ঘোড়া নয়, মহিষের পিঠে চড়েই ব্রাজিলের মারাজো দ্বীপে পুলিশের টহল
ব্রাজিলের সামরিক পুলিশ বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আমাজন নদীর মোহনায় অবস্থিত মারাজো দ্বীপের একটি পুলিশ ব্যাটালিয়ন নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে। তারা দ্বীপে মহিষের পিঠে চড়ে রাস্তায় টহল দেয়।
শিংওয়ালা ১,৮০০ পাউন্ড ওজনের এই মহিষগুলো কাদামাখা জমি ও ঘন ম্যানগ্রোভ বন পাড়ি দিতে পারে, এমনকি প্রয়োজনে সাঁতারও কাটতে পারে। বৃষ্টির মৌসুমে এই বিশাল দ্বীপে অপরাধীদের ধরার জন্য মহিষগুলোকেই একমাত্র ভরসা বলছেন পুলিশ সদস্যরা।
সার্জেন্ট রোনালদো সুজা বলেন, "কিছু জায়গায় মোটরসাইকেল বা নৌকাও পৌঁছাতে পারে না, কিন্তু মহিষ দিয়ে সবখানে যাওয়া সম্ভব।" ব্যাটালিয়নের সাতটি জল মহিষের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী মহিষের নাম মিনোতাউর।
সওরি শহরের উত্তরপূর্ব কোণে প্রায় ২৪ হাজার বাসিন্দার শান্ত এই শহরে, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও চামড়ার বুট পরা অফিসাররা দিন শুরু করেন মহিষের পিঠে চড়ে। তাদের কোমরে বাঁধা থাকে পিস্তল, আর মহিষের এই অভিজাত দল শহরের প্রধান চত্বরে গিয়ে হাজির হয়।
এই দৃশ্যই ছোটখাটো অপরাধীদের দূরে রাখার জন্য যথেষ্ট বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা গর্ব করে বলেন, "এটাই হয়ত ব্রাজিলের একমাত্র জায়গা, যেখানে প্রকাশ্যে ঘড়ি পরেও ডাকাতির ভয় নেই।"
জল মহিষ এশিয়ার প্রাণী হলেও ব্রাজিলের বেশিরভাগ জায়গায় বিরল। তবে মারাজো দ্বীপে এগুলো প্রচুর পরিমাণে রয়েছে, যেখানে মহিষের সংখ্যা দ্বীপের ৬ লাখ মানুষের সমান।
এদের উত্স সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি। একটি জনপ্রিয় গল্প অনুযায়ী, ১৯শ শতকে ফরাসিরা এশিয়ার ধানক্ষেত থেকে মহিষ এনে ফরাসি গিনি অঞ্চলে তাদের উপনিবেশে সস্তা মাংস সরবরাহের জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মাঝপথে জাহাজ ডুবে গেলে মহিষগুলো সাঁতরে তীরে উঠে আসে।
মারাজোর মানুষ এই মহিষদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে। এখন এরা দ্বীপের ট্যাক্সি, আবর্জনা ট্রাক এবং মালবাহী যান হিসেবে কাজ করে। মহিষের মাংসের বার্গার, দুধ থেকে তৈরি করা পুরস্কারজয়ী পনির এবং মহিষের দুধের আইসক্রিম এখানকার বিশেষ খাবার।
এরা মারাজোর কার্নিভ্যাল এবং স্বাধীনতা দিবসের শোভাযাত্রার মূল আকর্ষণ। এমনকি দ্বীপের প্রিয় মহিষদের জন্য ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টও রয়েছে, যেখানে হাজারো অনুসারী তাদের ছবি দেখে মুগ্ধ হয়।
পর্যটকরা মারাজো দ্বীপে জল মহিষের সঙ্গে সময় কাটাতে ভিড় করেন। নদীর তীরে মহিষের পিঠে চড়ে সাঁতার কাটার অভিজ্ঞতা উপভোগ করেন তারা।
স্থানীয়রা, যেমন আন্তেনর পেনান্তে, মহিষকে পোষা প্রাণী হিসেবেও দেখেন। তিনি বলেন, "বেশিরভাগ মানুষই কুকুরের মালিক, কিন্তু এখানে মারাজোতে আমাদের পোষা প্রাণী হিসেবে মহিষ আছে।"
তবে এদের সম্পদ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। তার পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মহিষের চামড়া দিয়ে নানা সামগ্রী তৈরি করছে, যার মধ্যে মহিষের স্ক্রোটাম দিয়ে তৈরি করা ব্যাগ বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
১৯৯০-এর দশকে সামরিক পুলিশ প্রথম মহিষকে কাজে লাগায়। তখন তাদের সম্পদের অভাব ছিল, হাতে ছিল কেবল একটি পুরনো ভ্যান।
মহিষ এখন দ্বীপের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, ব্যবহারিক থেকে সাংস্কৃতিক সব কাজেই।
মারাজো দ্বীপের সওরি শহরের মিলিটারি পুলিশ ব্যাটালিয়নের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৯০। তাদের মধ্যে অনেকেই এখন এসি-প্যাট্রোল কারে টহল দেন। তবে আসল বিশাল ব্যাফেলো স্কোয়াড, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুজা এবং সিলভা, নিজেদেরকে দ্বীপের সবচেয়ে শক্তিশালী অপরাধ প্রতিরোধকারী শক্তি হিসেবে মনে করেন।
তবে, দ্বীপে অপরাধের সংখ্যা খুবই কম। দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ দুপুরে ৩টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকে, যা অপরাধের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। শেষ বড় ঘটনা ঘটেছিল এক বছর আগে, যখন ব্যাফেলো স্কোয়াডকে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া থামাতে ডাকা হয়েছিল।
গত ২০ বছরে সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল, একটি ব্যাংক ডাকাতির চেষ্টা। কিন্তু সন্দেহজনক এক বিদেশি আসার আগে স্থানীয়রা তার ব্যাপারে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করে এবং সে ব্যাংকে পৌঁছানোর আগেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সুজা বলেন, "এখানে ডাকাতি করে পালিয়ে যেতে হলে সত্যিই ভালো একটা পরিকল্পনা করতে হবে।" তিনি আরও বলেন, একটি দ্বীপে পালানোর চিন্তা করা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।
মারাজো দ্বীপে গত কিছু বছর ধরে একমাত্র যে অপরাধটি বাড়ছে, তা হলো মহিষ চুরি।
এই অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পুলিশ দূরবর্তী খামারগুলোতে মহিষ রাখে, যাতে তারা রাতে চুরি হওয়া মহিষগুলোকে খুঁজে বের করতে পারে।
যদিও পুলিশ সদস্যরা শহরের যুদ্ধে ব্যবহৃত সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত, তারা বেশিরভাগ সময় খামার কর্মী হিসেবে কাজ করেন। তারা মহিষদের খাওয়ায় এবং গোসল করাতে সাহায্য করে।
মহিষগুলো ছোটবেলা থেকেই তাদের পালনকারীদের অনুসরণ করে, কিন্তু তা সত্ত্বেও পুলিশই তাদের দেখাশোনা করে। তারা মহিষদের নারিকেল সাবান দিয়ে গোসল করান, কৃমি দূর করেন এবং আম খাইয়ে যত্ন নেন। মহিষের ওপর নির্ভরশীল এই দ্বীপে মহিষ মানুষের নয়, মানুষই মহিষের সেবায় নিয়োজিত।
মারসিও আলভেজ নামে একজন স্থানীয় বলেন, "আমার মহিষগুলো শুধু সকালে কাজ করতে পছন্দ করে।"
তার লর্ড, গোট, এবং ব্ল্যাকি নামে তিনটি মহিষ রয়েছে।এই তিনটি মহিষ তার পেছনের বাগানে ঘুমায় এবং সকালে তারা তাকে নির্মাণ সামগ্রী বহন করতে জন্য সাহায্য করে।
আলভেজ বলেন, মহিষগুলোর মন জয় করার একমাত্র উপায় হলো, দুপুরে শহরের চারপাশে তাদের ঘাস খেতে দেওয়া।
তিনি বলেন, "তারা দ্রুত বাড়ি ফিরে যাবে। তারা পথ চেনে... তারা অনেক মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান।"
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়