ইসরায়েল কীভাবে পাল্টা আঘাত হানবে, জবাবে ইরান কী করবে?
মধ্যপ্রাচ্য আবারও একটি গভীর ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। গত ৪৫ বছর ধরে দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে এ দ্বন্দ্ব চলে আসছে। সম্প্রতি তাদের পাল্টাপাল্টি আক্রমণের কারণে পুরো অঞ্চল এখন বিপজ্জনক সময় পার করছে।
১৯৭৯ সালে শাহের পতনের পর ইরান একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। তারা বহুদিন ধরে 'ইহুদিবাদী রাষ্ট্র' ইসরায়েলকে ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। ইসরায়েল অভিযোগ করে, মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ইরানের রিভোলুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) তাদের মিত্র ও প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সহিংসতা ছড়াচ্ছে এবং বিশ্বের কয়েকটি আরব সরকারও এই অভিযোগ সমর্থন করে।
ইরানের গত মঙ্গলবার চালানো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল। ইরান দাবি করছে, বৈরুতে হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ও তেহরানে হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়াহ হত্যার প্রতিশোধ নিতে তারা এ আক্রমণ চালিয়েছে।
তাহলে এরপর কী হবে?
ইসরায়েল ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই ইরানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, "ইরানকে এর চরম মূল্য দিতে হবে।"
শেষবার এপ্রিলে এমন উত্তেজনা দেখা দিলে ইসরায়েলের মিত্ররা তাদের সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু এবার মিত্রদের আহ্বান অনেকটাই ক্ষীণ। আর ইসরায়েল যেভাবে লেবানন, গাজা, ইয়েমেন ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করার সংকল্প নিয়েছে, তো দেখে মনে হচ্ছে নেতনিয়াহু খুব সহজে এসব বন্ধ করবেন না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছে, ইসরায়েল ইরানে আঘাত হানবে কি-না তার পরিবর্তে কত জোরে আঘাত হানবে তার পরিকল্পনা করছে।
মার্কিন স্যাটেলাইটের গোয়েন্দা তথ্য এবং ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সহায়তায় ইরানে থাকা স্পাইদের মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ আক্রমণের তালিকা করছে। তাদের এ তালিকাকে প্রধান তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে:
প্রচলিত সামরিক লক্ষ্য- ইরানের যেখান থেকে সেই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল, সেই ঘাঁটিগুলো প্রাথমিক ও সুস্পষ্ট লক্ষ্য হতে পারে। এর মধ্যে উৎক্ষেপণ প্যাড, কমান্ড এবং কন্ট্রোল সেন্টার, জ্বালানি ট্যাংক এবং সংরক্ষণ বাঙ্কার অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া, আইআরজিসি'র ঘাঁটি, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাটারিতেও আঘাত হানতে পারে তারা। এমনকি ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যা করারও চেষ্টা করা হতে পারে।
অর্থনৈতিক লক্ষ্য - এর মধ্যে ইরানের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ যেমন পেট্রোকেমিক্যাল কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সম্ভবত তাদের শিপিং খাত অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। তবে এটি অত্যন্ত অজনপ্রিয় পদক্ষেপ হবে, কারণ এটি সামরিক বাহিনীর চেয়ে সাধারণ মানুষের জীবনকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
পারমাণবিক লক্ষ্য - ইসরায়েলের জন্য এটি সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হতে পারে। জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএ নিশ্চিত করেছে যে ইরান বেসামরিক পারমাণবিক শক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ২০ শতাংশের বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে। ইসরায়েল এবং অন্যরা সন্দেহ করছে যে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। ইসরায়েলের সম্ভাব্য লক্ষ্য তালিকার মধ্যে রয়েছে পারচিন, যা ইরানের সামরিক পারমাণবিক কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দু, তেহরান, বোনাব এবং রামসারের গবেষণা রিয়্যাক্টর, পাশাপাশি বুশেহর, নাতাঞ্জ, ইসফাহান এবং ফোরডোর প্রধান পারমাণবিক স্থাপনাগুলো।
তাদের হিসাবের একটি বড় অংশ হবে ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে এবং কিভাবে তা মোকাবেলা করা যায় তা অনুমান করা।
গত মঙ্গলবার আক্রমণ চালানোর পর ইরানের অবস্থান হল, ইসরায়েলি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালানোর মাধ্যমে তাদের আপাতত প্রতিশোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু ইসরাইলের পাল্টা জবাবে তারাও পাল্টা আঘাত হানবে বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে।
এ বিষয়ে ইরানের প্রসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন, "এটি আমাদের ক্ষমতার এক ঝলক মাত্র।" আইআরজিসি আরও জোরালোভাবে জানিয়েছে, "ইহুদি রাষ্ট্রটি যদি ইরানের অভিযানের জবাব দেয়, তারা তাদের চূর্ণবিচূর্ণ করে দিবে।"
ইরান যা-ই বলুক, ইসরায়েলকে তারা সামরিকভাবে পরাজিত করতে পারবে না। ইরানের বিমানবাহিনী পুরানো এবং দুর্বল। তাছাড়া আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ভঙ্গুর। আর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়ে আছে।
তবে ইরানের হাতে এখনও বিপুল সংখ্যক ব্যালিস্টিক ও অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিস্ফোরক বোঝাই ড্রোনও রয়েছে। এছাড়া পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তাদের অসংখ্য সশস্ত্র মিত্র রয়েছে। ইরানের পরবর্তী ক্ষেপণাস্ত্র হামলার লক্ষ্য ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটি না হয়ে আবাসিক এলাকাও হতে পারে। ২০১৯ সালে ইরান-সমর্থিক একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী সৌদি আরবের তেল স্থাপনায় হামলা করে দেখিয়েছিল যে তাদের প্রতিবেশী দেশগুলো কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে।
এছাড়া আইআরজিসি'র নৌবাহিনীর ছোট এবং দ্রুতগামী ক্ষেপণাস্ত্রবাহী জাহাজের বড় একটি বহর রয়েছে। এটি একযোগে মার্কিন নৌবাহিনীর ৫ম নৌবহরের যুদ্ধজাহাজগুলোকে দুর্বল করে দিতে সক্ষম। যদি তারা আদেশ পায়, তাহলে হরমুজ প্রণালীতে মাইন পেতে বিশ্বের ২০ শতাংশ তেল সরবরাহ ব্যাহত করতে পারে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
এছাড়া আরবের তীরে উপসাগরে কুয়েত থেকে ওমান পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। ইরান হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যদি তাদের আক্রমণ করা হয় এবং আক্রমণে ইসরায়েলকে সমর্থন করা হয়, তাহলে শুধু ইসরায়েলকে নয় সমর্থনকারী দেশকে লক্ষ্য করেও আক্রমণ চালানো হবে।
এ বিষয়গুলোই এখন তেল আবিব ও ওয়াশিংটনের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাকারীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।