‘কানাডায় কী ঘটছে’: হিন্দু-শিখ সংঘর্ষে বাড়ছে বিভেদের শঙ্কা
কানাডার ব্রাম্পটন শহরের হিন্দু সভা মন্দিরটি একটি ব্যস্ত সড়কের পাশে অবস্থিত। সেখানে অনেক বাড়ির আলো এখনও দীপাবলির আলোকসজ্জায় সজ্জিত। মন্দিরের পার্কিং লটের ওপর দাঁড়িয়ে ১৭ মিটার উচ্চতার হনুমান মূর্তিটি পুণ্যার্থীদের আসা-যাওয়ার সময় যেন যানবাহনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সেখানে কয়েক মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত গুরুদুয়ার দশমেশ দরবার নামের শিখ উপাসনালয়টির পাশেই দোকানের সারি। সেখানে শাড়ির দোকান থেকে শুরু করে ভারতীয় রেস্তোরাঁ এবং অন্যান্য ব্যবসা রয়েছে। এটি শহরে বসবাসকারী বড় দক্ষিণ এশীয় জনগণের উপস্থিতি জানান দেয়।
হিন্দু মন্দিরে অবস্থানরত কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মীকে না দেখলে হয়ত আন্দাজ করা যেতো না, এই শান্ত আবাসিক এলাকাটি সম্প্রতি শিখ অ্যাক্টিভিস্ট ও জাতীয়তাবাদী বিরোধীদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের স্থান ছিল। গত ৫ নভেম্বর কানাডার টরন্টোর ব্রাম্পটন শহরে অবস্থিত হিন্দু সভা মন্দিরের সামনে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এই সংঘর্ষের পর শহরের মেয়র অন্টারিও প্রিমিয়ার এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই ঘটনার নিন্দা জানান। মোদি এটিকে হিন্দু মন্দিরে হামলা হিসেবে বর্ণনা করেন।
সংঘর্ষের ঘটনায় স্থানীয় পুলিশ এখন পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে এবং আরও গ্রেপ্তারের সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে, স্থানীয় সম্প্রদায়ের সদস্যরা নতুন সহিংসতার আশঙ্কা করছেন, বিশেষ করে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং মোদির সমর্থকদের মধ্যে।
৩ নভেম্বরের সংঘর্ষের ভিডিওতে দেখা যায়, পুরুষেরা ইট ছুড়ে মারছেন, গাড়িতে লাথি মারছে এবং লাঠি বা পতাকার খুঁটির সাহায্যে একে অপরকে আঘাত করছেন। এর মধ্যে কয়েকজনের হাতে ভারতীয় পতাকা এবং অন্যদের হাতে খালিস্তানের স্বাধীনতাকামীদের উজ্জ্বল হলুদ রংযুক্ত পতাকা ছিল।
কানাডার পুলিশ ও ট্রুডোর সরকার মোদি সরকারের বিরুদ্ধে শিখ কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং হয়রানির অভিযোগ তোলার পরপরই এই প্রতিবাদ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।
শিখস ফর জাস্টিস-এর (এসএফজে) নেতা ইনদারজিৎ সিং গোসাল বলেন, প্রতিবাদটি বিশেষভাবে ভারতীয় সরকারের বিরুদ্ধে ছিল এবং এটি কোনোভাবে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য তিনি পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন।
খালিস্তান আন্দোলন ভারতে নিষিদ্ধ। দেশটিতে খালিস্তানপন্থিদের "সন্ত্রাসবাদী" হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করা হয়।
ইনদারজিৎ সিং গোসাল দাবি করেন, মোদিপন্থি প্রতিবাদকারীরাই সহিংসতা উসকে দিয়েছিল। একজন তাকে হুমকি দিয়ে হিন্দিতে বলেছিলেন, "আমরা তোমাকে হত্যা করব।"
তিনি বলেন, "আমি ওই ব্যক্তির কাছে গিয়ে বলি, দেখ তুমি আমাকে নিয়ে যে ভাবনা পোষণ করো, তার জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু আমি আর কিছু বলার আগেই সে সামনে এগিয়ে এসে আমাকে ঘুসি মারে।"
পিলের স্থানীয় পুলিশ গোসালকে অস্ত্রসহ আক্রমণের অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে। তবে তিনি এখনও অভিযোগের বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেননি।
সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ার পর ভারতীয় পতাকা হাতে নিয়ে একদল ব্যক্তি মন্দিরের বাইরে যানবাহন চলাচল আটকে দেয়। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একজন মেগাফোনে ভারতীয় সৈন্যকে কানাডায় শিখ উপাসনালয়ে "হামলা" করার আহ্বান জানাচ্ছেন।
পিল পুলিশ ওই ব্যক্তিকে ঘৃণা ছড়ানো ও উসকানি দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে।
