গোলাবারুদ ফুরিয়ে আসছে, গাজায় যুদ্ধবিরতি চান ইসরায়েলি জেনারেলরা
গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু করতে চান ইসরায়েলের শীর্ষ জেনারেলরা ৷ তবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখনই গাজায় যুদ্ধবিরতি দিতে চান না।
ধারণা করা হচ্ছে, এ নিয়ে সামরিক বাহিনী এবং নেতানিয়াহুর মধ্যে আগামী দিনগুলোতে বিভেদ আরও বাড়বে৷
জেনারেলরা মনে করেন, গাজায় জিম্মি থাকা প্রায় ১২০ জন ইসরায়েলিকে মুক্ত করার সর্বোত্তম উপায় হতে পারে যুদ্ধবিরতি।
একাধিক সেনা কর্মকর্তা জানান, তারা মনে করেন লেবাননের হিজবুল্লাহ বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থল যুদ্ধ শুরু হলে, তাদের বাহিনীর প্রস্তূতির জন্য সময় লাগবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সেনা কর্মকর্তা জানান, হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির ফলে হিজবুল্লাহর সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোও সহজ হতে পারে। কারণ হিজবুল্লাহ বলেছে, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধ না করা পর্যন্ত তারা ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে হামলা চালিয়ে যাবে।
জেনারেল স্টাফ ফোরাম নামে পরিচিত ইসরায়েলের সামরিক নেতৃত্ব প্রায় ৩০ জন সিনিয়র জেনারেলের সমন্বয়ে গঠিত।
এর মধ্যে রয়েছেন সামরিক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হার্জি হালেভি। তিনি সেনা, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর কমান্ডার এবং সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানও।
গত বছরের শুরু পর্যন্ত ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা আইয়াল হুলাতা বলেন, 'সেনাবাহিনী একটি জিম্মি চুক্তি ও যুদ্ধবিরতিতে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে।'
হুলাতা বলেন, 'তারা বুঝতে পেরেছে যে গাজায় যুদ্ধবিরতি লেবাননে উত্তেজনা প্রশমনের সম্ভাবনা বাড়াবে। এছাড়া আগের তুলনায় তাদের যুদ্ধাস্ত্র, খুচরা যন্ত্রাংশ এবং জনবল সবকিছুই কমে গেছে। তাই তারা মনে করে গাজায় যুদ্ধবিরতিতে তারা প্রস্তুতির জন্য আরও সময় পাবে, যদি হিজবুল্লাহর সঙ্গে আরও বড় যুদ্ধ শুরু হয়।'
তবে সামরিক নেতৃত্ব নেতানিয়াহুর কাছে তাদের মতামত জানিয়েছেন কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়।
যদিও সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে হতাশার ছায়া স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। অন্যদিকে, জেনারেলদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর হতাশাও বোঝা যাচ্ছে।
নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতিতে রাজি নয়, তার মতে এতে হামাস ফের শক্তি সঞ্চয় করবে। এছাড়া তিনি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলে তার জোট ভেঙে যেতে পারে।
কিছুদিন আগ পর্যন্ত সামরিক বাহিনী প্রকাশ্যে বলে আসছিল যে, সরকারের পক্ষে যুদ্ধের প্রধান দুটি লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব: হামাসকে পরাজিত করা এবং ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলার সময় হামাস ও তার মিত্রদের হাতে বন্দী জিম্মিদের উদ্ধার করা।
তবে এখন জেনারেলদের মধ্যে এ বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর এতদিন পর এখন সামরিক হাইকমান্ড এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে লক্ষ্য দুটি পারস্পরিক অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
