এক সিগারেটের বাঁট যেভাবে ৩০ বছরের অমীমাংসিত হত্যারহস্য সমাধানের পথ দেখাল
১১ সন্তানের মা মেরি ম্যাকলাফলিনের ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া এক টুকরো সিগারেটের অবশিষ্টাংশ ছিল তার খুনির পরিচয় খুঁজে বের করার প্রথম সূত্র। তিনি খুন হওয়ার ৩০ বছরেরও বেশি সময় পর এই সূত্রের খোঁজ পান অনুসন্ধানকারীরা।
পরে হত্যার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত ড্রেসিং গাউনের রশির গিঁট থেকে পাওয়া যায় লুকিয়ে থাকা ডিএনএ প্রোফাইল, যা সিগারেটের নমুনার সঙ্গে মিলে যায়।
এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার শুরুতে তদন্তকারীদের বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছিল। কারণ গ্লাসগোর পশ্চিম প্রান্তে যখন ৫৮ বছর বয়সি মেরির মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, প্রধান সন্দেহভাজন তখন এডিনবরার এক কারাগারে বন্দি।
তবে কারাগারের গভর্নরের লগ বই থেকে জানা যায়, মেরিকে যখন খুন হন, সিরিয়াল যৌন অপরাধী গ্রাহাম ম্যাকগিল তখন প্যারোলে মুক্ত ছিলেন।
নথির তথ্য বলছে, ১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভোরে মেরির বাসা থেকে বেরিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি আবার কারাগারে ফিরে গিয়েছিলেন।
সিনিয়র ফরেনসিক বিজ্ঞানী জোয়ান ককরেন বলেন, 'কিছু খুন আছে, যা মনে গেঁথে যায়। মেরির হত্যাকাণ্ড আমার দেখা সবচেয়ে ভয়ংকর খুনগুলোর একটি।'
মৃত্যুর আগের রাতে মেরি হিন্ডল্যান্ড পাব (বর্তমানে ডাক ক্লাব) নামক এক বারে পান করেন ও ডমিনো খেলেন। রাত ১০টা ১৫ মিনিট থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে তিনি একাই বাড়ি যাওয়ার জন্য বার থেকে বের হন। বার থেকে তার ফ্ল্যাটের দূরত্ব এক মাইলেরও কম।
পথে তিনি ডামবার্টন রোডের আর্মান্ডো-র চিপ শপে ঢোকেন। সেখানকার কর্মীদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করতে করতে খাবার ও সিগারেট কেনেন।
মেরিকে উই মে নামে চিনতেন এক ট্যাক্সিচালক। ওই ট্যাক্সিচালক পরবর্তীতে জানান, তিনি দেখেছিলেন, মেরি খালি পায়ে জুতো হাতে নিয়ে হাঁটছিলেনন, আর একজন্য পুরুষ তাকে অনুসরণ করছেন।
ম্যাকগিল কীভাবে মেরির ক্র্যাথি কোর্টের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে ঢুকলেন, সে রহস্য অজানা। তবে জোর খাটিয়ে প্রবেশের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ভেতরে ঢুকে নিজের চেয়ে দ্বিগুণ বয়সি এক নারীকে নির্মমভাবে আক্রমণ করেন তিনি।
তখনও মোবাইল ফোন আসেনি। তাই গ্লাসগো, লানার্কশায়ার ও এয়ারশায়ারে বসবাসরত মেরির বড় পরিবারের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না। সপ্তাহে একবার তার ছেলে মার্টিন কালেন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন।
কিন্তু ১৯৮৪ সালের ২ অক্টোবর ২৪ বছর বয়সি মার্টিন মায়ের ফ্ল্যাটে এসে দেখেন, দরজা বন্ধ। ডাকাডাকি করেও কারও কোনো সাড়া পাচ্ছিলেন। শেষে চিঠির বাক্স খুলতেই তার নাকে ধাক্কা মারে 'ভয়ানক দুর্গন্ধ'।
ভেতরে পাওয়া যায় মেরির মরদেহ—খালি ম্যাট্রেসের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে ছিল।
তার নকল দাঁত পড়ে ছিল মেঝেতে। আর যে নতুন সবুজ পোশাক পরে সেদিন বারে গিয়েছিলেন, সেটি উল্টো করে তার শরীরে পরানো।
