২০১১ সালে বিপ্লবে কেঁপে উঠেছিল মধ্যপ্রাচ্য: সিরিয়ার পরিণতি কি আলাদা হতে যাচ্ছে?
২০১১ সালে যখন আন্দোলনকারীরা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছিল, তখন সেটি মধ্যপ্রাচ্যে স্বৈরাচারী শাসকদের উৎখাত করার লক্ষ্য নিয়ে শুরু হওয়া আরব বসন্তের আন্দোলনের অংশ ছিল।
যেখানে অন্যান্য দেশের বিরোধী দলগুলো দ্রুত সফলতা পেয়েছিল, সেখানে সিরিয়ার বিপ্লব একটি ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। এর ফলে কয়েক লাখ মানুষ নিহত হয়, কয়েক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং দেশটি প্রতিদ্বন্দ্বী শাসকদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
বাশার আল-আসাদের বিস্ময়কর পতন এখন সিরিয়ার জনগণকে সেই আনন্দ অনুভব করার সুযোগ দিয়েছে, যা তাদের প্রতিবেশী দেশগুলো যেমন মিশর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া এবং ইয়েমেনে এক দশক আগে অনুভব করেছিল। এই চারটি আরব দেশেই শাসকরা দ্রুত উৎখাত হয়েছিল।
তবে এ চারটি দেশের অভিজ্ঞতা সফল বিপ্লবের রূপক হলেও, তাদের পরবর্তী পরিস্থিতি একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করছে।
মিশর এবং তিউনিসিয়ায় নতুন শক্তিশালী শাসক ক্ষমতায় এসেছে এবং 'প্লুরালিস্টিক' বা বহুত্ববাদী গণতন্ত্র গড়ে তোলার চেষ্টা ব্যর্থ করেছে। অন্যদিকে, লিবিয়া এবং ইয়েমেনে প্রতিদ্বন্দ্বী মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো ক্ষমতার জন্য লড়াই করেছে। যার ফলে সেখানেও গৃহযুদ্ধ হয় এবং দেশ দুটি ভাগ হয়ে যায়।
ব্রিটিশ সরকারের সাবেক মন্ত্রী এবং আরব বসন্তের সময় মধ্যপ্রাচ্য নীতির প্রধান এলেস্টেয়ার বার্ট বলেন, "যারা গত ১৩ বছর টিকে আছে, তারা ভবিষ্যতের চিন্তা করার আগে এই মুহূর্তটি উপভোগ করার যোগ্য।"
২০১১ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে বার্ট বলেন, "আমরা সেরা কিছুর আশা করি, কিন্তু খারাপ পরিস্থিতির জন্যও প্রস্তুত থাকি।"
সিরিয়ার ক্ষমতা বদল এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ইসলামপন্থি বিদ্রোহী জোট হায়াত তাহরির আল-শামকে (এইচটিএস) এখন আসাদ পরবর্তী সিরিয়া পরিচালনার পরিকল্পনায় অন্যান্য বিরোধী গোষ্ঠীর সাথে সমঝোতায় আসতে হবে।
এইচটিএস বর্তমানে সিরিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী হলেও তারা বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির লড়াইয়ে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে– তুরস্ক-সমর্থিত উত্তরের একটি গোষ্ঠী, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত পূর্বাঞ্চলের ধর্মনিরপেক্ষ কুর্দি-নেতৃত্বাধীন জোট এবং দক্ষিণ সিরিয়ার স্থানীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো, যার মধ্যে ইসলামিক দ্রুজ সংখ্যালঘুদের নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া রয়েছে।
এই বহুমুখী বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সমন্বয় প্রতিষ্ঠা সিরিয়ার ভবিষ্যৎ শাসন ব্যবস্থার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একসময় আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত থাকা এইচটিএস এখন নিজেদের একটি মধ্যপন্থী আন্দোলন হিসেবে উপস্থাপন করছে। তারা দাবি করছে, সিরিয়ার বিভিন্ন সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষায় তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর মধ্যে রয়েছে– খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, দ্রুজ সংখ্যালঘু এবং আলাউয়ি শিয়া সম্প্রদায়, যাদের ওপর ভিত্তি করে আসাদ সরকার টিকে ছিল।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এইচটি.এস-কে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, যদি এই গোষ্ঠী তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারে, তবে এর ফলে গৃহযুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। কারণ, বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মিলিশিয়ারা নতুন কেন্দ্রীয় সরকার থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে বাধ্য হবে।
সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী আলিস্টার বার্ট বলেন, "মানুষকে শুধু নিরাপদ বললেই হবে না, তারা নিজেরাই সেই নিরাপত্তা বিশ্বাস করতে হবে।" তিনি আরও যোগ করেন, "এইচটিএস এবং মুক্ত শহরগুলিতে অস্ত্রধারী সব পক্ষের আচরণই ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।"
সিরিয়ার নতুন যুগেও বিদেশি শক্তিগুলোর প্রভাব বজায় থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইরান, তুরস্ক, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র, যারা গৃহযুদ্ধে বিভিন্ন পক্ষকে সমর্থন করেছে, তাদের স্বার্থ ধরে রাখার চেষ্টা এই দেশের অভ্যন্তরীণ বিবাদ দীর্ঘায়িত করতে পারে।
আসাদের সাবেক জেনারেল এবং নিরাপত্তা প্রধানদের ভূমিকা এখনও অস্পষ্ট। কিন্তু ২০১১-১২ সালের আরব বসন্তের অভিজ্ঞতা বলছে, তারা নতুন ক্ষমতার খেলায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন।
মিশর: ২০১১ সালে হোসনি মোবারকের পতনের পর সেনাবাহিনী রাজনৈতিক পরিবর্তনের গতি নিয়ন্ত্রণ করে। নির্বাচনের পর ২০১৩ সালে তারা জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে। মুরসির কঠোর শাসন অনেকের মধ্যে গণতন্ত্র নিয়ে হতাশা সৃষ্টি করে।
লিবিয়া: কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর ২০১১ সালে নির্বাচন হলেও, তিন বছরের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং দেশটি বিভক্ত হয়ে পড়ে।
ইয়েমেন: ২০১২ সালে আলি আব্দুল্লাহ সালেহর প্রস্থান গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। এর ফলে ইরান-সমর্থিত হুথি আন্দোলন রাজধানী দখল করে।
তিউনিসিয়া: জিন এল-আবিদিন বেন আলির পতনের পর দেশটি একসময় আরব বসন্তের সফল মডেল ছিল। তবে ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে গণমাধ্যম, বিচার বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
সিরিয়াও একই পথে হাঁটতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। বিভিন্ন বিদেশি শক্তির স্বার্থ এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাত দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে প্রধান বাধা হতে পারে।
সিরিয়ার জটিল অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেকেই মনে করছেন, ১৩ বছরের যুদ্ধের যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে, আসাদের বিদায় তা আরও গভীর করতে পারে। তবে অন্য বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই হয়ত সিরীয়দের এমন কিছু অর্জনে সহায়তা করবে, যা মিশরসহ অন্য দেশগুলোতে সম্ভব হয়নি।
চ্যাথাম হাউজের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের প্রধান সনম ওয়াকিল বলেন, দীর্ঘ লড়াইয়ের কারণে সিরিয়ানরা এই মুহূর্তের জন্য প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি বলেন, "এটি সিরিয়ার জন্য বিশেষ মুহূর্ত।" এর মধ্য দিয়ে তারা শিখেছে, সংঘবদ্ধ হয়েছে এবং বিভিন্নভাবে সক্রিয় হয়েছে।
আসাদ শাসনের অধীনে– লক্ষাধিক মানুষকে অপরিষ্কার, জনাকীর্ণ কারাগারে বন্দি রাখা হয়; হাজার হাজার বন্দিকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয় এবং সাধারণ মানুষের ওপর ব্যারেল বোমা ও রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়।
২০১১ সালে আসাদের ক্ষমতা ছাড়ার অনিচ্ছার কারণে দেশটি গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়। এতে লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হন, দেশটির অবকাঠামো ধ্বংস হয় এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস-এর উত্থান ঘটে।
সিরিয়ার সাবেক সরকারি কর্মকর্তা হাশেম আলসুকি, যিনি যুদ্ধের শুরুতে আটক ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এবং পরে পরিবারসহ ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছেন, তিনি বলেন,"যা-ই ঘটুক, তা আসাদ শাসনের চেয়ে খারাপ হবে না।"
তিনি আরও বলেন, "১৩ বছরে সিরিয়ানরা অনেক কিছু শিখেছে। আমি বিশ্বাস করি, এই পর্যায় আমরা অতিক্রম করব।"
বর্তমানে, আসাদের বিদায়ের আনন্দে মগ্ন অনেক সিরিয়ান ভবিষ্যতের ভাবনা সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছেন।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়