অক্টোবরে গাজায় আগ্রাসন চালানোর পর থেকে ইসরায়েল হামাসের প্রায় সব ব্যাটালিয়নকে পরাজিত করেছে এবং বেশিরভাগ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে।
তবে গত অক্টোবরে অপহৃত ২৫০ ইসরায়েলি জিম্মির মধ্যে অর্ধেকেরও কম বন্দীকে মুক্ত করতে পেরেছেন তারা।
হাইকমান্ড আশঙ্কা করছে, জিম্মিদের উদ্ধারে সামরিক অভিযান চালিয়ে গেলে এসব জিম্মির প্রাণ সংশয়ের ঝুঁকি তির হতে পারে।
অন্যদিকে, নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে গাজা দখল বা ফিলিস্তিনের অন্যান্য নেতাদের কাছে গাজার নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিতে অনিচ্ছুক হওয়ায় সামরিক বাহিনী একটি 'চিরস্থায়ী যুদ্ধের' আশঙ্কা করছে।
তাদের মতে, এভাবে চলতে থাকলে জিম্মিরা বন্দিই থাকবে এবং হামাস নেতারা এখনকার মতো পলাতক থেকে যাবে। এদিকে তাদের শক্তি এবং গোলাবারুদ ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার বিনিময়ে হামাসকে আপাতত ক্ষমতায় রাখাই ইসরাইলের জন্য সবচেয়ে খারাপ বিকল্প বলে মনে হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।
যুদ্ধবিরতি সমর্থন করে কি না এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে সামরিক বাহিনী একটি বিবৃতি দিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, সামরিক বাহিনী 'হামাসের সামরিক ও শাসন ক্ষমতা ধ্বংস, জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা এবং দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চল থেকে ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদে তাদের বাড়িঘরে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে'।
তবে সাম্প্রতিক অন্যান্য বিবৃতি ও সাক্ষাৎকারে সামরিক নেতারা ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধবিরতিতে সমর্থন জানানোর বিষয়ে প্রকাশ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সেনাবাহিনীর প্রধান মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি গত ১৯ জুন এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, 'যারা মনে করেন আমরা হামাসকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারব তারা ভুল করছেন।'
তিনি বলেন, 'হামাস একটি মতাদর্শ। হামাস একটি রাজনৈতিক দল। এর শিকড় মানুষের হৃদয়ে প্রোথিত।'
এসময় নেতানিয়াহুর প্রচ্ছন্ন সমালোচনায় অ্যাডমিরাল হাগারি বলেন, 'জনগণের চোখে ধূলো দেওয়া হচ্ছে।'
চিফ অব স্টাফ জেনারেল হালেভি সম্প্রতি সেনাবাহিনীর সাফল্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
তার এ ধরনের বক্তব্য দেখে কিছু বিশ্লেষক বলেছেন, এটি ছিল তাদের মাথা না নত করে যুদ্ধ শেষ করার অজুহাত তৈরির একটি প্রচেষ্টা।
গত ২৪ জুন ইসরায়েলি সেনারা গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফাহ দিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় জেনারেল হালেভি বলেন, সেনাবাহিনী 'স্পষ্টতই এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে আমরা বলতে পারি যে আমরা রাফাহ ব্রিগেডকে ধ্বংস করে দিয়েছি, তারা পরাজিত হয়েছে। এই অর্থে নয় যে আর কোনো সন্ত্রাসী বেঁচে নেই, তবে এই অর্থে যে তারা আর লড়াই করতে পারবে না।'
সামরিক বাহিনীর হিসাব অনুযায়ী, তারা অন্তত ১৪ হাজার হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। এ তথ্য সত্য হলে হামাসের বেশিরভাগ সদস্যই মারা যাওয়ার কথা।
তবে কর্মকর্তারা এটাও বিশ্বাস করেন যে, কয়েক হাজার হামাস যোদ্ধা গাজার ভূপৃষ্ঠের গভীরে থাকা সুড়ঙ্গে লুকিয়ে রয়েছে এবং তারা তাদের অস্ত্র, জ্বালানি, খাদ্য ও ইসরায়েলি জিম্মিদের পাহারা দিচ্ছে।
