হামাস নেতা সিনওয়ারকে যেভাবে খুঁজে বের করে হত্যা করল ইসরায়েল
ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ।
গতকাল বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) এক বিবৃতিতে কাৎজ বলেছেন, "হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হয়েছেন। ৭ অক্টোবরের গণহত্যা ও নৃশংসতার জন্য দায়ী গণহত্যাকারী ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে আজ [বৃহস্পতিবার] ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) সৈন্যরা হত্যা করেছে।"
এদিকে হামাস সূত্রও জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলি অভিযানে সিনওয়ার নিহত হয়েছেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
সিনওয়ার ৭ অক্টোবরের হামলার পর গাজায় আত্মগোপনে চলে যান। ইসরায়েলি বাহিনী একবছরেরও বেশি সময় ধরে তাকে খুঁজছিল। ৬১ বছর বয়সী সিনওয়ার বেশিরভাগ সময় গাজার টানেলের নিচে, তার দেহরক্ষী এবং ইসরায়েলি বন্দীদের নিয়ে লুকিয়ে ছিলেন।
অবশেষে দক্ষিণ গাজায় একটি ইসরায়েলি টহল দলের সাথে আকস্মিকভাবে মুখোমুখি হওয়ার পর তাকে হত্যা করা হয়। সে সময় তার দেহরক্ষী সংখ্যা কম ছিল এবং তার সাথে কোনো বন্দী পাওয়া যায়নি।
নিয়মিত টহল
আইডিএফ জানিয়েছে, তাদের ৮২৮তম ব্রিগেডের একটি দল বুধবার (১৬ অক্টোবর) রাফার তাল আল-সুলতান এলাকায় টহল দিচ্ছিল। সেখানে তিনজন সশস্ত্র ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয় এবং তারা ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন।
প্রথমে ঘটনাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়নি এবং বৃহস্পতিবার সকালে সৈন্যরা পুনরায় সেখানে ফিরে যান। মৃতদেহ পরিদর্শনের সময় দেখা যায়, একটি মৃতদেহের হামাসের প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারের সঙ্গে বেশ মিল রয়েছে।
তবে প্রাথমিকভাবে মৃতদেহটি কোনো ফাঁদ হতে পারে বলে সন্দেহ করা হয়। মৃতদেহটির একটি আঙুলের অংশ পরীক্ষা করার জন্য ইসরায়েলে পাঠানো হয়। পরে, এলাকাটি নিরাপদ হলে, সিনওয়ারের দেহ উদ্ধার করে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়।
আইডিএফ-এর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি জানান, তারা জানতেন না সিনওয়ার সেখানে ছিলেন। তবে তারা অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা তিনজনকে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে পালাতে দেখে তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালান। সিনওয়ার একা একটি বাড়িতে ঢুকে পড়েন এবং ড্রোনের মাধ্যমে তাকে শনাক্ত করে হত্যা করা হয়।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেন, "পরাজিত অবস্থায় পালিয়ে বেড়ানোর সময় সিনওয়ার মারা গেছে। সে একজন কমান্ডার হিসেবে নয় বরং এমন একজন হিসেবে মারা হেছেন, যে শুধু নিজের চিন্তা করত।"
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বৃহস্পতিবার রাতে ড্রোন ফুটেজ প্রকাশ করে, যেখানে সিনওয়ারের শেষ মুহূর্তের কিছু দৃশ্য দেখা যায়।
সিনওয়ার 'নিহত'
ইসরায়েল প্রথমে বৃহস্পতিবার দুপুরে স্থানীয় সময়ে ঘোষণা করেছিল, তারা "সিনওয়ারের নিহত হওয়ার সম্ভাবনা" তদন্ত করছে। ঘোষণার কিছু সময় পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন এক পুরুষের মৃতদেহের ছবি প্রকাশিত হয় যার চেহারার সঙ্গে হামাস নেতার বেশ মিল ছিল এবং তার মাথায় গুরুতর আঘাত ছিল।
তবে, কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেন, "এই পর্যায়ে" নিহত তিনজনের মধ্যে কারো পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি। কিছু সময় পর ইসরায়েলি সূত্রগুলো বিবিসিকে জানায়, তারা "আত্মবিশ্বাসী" যে তারা সিনওয়ারকে হত্যা করেছে। তবে তারা বলেন, মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য সব প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে হবে।
এই পরীক্ষাগুলো দীর্ঘ সময় নেয়নি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইসরায়েল ঘোষণা করে, পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এবং সিনওয়ারকে "নিহত" হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সিনওয়ারের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং সতর্ক করে বলেন, গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধ শেষ হয়নি।
অভিযান জোরদার করা
সিনওয়ার পূর্বে বিভিন্ন অভিযান চলাকালীন নিহত না হলেও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, তারা কয়েক সপ্তাহ ধরে সেসব এলাকায় অভিযান চালাচ্ছিল যেখানে গোয়েন্দা তথ্য তার উপস্থিতির কথা জানিয়েছিল।
সংক্ষেপে, ইসরায়েলি বাহিনী সিনওয়ারের মোটামুটি অবস্থান দক্ষিণ শহর রাফাতে চিহ্নিত করেছিল এবং তাকে ধরার জন্য ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল।
সিনওয়ার এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পালিয়েছিল। তিনি নিশ্চিতভাবেই অনুমান করেছিলেন, অন্যান্য হামাস নেতাদের হত্যার সাথে সাথে তাকে হত্যার জন্য ইসরায়েলি চাপ বাড়ছে।
একটি বিবৃতিতে আইডিএফ জানিয়েছে, দক্ষিণে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তাদের অভিযান "ইয়াহিয়া সিনওয়ারের অপারেশনাল আন্দোলনকে সীমাবদ্ধ করেছে কারণ তাকে বাহিনী তাড়া করছিল, যেটি তাকে এভাবে নিহত হওয়ার দিকে নিয়ে গেছে।"
বড় লক্ষ্য পূরণ হলেও যুদ্ধ এখানেই শেষ নয়
সিনওয়ারের হত্যা ছিল ইসরায়েলের একটি প্রধান লক্ষ্য। ৭ অক্টোবরের হামলার পর থেকেই তাকে হত্যার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু তার মৃত্যুতেই গাজার যুদ্ধ শেষ হয়ে যাচ্ছে না।
নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি "হিসাব সমান করেছেন", তবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, হামাসের হাতে এখনও বন্দী থাকা ১০১ জনকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে।
তিনি বলেন, "বন্দী পরিবারগুলোর কাছে আমি বলছি: এটি যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। আমরা আপনার প্রিয়জনদের, আমাদের প্রিয়জনদের বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য পূর্ণ শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাব।"
ইসরায়েলি বন্দী পরিবারের সদস্যরা আশা করছেন, এখন একটি যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে এবং বন্দীদের ফিরিয়ে আনা হবে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়