বিশ্ব শিখ সংগঠনের সদস্য জসকরন সিং সান্ধু বলেন, ভারতের বাইরে সবচেয়ে বেশি শিখ জনগণের আবাস কানাডায় এ ধরনের দৃশ্য অপ্রত্যাশিত।
জসকরন সিং সান্ধু কানাডায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী বক্তব্যের বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, এই অস্থিরতা ব্রাম্পটনে একত্রে বাস করা শিখ ও হিন্দুদের মধ্যে সম্পর্কের প্রতিফলন নয়, বরং এটি "প্রো-ইন্ডিয়া হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের উপস্থিতির কারণে ঘটছে।"
কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানী পরিতোষ কুমার বলেন, মোদি সরকারের কারণে বিশ্বব্যাপী হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা আরও সাহসী হয়েছে, যা কানাডায় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশে বর্ণবৈষম্যের শিকার কিছু প্রবাসী জনগণ এই মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন।
কুমার উল্লেখ করেছেন, কানাডায় হিন্দু জাতীয়তাবাদ বিরোধী গবেষকরা অতীতে হয়রানির শিকার হলেও, "সাম্প্রতিক সহিংসতা একটি গুরুতর উত্তরণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে।"
তিনি সতর্ক করে বলেন, মোদির প্রতিবাদকে হিন্দু মন্দিরে শিখদের আক্রমণ হিসেবে চিত্রিত করা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করতে পারে এবং "এর ফলে আরও সহিংসতা দেখা যেতে পারে।"
কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক চিন্নাইয়া জংগাম উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন যে, মোদির সমর্থকরা ব্রাম্পটনে প্রতিবাদগুলোকে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এর ফলে তার পরিবারের সদস্যরা ভারত থেকে তার নিরাপত্তার ব্যাপারে জানতে ফোন করেছিলেন।
জংগাম একজন দলিত হিন্দু। তিনি বলেন, "তারা ভিকটিম হওয়ার) ধারণাটি প্রচার করছে। এটি একটি মিথ্যা কাহিনি... এবং এটি একটি বৃহত্তর কাহিনীর অংশ যা [কানাডার সরকারকে] খাটো করতে চেষ্টা করছে।"
ব্রাম্পটন সিটি কাউন্সিলর গুরপ্রতাপ সিং তূর বলেন, ভারতীয় মিডিয়া এবং হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়ানো মিথ্যা তথ্য ব্রাম্পটনে প্রতিবাদগুলোকে হিন্দু মন্দিরে সহিংস আক্রমণ হিসেবে উপস্থাপন করেছে, যা কানাডা এবং ভারতের মধ্যে ভয় ও ঘৃণা ছড়িয়েছে।
তিনি বলেন, এটি একটি গুরুতর অন্যায় কারণ বিষয়টিকে শিখ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
মিসিসাগার রাম মন্দিরের পণ্ডিত রূপনাথ শর্মা বলেছেন, ব্রাম্পটনে অস্থিরতা হিন্দু-শিখ বিষয় নয়, এটি এমন কিছু মানুষের কাজ যারা একটি বিশেষ মতামত প্রকাশ করছেন।
তিনি প্রতিবাদগুলোর নিকটবর্তী জায়গায় নিরাপত্তা বিধির জন্য স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ করার কথা জানিয়েছেন, যাতে প্রতিবাদের অধিকার বজায় থাকে এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
হিন্দু সভা মন্দিরের নেতারা মন্তব্যের অনুরোধে তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে মন্দিরের পণ্ডিত শ্রীবাসুদেব জোশি টরন্টো স্টারকে বলেছেন, প্রতিবাদটি ভারতীয় কনস্যুলেটের বাইরে হওয়া উচিত ছিল।
ব্রাম্পটনের মেয়র প্যাট্রিক ব্রাউন মন্দিরের মতো পূণ্যস্থানগুলোতে প্রতিবাদ নিষিদ্ধ করার জন্য একটি আইন প্রস্তাব করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো গত সপ্তাহে মন্দিরে সহিংসতা ঘটনাকে "অগ্রহণযোগ্য" বলে মন্তব্য করেছেন। রাজনৈতিক নেতারা এ ধরনের মন্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেছেন।
তবে জসকারন সিং সান্ধু এসব মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, নেতারা মব ভায়োলেন্স (রাজনৈতিক সহিংসতা) নিয়ে এত তাড়াতাড়ি কথা বলেন, কিন্তু ভারতীয় সহিংসতা, যা কানাডার শিখ সম্প্রদায়ের ওপর চালানো হয়েছে, সেই বিষয়ে একেবারে নীরব রয়েছেন।"
তিনি প্রশ্ন করেছেন, "কানাডায় কী ঘটছে তা বুঝতে আপনাদের জন্য কি ছবিগুলোই যথেষ্ট নয়?"
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়