু হয় ২০১২ সালের ১৫ নভেম্বর। এর উদ্দেশ্য ছিল স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন বা ব্যালান্স অভ পেমেন্টে আছে, এমন সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা প্রদান করা, যতক্ষণ না দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা করা যায়।
কারেন্সি সোয়াপ যেভাবে কাজ করে
কারেন্সি সোয়াপ বা মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থার মাধ্যমে সরাসরি ঋণ না নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করা যায়।
যেমন, ধরা যাক, বাংলাদেশ ১ হাজার কোটি টাকা দিল ভারতকে, তার বিনিময়ে পেল ৭৫০ কোটি রুপি। এই রুপি কবে ফেরত দেওয়া হবে, তার একটি মেয়াদ থাকবে। পাশাপাশি রুপি, টাকার জন্য বাংলাদেশ ও ভারত পক্ষ কে কত সুদ দেবে, সেটিও নির্ধারিত থাকবে।
রুপির ক্ষেত্রে সুদ সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ পর্যন্ত এবং ডলার বা ইউরোর ক্ষেত্রে সুদ সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। অন্য মুদ্রার সুদহার দরকষাকষির ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।
একইসাথে বাংলাদেশ রুপি কোথায় কী কাজে ব্যবহার করবে এবং ভারত টাকা কোথায় কী কাজে ব্যবহার করবে, তা-ও চুক্তিতে উল্লেখ থাকবে।
বাংলাদেশ ভারত থেকে পাওয়া রুপি অথবা ডলার বা ইউরো দিয়ে আমদানি দায় পরিশোধ করতে পারবে। এমনকি রাষ্ট্রের উন্নয়ন কাজেও ব্যবহার করার সুযোগ থাকবে। একইভাবে ভারত বাংলাদশি মুদ্রা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে আমদানির দায় পরিশোধ করতে পারবে। চাইলে বাংলাদেশ সরকারের ট্রেজারি বিল বা বন্ডেও বিনিয়োগ করতে পারবে।
ভারত বাংলাদেশি টাকা ভারতে থাকা সোনালী ব্যাংকের শাখার মাধ্যমে বাংলাদেশের ট্রেজারি বিল, বন্ড কিনতে পারবে অথবা সরাসরি অন্য যেকোনো ধরনের বিনিয়োগও করার সুযোগ থাকবে। একইভাবে বাংলাদেশও সোয়াপের পরিবর্তে যে রুপি পেল, তা দিয়ে ভারতীয় পণ্য কিনতে পারে। অথবা বাংলাদেশ তার সুবিধা অনুযায়ী এই রুপি অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সাবেক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, সোয়াপ সরাসরি মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা। বিনময় করা মুদ্রা সংশ্লিষ্ট দেশ স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারে।
যেমন, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে সোয়াপের মাধ্যমে ডলার দিয়েছিল। ভারত বিভিন্ন সময় শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভুটানের সাথে এ ধরনের লেনদেন করেছে।
ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমেদ টিবিএসকে বলেন, রুপিতে বাণিজ্য চালু করার ক্ষেত্রে সোয়াপ ব্যবস্থা উপকারী হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ছোট আমদানিকারকদের জন্য সুবিধা হবে, যাদের নিজস্ব ডলার আয় নেই।
এই সোয়াপ ব্যবস্থায় অংশ নেওয়ার জন্য ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বারের পক্ষ থেকে সরকারকে অনুরোধ করা হবে বলেও জানান তিনি।