গ্রিনল্যান্ড বিক্রি করা হলে এর দাম কত উঠত?
সম্প্রতি নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও জানিয়েছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ডের "মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ" নিতে চান।
ট্রাম্প প্রথম ২০১৯ সালে গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সে সময় তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, এটি নতুন কোনো ধারণা নয় এবং এর আগে অন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টও এমন ভাবনা প্রকাশ করেছেন।
বর্তমান সময়ে অঞ্চল বা রাষ্ট্র বিক্রির ঘটনা বিরল। ট্রাম্প এই প্রস্তাব পুনরায় তুলবেন কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, কোন মানদণ্ডে পুরো একটি অঞ্চল বা রাষ্ট্রের মূল্য নির্ধারণ করা হয়?
গ্রিনল্যান্ড কেনার চেষ্টা নতুন নয়
গ্রিনল্যান্ডের কৌশলগত অবস্থান কোল্ড ওয়ার (স্নায়ুযুদ্ধ) শুরুর দিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৪৬ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ডেনমার্কের এই অঞ্চলটি কিনতে ১০ কোটি ডলার মূল্যের সোনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে ডেনমার্ক তার এই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিল।
এক রাষ্ট্রের কাছ থেকে অন্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ড কেনা অদ্ভুত মনে হলেও, ইতিহাসে এমন ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটেছে।
উনিশ শতকের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমে বিস্তারের অংশ হিসেবে বেশিরভাগ ভূখণ্ড কিনেছিল। এর মধ্যে ১৮০৩ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ ডলারে "লুইজিয়ানা পারচেজ" অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০২৪ সালের হিসেবে এর মূল্য প্রায় ৪১৬ কোটি ডলারের সমান।
প্রায় অর্ধশতাব্দী পর, মেক্সিকো-আমেরিকা যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকোর কাছ থেকে বিশাল ভূখণ্ড কিনেছিল।
১৮৬৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে ৭২ লাখ ডলারে আলাস্কা কিনেছিল যুক্তরাষ্ট্র, যা আজকের হিসেবে ১৫০ কোটি ডলারের বেশি।
১৯১৭ সালে ডেনমার্কের কাছ থেকে ২৫ মিলিয়ন ডলারের সোনার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ কিনেছিল, যা বর্তমান মূল্যে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, জাপান, পাকিস্তান, রাশিয়া, জার্মানি এবং সৌদি আরবও ভূখণ্ড কিনেছে। এ ধরনের ভূখণ্ড কেনাবেচায় স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর অধিকার স্থানান্তরিত হয়েছে এবং ক্রেতারা ভূমি, গুরুত্বপূর্ণ জলপথ কিংবা ভৌগোলিক সুরক্ষা লাভ করেছে।
একটি দেশের মূল্য কত?
একটি দেশ (অথবা গ্রিনল্যান্ডের মতো স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল) মূল্যায়ন করা সহজ কাজ নয়। কোম্পানি বা সম্পদের মতো তুলনায় একটি দেশের মূল্য নির্ধারণে অনেক ধরনের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য উপাদান জড়িত থাকে, যা সরল অর্থনৈতিক পরিমাপে ধরা পড়ে না।
মূল্য নির্ধারণের শুরু হতে পারে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দিয়ে। সহজ ভাষায়, জিডিপি হলো একটি অর্থনীতির মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত এক বছরে) উৎপাদিত চূড়ান্ত পণ্য এবং সেবার মূল্য।
তাহলে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উৎপাদিত মূল্যের ওপর ভিত্তি করে দাম নির্ধারণ করা হয়ত সেই বস্তুটির (এক্ষেত্রে পুরো অর্থনীতি) প্রকৃত মূল্য গ্রাহকের কাছে ঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে না। ভবিষ্যতে আরও মূল্য বৃদ্ধির সক্ষমতাও বিবেচনায় নিতে হবে।
গ্রিনল্যান্ডের উৎপাদনশীল সম্পদ শুধু তার বর্তমান ব্যবসা, সরকার এবং শ্রমিকদের উৎপাদিত জিডিপি (যা ২০২১ সালে প্রায় ৩.২৩৬ বিলিয়ন ডলার ছিল) নয়, বরং এর ভবিষ্যতের জিডিপি বাড়ানোর ক্ষমতাও অন্তর্ভুক্ত। এটি নির্ভর করবে, ভবিষ্যতে এই সম্পদগুলো কতটা উৎপাদনশীল হবে তার ওপর।
জিডিপি-তে যা ধরা পড়ে না, এমন আরও কিছু মূল্যবান উপাদান আছে। এর মধ্যে রয়েছে মানব সম্পদ ও পরিকাঠামোর মান, জীবনমান, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কৌশলগত অবস্থান।
অব্যবহৃত সম্পদ
বর্তমানের বাজার দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রিনল্যান্ডের অব্যবহৃত সম্পদগুলোই বর্তমানে দ্বীপটির সব থেকে মূল্যবান সম্পদ।
গ্রিনল্যান্ড দশকব্যাপী কয়লা খনন করছে এবং এখানে বড় (নিশ্চিত) রিজার্ভ রয়েছে। এর উপ-পৃষ্ঠে বিরল ধাতু, মূল্যবান ধাতু, গ্রাফাইট এবং ইউরেনিয়াম পাওয়া গেছে।
কয়লার পাশাপাশি এখানে সোনা, রুপা, তামা, সীসা, জিংক, গ্রাফাইট এবং মার্বেলও রয়েছে।
গ্রিনল্যান্ডের জলসীমায় বড় আকারে তেল উত্তোলনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই সমস্ত সম্ভাবনা গ্রিনল্যান্ডের বর্তমান জিডিপি-তে প্রতিফলিত হয়নি।
জাতীয় সম্পদের মূল্য নির্ধারণ সহজ
একটি বড় জাতীয় সম্পদ, যেমন পানামা খালের (যেটি ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চান) মূল্য নির্ধারণ করা অনেক সহজ।
"সম্পদ মূল্য নির্ধারণের মডেল" মূলত ভবিষ্যতে একটি সম্পদ থেকে কী পরিমাণ আয় হবে, তার অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়।
পানামা খালের ক্ষেত্রে এটি ভবিষ্যতে এর ব্যবহার থেকে আয় এবং যানবাহনের পরিমাণ দেখে হিসাব করা হবে।
তারপর, এর রক্ষণাবেক্ষণ ও ক্ষতির খরচ কাটা হবে। মূল্য নির্ধারণের আরেকটি বিষয় হলো, সেই নিট আয় না পাওয়ার ঝুঁকি।
এভাবে, সম্পদের মূল্য সাধারণত ভবিষ্যতের আয় হিসাব করে নির্ধারণ করা হয়।
আধুনিক সময়ে ভূখণ্ড বিক্রি বিরল ঘটনা
ভূখণ্ড বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে, ভূমি বিক্রির ফলে সাধারণ মানুষের চেয়ে শাসক শ্রেণি লাভবান হতো। আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে যদি স্থানীয় জনগণ বিপক্ষে থাকে, তাহলে ভূমি বিক্রি করা প্রায় অসম্ভব।
এমন গণতন্ত্রগুলো এই নীতিতে চলে, জাতীয় সম্পদ জনগণের সেবায় ব্যবহার হওয়া উচিত, সরকারের পকেটের জন্য নয়। আজকাল কোনও অঞ্চল বিক্রি করতে হলে জনগণের জন্য সুস্পষ্ট ও বাস্তব সুবিধা দেখাতে হবে, যা বাস্তবে কঠিন।
জাতীয়তাবাদও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভূমি জাতীয় পরিচয়ের সাথে গভীরভাবে জড়িত এবং এটি বিক্রি করা অনেক সময় বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হয়। এসব প্রস্তাব সাধারণত লোভনীয় হলেও, অনেক দেশের সরকার এমন প্রস্তাব গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক।
এছাড়া, আন্তর্জাতিকভাবে সীমান্ত পরিবর্তনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী নীতি রয়েছে, কারণ একটানা পরিবর্তন অন্য দেশে দাবি বা সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে।
আজকের পৃথিবীতে একটি দেশ বা তার কোনও অঞ্চল কেনা শুধু একটি চিন্তা হিসেবে থাকতে পারে। দেশগুলো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক একক এবং তা পণ্য হিসেবে বিক্রি করা সম্ভব নয়।
তাত্ত্বিকভাবে গ্রিনল্যান্ডের বিক্রয় মূল্য থাকতে পারে। কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো, এমন একটি লেনদেন কখনও আধুনিক মূল্যবোধ ও বাস্তবতার সাথে মেলে কি না?