সাবেক সিনিয়র তদন্ত কর্মকর্তা ইয়ান উইশার্ট বিবিসিকে বলেন, ঘটনাস্থল ছিল 'অস্বাভাবিক রকমের নৃশংস'। তিনি আরও বলেন: 'সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার হলো, খুন হওয়ার সময় তিনি সরাসরি হত্যাকারীর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।'
ময়নাতদন্তে জানা যায়, লাশ পাওয়ার অন্তত পাঁচ দিন আগে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে মেরিকে।
পরের কয়েক মাসে তদন্তকারীরা ১ হাজারের বেশি মানুষের জবানবন্দি নেন। কিন্তু মেরির খুনির কোনো হদিস মিলল না।
পরের বছর মেরির পরিবারকে জানানো হয়, তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে একজন সিআইডি কর্মকর্তা মেরির মেয়ে জিনা ম্যাকগ্যাভিনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন 'আশা না হারাতে'।
দুই স্বামীর ঘরে মেরির মোট ১১ সন্তান ছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে ভালো পরিচয় ছিল তার।
তবে জিনা বিবিসিকে বলেন, তার মায়ের প্রথম পক্ষের ছয় সন্তান এবং দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে জন্ম নেওয়া পাঁচ সন্তানের মধ্যে টানাপোড়েন ছিল। তিনি বলেন, 'আমি ভেবেছিলাম, খুনি হয়তো আমাদের পরিবারেই লুকিয়ে আছে।' এই সন্দেহের কথা তিনি পুলিশকেও জানিয়েছিলেন। মায়ের হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি বই লিখেছেন জিনা।
তিনি আরও বলেন, 'আমার ভাইবোনরাও ১৯৮৪ সালে আমার মতোই ভাবছিল। তারই কোনো সন্তান এতে জড়িত কিংবা অন্তত কিছু জানত। কিন্তু আমরা কোনো প্রমাণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।'
২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি পৃথক রিভিউ হলেও সন্দেহভাজ খুনির ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়নি।
এরপর ২০১৪ সালে শুরু হয় পঞ্চম রিভিউ। অবশেষে স্কটিশ ক্রাইম ক্যাম্পাসের (এসএসসি) নতুন একটি ডিএনএ প্রোফাইলিং প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে মেলে সাফল্য।
আগে বিশেষজ্ঞরা মাত্র ১১টি ডিএনএ মার্কার পরীক্ষা করতে পারতেন, কিন্তু নতুন প্রযুক্তি ২৪টি আলাদা মার্কার চিহ্নিত করতে সক্ষম। ফলে অতি ক্ষুদ্র কিংবা নিম্নমানের নমুনা থেকেও ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
১৯৮৪ সালে সংগ্রহ করা নমুনাগুলোর মধ্যে ছিল মেরির চুলের গোছা, নখের নমুনা এবং সিগারেটের বাঁট।
এসএসসিতে কর্মরত ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ জোয়ান ককরেনকে বলা হয় ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত প্রমাণ নতুন করে পরীক্ষা করতে। নমুনাগুলো ৩০ বছর কাগজের ব্যাগে সংরক্ষিত ছিল।
জোয়ান বলেন, 'তখনকার দিনে ডিএনএ প্রোফাইলিং সম্পর্কে কারও কোনো ধারণাই ছিল না। ওরা হয়তো জানতই না, এসব জিনিসের মধ্যে কী বিপুল সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। ওরা ভাবতেই পারেনি, এগুলো একদিন কত মূল্যবান হতে পারে।'
নমুনাগুলো এতদিন ধরে সংরক্ষণ করে তদন্ত দল 'অসাধারণ দূরদর্শিতার' পরিচয় দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন এই অভিজ্ঞ ফরেনসিক বিজ্ঞানী।