নেতানিয়াহুর কার্যালয় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েল 'হামাস সন্ত্রাসী বাহিনীকে নির্মূলের' কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
তবে এসময় ইসরায়েল গাজায় যুদ্ধ কবে শেষ করবে বা যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।
এমনকি জুনের শেষের দিকে এক টেলিভিশন সাক্ষাত্কারেও নেতানিয়াহু যুদ্ধ শেষ করার ব্যাপারে একমত হননি।
তবে তিনি স্বীকার করেছিলেন, 'আমাদের বাহিনীর কিছু অংশকে উত্তরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য, গাজায় সামরিক বাহিনীর পরিমাণ কমানো উচিত।'
সামরিক কর্মকর্তাদের মতে, হিজবুল্লাহর সঙ্গে বৃহত্তর যুদ্ধ শুরু হলে সেনাবাহিনীর প্রস্তূতির জন্য এই পদক্ষেপটি আবশ্যক।
দেশটির বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল আগামী সপ্তাহগুলোতে লেবাননে হিজবুল্লাহ'র বিভিন্ন ঘাঁটিতে আক্রমণের পরিকল্পনা করতে পারে।
হামাসের সঙ্গে প্রায় ৯ মাস ধরে যুদ্ধ চালানোর কোনো পূর্বপরিকল্পনা না থাকায়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এখন খুচরা যন্ত্রাংশ, যুদ্ধাস্ত্র, এমনকি সৈন্যেরও ঘাটতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
গত চার দশকের মধ্যে ইসরায়েল যত যুদ্ধ লড়েছে তার মধ্যে এটিই সবচেয়ে তীব্র এবং গাজায় এ যাবৎকালের সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধ।
দেশটির সেনাবাহিনী মূলত রিজার্ভদের উপর নির্ভরশীল। অক্টোবরের পর থেকে কেউ কেউ তৃতীয় বারের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করছেন। এতে তাদের পেশাদার এবং পারিবারিক জীবনে ভারসাম্য বজায় রাখা কষ্টকর হচ্ছে।
চার সামরিক কর্মকর্তার মতে, রিজার্ভদের সংখ্যা কম। অক্টোবরে হামাসের হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতার কারণে সামরিক নেতৃত্বের প্রতি আস্থার সংকট যেমন দেখা দিয়েছে, তেমনি কর্মকর্তারাও তাদের কমান্ডারদের প্রতি ক্রমে অবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন।
সরকারি তথ্যমতে, গাজায় তিন শতাধিক সেনা নিহত হয়েছে।
কিন্তু সামরিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত চার হাজারেরও বেশি সেনা আহত হয়েছে, যা ২০১৪ সালে গাজায় চলা যুদ্ধের তুলনায় ১০ গুণ বেশি। আরও অজ্ঞাত সংখ্যক সৈন্য পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে ভুগছেন।
দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা আজকাল গাজার বেশ কয়েকটি ট্যাংক কিছুটা খালি রাখছেন। কারণ হিজবুল্লাহর সঙ্গে আরও বড় যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা থাকায় সামরিক বাহিনী তার স্টক সংরক্ষণের চেষ্টা করছে।
সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণ কমানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পাঁচ কর্মকর্তা ও অফিসার।
সেনাবাহিনীর ট্যাংক, সামরিক বুলডোজার ও সাঁজোয়া যানের খুচরা যন্ত্রাংশের অভাব রয়েছে বলেও জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তারা।
মি. হুলাতা এবং অন্যান্য অফিসাররা বলেছেন, ইসরায়েলের কাছে এখন পর্যন্ত লেবাননের হিজবুল্লাহ'র সঙ্গে লড়াই করার জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্র রয়েছে।
হুলাতা বলেন, 'আমরা যদি বড় কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি, তা মোকাবিলায় আমাদের পর্যাপ্ত সম্পদ ও জনবল আছে। তবে আমরা আমাদের সেরাটা দিয়ে লড়তে চাই। আর এই মুহূর্তে আমরা সেরাটা দেওয়ার অবস্থায় নেই।'
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি