যুক্তরাজ্যে ‘জেনোসাইড-ফ্রি’ কোলার ব্যাপক আলোড়ন
শরতের একটি রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের কেন্দ্রে অবস্থিত একটি জমজমাট শহর হলবর্ন। সেখানেই রয়েছে একটি ফিলিস্তিনি রেস্তোরাঁ হিবা এক্সপ্রেস। সেখানে খাবার খেতে জন্য ভিড় জমিয়েছেন ভোজনপ্রেমীরা। এছাড়া এ রেস্তোরাঁকে ঘিরে আছে বইয়ের দোকান, বিভিন্ন দোকানপাট ও খ্যাতনামা আরও রেস্তোরাঁ। আর এর ঠিক উপরেই রয়েছে প্যালেস্টাইন হাউস।
প্যালেস্টাইন হাউস একটি বহুতল ভবন। ফিলিস্তিনি জনগণ ও তাদের সমর্থকরা প্রায়ই এখানে এসে মিলিত হন। এ ভবনটি তৈরি হয়েছে আরবীয় কায়দায়। এর রয়েছে পাথরের দেয়াল ও ফোয়ারা-সজ্জিত উঠান।
এ প্যালেস্টাইন হাউসটি পরিচালনার দায়িত্বে আছেন ওসামা কাশু নামে ৪৩ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। খোঁপায় বাঁধা চুল, ঘন দাড়ি আর গোঁফে ঢাকা মুখ কাশুকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। ২০১২ সালে আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে কাশু এ হিবা এক্সপ্রেস নামে এ রেস্তোরাঁটি চালু করেন। কাশু ২০২০ সাল পর্যন্ত এ রেস্তোরাঁটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রেস্তোরাঁটি ফিলিস্তিনি ও লেবানিজ খাবারের জন্য বেশ পরিচিত।
রেস্তোরাঁটির অন্দর মহল উস্ণ রঙে সজ্জিত। সেখানে গাছের ডাল ব্যবহার করে একটি প্রাকৃতিক আবহও দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এর পাশেই ঝুলছে একটি স্লোগান সমেত প্ল্যাকার্ড। সেখানে লেখা ছিল 'নদী থেকে শুরু সমুদ্রে গিয়ে শেষ'। রেস্তোরাঁটির প্রবেশপথে দেখা যায় সাদা-কালো স্কার্ফ পরানো পুতুল। আর পুতুলটির পাশেই আরেকটি সাইনবোর্ডে লাল কালিতে লেখা 'বাচ্চাদের বাঁচান'। সাইনবোর্ডটি এ রেস্তোরাঁয় আসা প্রত্যেককে ইসরায়েলের হামলায় হাজারও শিশু মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এদিকে রেস্তোরাঁর বিভিন্ন খাবারের টেবিলে শোভা পাচ্ছে ফিলিস্তিনের পতাকার রঙে রাঙানো চেরি-লাল সোডার ক্যান। এর মধ্যে পতাকার কালো, লাল ও সবুজ রঙের মিশেলে ঐতিহ্যবাহী কেফিয়েহ প্যাটার্নের নকশা করা আছে। আর ক্যানগুলোর গায়ে আরবি ক্যালিগ্রাফিতে লেখা আছে 'গাজা কোলা'। ক্যানগুলো জনপ্রিয় ব্র্যান্ড কোকা-কোলার আদলে তৈরি হলেও এটি বহন করছে এক ভিন্ন বার্তা।
ওসামা কাশু এ গাজা কোলার উদ্ভাবক। এ পানীয়টি কোলা তৈরির জন্য যাবতীয় উপাদান দিয়েই তৈরি আর কোকা-কোলার মতই রয়েছে মিষ্টি ও অম্লীয় স্বাদ। কিন্তু কাশু দাবি করেন, "এ পানীয়টির তৈরি প্রক্রিয়া কোকা-কোলা থেকে একদম ভিন্ন।" তবে পানীয়টি কীভাবে কিংবা কোথায় প্রথম তৈরি হয়েছে তা-না জানালেও ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে এটি উৎপাদন করতে শুরু করেন বলে জানান কাশু।
পূর্ব লন্ডনের হ্যাকনির ৫৩ বছর বয়সী বাসিন্দা নাইঙ্কে ব্রেট প্যালেস্টাইন হাউসের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সর্বপ্রথম গাজা কোলার স্বাদ গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, "এটি কোকা-কোলার মতো ঝাঁঝযুক্ত নয়, স্বাদ অনেকটাই হালকা। তার চেয়ে বড় কথা, একে পান করার মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করা যায়।"
ওসামা কাশুরে ভাষায়, "এই পানীয় তৈরির অন্যতম লক্ষ্য হল গাজায় ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসনকে সমর্থন করে এমন কোম্পানিগুলোর পণ্য বয়কট করা এবং মানুষকে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ অনুভব করানো।"
তার মতে, গাজা কোলার মাধ্যমে একদিকে যেমন মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে বয়কট আন্দোলনও শক্তিশালী হচ্ছে। তিনি বলেন, "যে-সব কোম্পানি সরাসরি এই গণহত্যায় ভূমিকা রাখছে, তাদের রাজস্ব প্রবাহে আঘাত করলে তারা নিশ্চয়ই বিষয়টি নিয়ে পুনর্বিবেচনা করবে।"
তিনি জানান, গাজা কোলার বিক্রি থেকে অর্জিত পুরো মুনাফা গাজার আল-কারামা হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ড পুনর্নির্মাণে ব্যয় করা হচ্ছে। তিনি বলেন, "প্রতিটি ক্যান যেন ফিলিস্তিনের জনগণের দুর্দশার কথা মনে করিয়ে দেয়।"
তাছাড়া এ গাজা কোলা তৈরির পিছনে কাশুর পরিবার একটি বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তিনি জানান, তার ১৭ বছর বয়সী দত্তক নেওয়া ছেলের খোঁজ তিনি জানেন না। গত জুনে ওই ছেলেকে মাথায় গুলি করা হয়।
তিনি বলেন, "আমার গাজায় পরিবার ছিল। তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার বন্ধুরা কোথায় আছে, তাও কিছু জানি না।"
কাশু জানান, গাজা কোলা তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল ও চ্যালেঞ্জিং। তিনি বলেন, "এ পানীয়টি তৈরি করা আমার জন্য অনেক কঠিন ও কষ্টদায়ক ছিল কারণ আমি এ পানীয় শিল্প সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।" তার সাথের অনেকেই তাকে ক্যানের রঙ, ফন্ট, নাম এমনকি পতাকার বিষয়ে আপস করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু কাশু কোনো কিছুতেই আপস করেননি।
কাশু জানান, পণ্যটির লোগো তৈরি করার বিষয়টিও জটিল ছিল। কাশু হাসিমুখে বলেন, "তখন তিনি চিন্তা করছিলেন, কীভাবে এমন একটি ব্র্যান্ড নাম তৈরি করবেন যা একেবারে স্পষ্ট ও সরাসরি বার্তা দেয়। তিনি দেখেন যে 'গাজা কোলা'ই সেই বার্তা স্পষ্ট, সৎ ও স্বচ্ছ ভাবে উপস্থাপন করতে পারছে।
খরচ কমানোর জন্য এ গাজা কোলা পোল্যান্ডে উৎপাদন করে যুক্তরাজ্যে আমদানি করা হয়। কিন্তু সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত জায়গা না থাকায় শুরুতে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, "কোলা জাতীয় পানীয়ের বাজার বড় হলেও পিছনের রাজনীতির কারণে এ বাজারে প্রবেশ করা কঠিন ছিল।"
কাশু শুরুতে তার রেস্তোরাঁ হিবা এক্সপ্রেস ও স্থানীয় ফিলিস্তিনি রেস্তোরাঁগুলোতে এটি সরবরাহ করা শুরু করেন।
এছাড়া ম্যানচেস্টারের আল আকসা সুপারমার্কেটের মতো মুসলিম খুচরা বিক্রেতারাও এটি বিক্রি করা শুরু করেন। সেখানকার দোকানের ম্যানেজার মোহাম্মদ হুসেইন জানান, "সম্প্রতি আমাদের স্টক শেষ হয়ে গেছে। আগস্টের শুরু থেকে এ পর্যন্ত গাজার কোলার পাঁচ লাখ ক্যান বিক্রি হয়েছে "
অনলাইনে গাজা কোলার একটি ছয় ক্যানের প্যাকেটের দাম ১২ পাউন্ড (১৫ ডলার), যেখানে কোকাকোলার একই প্যাকেটের দাম ৪.৭০ পাউন্ড (৬ ডলার)। তবে কাশু জানিয়েছেন, গাজার কোলার সমস্ত লাভ গাজার আল-করামা হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগ পুনর্নির্মাণে দান করা হচ্ছে।
গাজা কোলা শুধু একটি পানীয় নয়। এটি বড় ব্র্যান্ডগুলোর বিরুদ্ধে বয়কট এবং ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর একটি প্রচেষ্টা। সম্প্রতি একটি সুইডিশ কোম্পানি প্যালেস্টাইন ড্রিংক্স বের করেছে। প্রতি মাসে গড়ে তারা ৩০-৪০ লাখ ক্যান প্যালেস্টাইন ড্রিংক্স বিক্রি করছে। জর্ডানের ম্যাট্রিক্স কোলা এবং মিসরের স্পিরো স্পাথিস ব্র্যান্ডগুলোও সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য সাড়া ফেলেছে।
নেদারল্যান্ডের রটারডামের ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি অধ্যাপক জেফ হ্যান্ডমেকার বলেন, ভোক্তা বয়কট করার মাধ্যমে কর্পোরেট অপরাধগুলো সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলে যার দায়ভার কোম্পানিগুলো এড়াতে পারে না।"
তিনি বলেন, "এ ক্ষেত্রে কোকাকোলা বয়কটের ক্যাম্পেইনটি এক প্রকার সফল হয়েছে বলে ধরা যায়।"
ওসামা কাশু এখন গাজা কোলার পরবর্তী সংস্করণ নিয়ে আজ করছেন। তিনি জানান, আগেরটির চেয়ে এটি আরও বেশি ফিজি হবে। তিনি আশা করছেন, "গাজা কোলার প্রতিটি চুমুকই গ্রাহককে ফিলিস্তিনের দুর্দশার কথা স্মরণ করিয়ে দিবে।"
কাশু বলেন, "গত ৭৫ বছর ধরে চলা এবং এখনও চলমান এ ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের কথা আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মনে করিয়ে দিতে হবে। আর এটি হতে পারে একটি ছোট্ট স্মারকের মাধ্যমে। যেমন এ পানীয় উপভোগও করবেন পাশাপাশি আপনি ফিলিস্তিনিদের শুভেচ্ছাও পাবেন।"