অবশেষে সাফল্য আসে একটুকরো সিগারেটের অবশিষ্টাংশ থেকে। লিভিং রুমের কফি টেবিলে রাখা একটা ছাইদানি থেকে পাওয়া যায় ওই সিগারেটের বাঁট।
ওই সিগারেট ছিল এমব্যাসি ব্র্যান্ডের, কিন্তু মেরির পছন্দের ব্র্যান্ড ছিল উডবাইন। নতুন এই আবিষ্কার থমকে যাওয়া কেসের তদন্ত দলকে নতুন করে আগ্রহী করে তোলে।
জোয়ান আশা করেছিলেন, প্রযুক্তিগত উন্নতির সুবাদে হয়তো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ডিএনএও শনাক্ত করতে পারবে।
তার আশা পূরণ হলো। সিগারেটের যে অবশিষ্টাংশ আগে কোনো ডিএনএ প্রোফাইল দিতে পারেনি, এবার সেটি একজন পুরুষের সম্পূর্ণ প্রোফাইল দিল।
জোয়ান বলেন, 'এটাই ছিল এই মামলার প্রথম দৃশ্যমান গুরুত্বপূর্ণ ফরেনসিক প্রমাণ।'
ওই প্রোফাইল স্কটিশ ডিএনএ ডেটাবেজে পাঠিয়ে কয়েক হাজার দণ্ডিত অপরাধীর প্রোফাইলের সঙ্গে মেলানো হয়। তারপর ইমেইলের মাধ্যমে ফলাফল পাঠানো হয় জোয়ানের কাছে।
তিনি দ্রুত স্ক্রল করে নিচে গিয়ে দেখেন, একটি বাক্সের পাশে 'ডিরেক্ট ম্যাচ' চিহ্ন দেওয়া।
'এটা গ্রাহাম ম্যাকগিল নামে এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছিল। আমি ফর্মে দেখতে পাচ্ছিলাম, যৌন নির্যাতনের গুরুতর অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার রেকর্ড আছে তার। তিন দশকেরও বেশি সময় পর আমরা অবশেষে এমন একজনকে খুঁজে পেলাম, যার ডিএনএ প্রোফাইল পুরোপুরি মিলে গেছে,' জোয়ান বলেন।
কিন্তু বহুল প্রতীক্ষিত এই আবিষ্কারই জন্ম দিল নতুন এক রহস্যের। কারণ দেখা গেল, মেরিকে যখন হত্যা করা হয়, তখন ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার দায়ে অভিযুক্ত ম্যাকগিল কারাগারেই ছিলেন।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ম্যাকগিল মুক্তি পেয়েছেন ১৯৮৪ সালের ৫ অক্টোবর—মেরিকে শেষবার জীবিত দেখার নয় দিন পর।
সাবেক গোয়েন্দা সার্জেন্ট কেনি ম্যাককাবিনকে দেয়া হয় এই রহস্য সমাধানের দায়িত্ব। কিন্তু তিনিও রহস্যভেদ করতে পারছিলেন না।
এদিকে জোয়ানকে জানানো হয়, শক্তিশালী মামলা গঠনের জন্য আরও ফরেনসিক প্রমাণ প্রয়োজন।
এই অনুসন্ধানই তাকে টেনে নিয়ে যায় আরেকটি 'ডিএনএ টাইম ক্যাপসুল'-এর কাছে—যে ড্রেসিং গাউনের রশি দিয়ে মেরিকে শ্বাসরোধ করা হয়েছিল।
জোয়ানের বিশ্বাস ছিল, যে ব্যক্তি এই দড়িতে গিঁট দিয়েছিল, তার হাতের ডিএনএর নমুনা দড়ির ভাঁজে থেকে যেতে পারে। কাজেই ফরেনসিক ল্যাবে তিনি ধীরে ধীরে দড়ির গিঁট খুলতে শুরু করলেন। ৩০ বছরের বেশি সময় পর কাপড়টি প্রথমবারের মতো উন্মুক্ত হলো।
জোয়ান বলেন, 'আমরা সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ খুঁজে পেলাম—গ্রাহাম ম্যাকগিলের ডিএনএ। দড়ির গিঁটের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। তিনিই এই দড়ি মেরির গলায় পেঁচিয়ে বেঁধে তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করেছিলেন।'
এছাড়া মেরির সবুজ পোশাকে ম্যাকগিলের বীর্যের নমুনাও পাওয়া যায়।
তবে সাবেক গোয়েন্দা ম্যাককাবিন (এখন অবসরপ্রাপ্ত) বিবিসিকে বলেন, শুধু ফরেনসিক প্রমাণই ম্যাকগিলকে দোষী প্রমাণের জন্য যথেষ্ট ছিল না। 'আমাদের কাছে ডিএনএ থাকলেও তাতে কিছু আসত-যেত না। কারণ তার কাছে তো নিখুঁত অ্যালিবাই ছিল। তিনি যদি তখন কারাগারে থাকেন, তাহলে খুন করলেন কীভাবে?'
তদন্ত দল ফের বিপাকে পড়ে যায়। কারণ হত্যাকাণ্ডের সময় এডিনবরার কারাগারটি নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছিল। আর কম্পিউটারবিহীন সেই যুগে ডিজিটাল রেকর্ড সংরক্ষণের ব্যবস্থাও ছিল না। ফলে অনেক কাগজের নথিই হারিয়ে গিয়েছিল।
অবশেষে ম্যাককাবিন অনুসন্ধান চালিয়ে এডিনবরার কেন্দ্রস্থলে ন্যাশনাল রেকর্ডস অভ স্কটল্যান্ডে গভর্নরের পুরনো জার্নাল খুঁজে পান।
আর ওই জার্নালের একটা এন্ট্রিই সবকিছু বদলে দিল।
একটি কয়েদি নম্বরের পাশে লেখা ছিল 'জি ম্যাকগিল', আর তার পাশে সংক্ষিপ্ত রূপ: 'টিএফএফ'। ম্যাককাবিন জানান, টিএফএফের মানে হচ্ছে ট্রেনিং ফর ফ্রিডম—অর্থাৎ সপ্তাহান্তে (উইকএন্ডে) বাড়িতে থাকার অনুমতি।
তদন্ত দল জানতে পারে, ম্যাকগিল দুই দিনের উইকএন্ডের ছুটিতে ছিলেন। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল আরও তিন দিনের প্রাক-প্যারোল ছুটি। ছুটি শেষ করে ১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, মেরিকে হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, কারাগারে ফিরে যান ম্যাকগিল।
এই প্রমাণের সুবাদেই ম্যাকগিলের অপরাধ নিরেটভাবে প্রমাণ করে তদন্ত দল।
২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর গ্রাহাম ম্যাকগিলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখনও তিনি নিবন্ধিত যৌন অপরাধী হিসেবে পুলিশের নজরদারিতে ছিলেন। তবে গ্লাসগোতে এক কোম্পানিতে ফ্যাব্রিকেটর হিসেবে কাজ করছিলেন।
মেরির মেয়ে জিনা বলেন, হত্যাকারীকে গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে তিনি স্বস্তি পেয়েছিলেন। 'বেঁচে থাকতে থাকতে কখনও খুনিকে গ্রেপ্তার হতে দেখব, ভাবতে পারিনি,' বলেন তিনি।
২০২১ সালের এপ্রিলে চার দিনের শুনানির পর ম্যাকগিলকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তাকে অন্তত ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
গ্লাসগোর হাই কোর্টের বিচারক লর্ড বার্নস জানান, মেরিকে হত্যার সময় ম্যাকগিলের বয়স ছিল ২২ বছর।
কিন্তু তিনি যখন কাঠগড়ায় দাঁড়ান, তখন তার বয়স ৫৯।