সাধারণ আফগানদের দুর্দশার কি অন্ত নেই!
হিন্দুকুশ পর্বতমালা ঘেরা আফগানিস্তান। এই পর্বতমালা হিমালয় পর্বতশ্রেণিরই এক বর্ধিত অংশ। এর সৌন্দর্য যেমন অনাবিল তেমনি এই পার্বত্য রুপই আফগানিস্তানকে করে রেখেছে দুর্গম। পার্বত্যাঞ্চল হওয়ার কারণে দেশটিতে ভূমিকম্পের ঝুঁকিও অনেক বেশি। এমনকী আফগানিস্তানের অন্তত ৯টি প্রদেশকে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার রাত (স্থানীয় সময়) দেড়টার দিকে সে হুমকি বাস্তবে রুপ নেয়। মার্কিন সরকারের ভূতত্ত্ব জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) মতে, খোস্ত ও পাকতিয়া প্রদেশে আঘাত হানা ভূকম্পনটি ছিল রিখটার স্কেলে ৬.১ মাত্রার শক্তিশালী।
স্থানীয় সূত্রের বরাতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানাচ্ছে, ভোররাত হওয়ায় অনেক লোক তখন বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলেন। ফলে হতাহত হয়েছে বিপুল সংখ্যক।
আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সূত্র অন্তত ৯২০ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে। আহত হয়েছে আরও অন্তত ৬০০ জনের বেশি। তবে এই সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
টানা চার দশকের যুদ্ধ-বিগ্রহে বিধ্বস্ত, খাদ্য সংকটে নাজেহাল আফগানদের জন্য নতুন বিপর্যয় হয়ে এলো এই দুর্যোগ।
আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান গোষ্ঠীর কুখ্যাতি দুনিয়াজুড়ে ছড়ায় তাদের প্রথমবার ক্ষমতা দখলের পর এই ৯০ দশকের শেষে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল কায়েদাকে আশ্রয় দেওয়ায় ২০০১ সালে আফগানিস্তানে হামলা করে যুক্তরাষ্ট্র। পতন ঘটে তালেবানের। কিন্তু, তাতে শান্তি ফেরেনি। পশ্চিমা জোট বাহিনী ও তাদের সমর্থিত আফগান সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী এক গেরিলা যুদ্ধ চালাতে থাকে তালেবান। টানা ২০ বছর ধরে চলা সে যুদ্ধ অসংখ্য সাধারণ আফগানের প্রাণ কেড়ে নেয়।
তালেবানকে পরাজিত করতে পারেনি পশ্চিমা জোট ও আফগান সরকার। অবশেষে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবানের কাবুল দখলের সময় দেশটি ছেড়ে চলে যায় মার্কিন বাহিনী। পতন ঘটে আশরাফ গনি সরকারের। তারপর থেকে আফগানিস্তানের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা বজায় রেখেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ফেডারেল রিজার্ভ তালেবানের কাবুল দখলের পরই ১০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ বাজেয়াপ্ত করে।
অথচ বিশ্বের অন্যতম বৈদেশিক সহায়তা নির্ভর দেশটির বিপুল সংখ্যক মানুষ আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। তালেবানের ক্ষমতা দখলে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হয়েছে তারাই। খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক মূল্য যখন অস্থিতিশীল, সরবরাহ যখন অনিশ্চিত—তখন বৈদেশিক সাহায্যের অভাবে আফগানিস্তানে অনাহারে ধুঁকছে দারিদ্র্য সীমার নিচে থাকা লাখো মানুষ।
ইতঃপূর্বে চলতি বছরের ৩ মার্চ প্রকাশিত আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, খাদ্য কেনার টাকা যোগাড় করতে শিশুদের বিক্রি করে দিচ্ছে অনেক পরিবার। কন্যা শিশুদের বিক্রির ঘটনা ঘটছে বেশি।
জাতিসংঘ মহাসচিবের সহকারী বিশেষ প্রতিনিধি ড. রামিজ আলাকবারভের মতে, ২ কোটি ৩০ লাখ আফগান এখন নিত্য অনাহারের শিকার। ক্ষুধার এই সংকটকে তিনি অকল্পনীয় মাত্রার বলে উল্লেখ করেন।
আলাকবারভ বলেন, "আফগানিস্তানের ৯৫ শতাংশ জনগণ যথেষ্ট খাদ্য খেতে পারছে না। অনাহারী মানুষের এত বেশি সংখ্যা একেবারে অচিন্তনীয়। অথচ, পরিতাপের বিষয় সেটাই বাস্তবতা।"
মার্চের শুরুতে এই বিবৃতি দেওয়ার সময় তিনি আরও জানান, আফগানিস্তানে নারীদের ওপর আয়ের জন্য নির্ভরশীল পরিবারগুলির ক্ষেত্রে অনাহারে থাকার হার শতভাগ।
তালেবান শাসনে সবদিক দিয়েই বঞ্চণার শিকার হতে শুরু করছে নারীরা। নারী অধিকার রক্ষায় দেওয়া তাদের আগের প্রতিশ্রুতি থেকে তালেবান সরে আসছে।
২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলিতে পুনরায় ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু, ছেলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরতে পারলেও মাধ্যমিক স্তরের মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঘরে থাকার নির্দেশ দেয় তালেবান সরকার।
তালেবান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক ঘোষণায় জানায়, সপ্তম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম চালু হচ্ছে। পুরুষ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। তবে নারী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা ফিরতে পারবেন কিনা, এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
এভাবে ধীরে ধীরে নারীদের শিক্ষা ও কর্মস্থলে অংশগ্রহণের অধিকার সীমিত হয়ে পড়ছে। দীর্ঘ লড়াইয়ে যে দেশে অনেক পরিবারে পুরুষ সদস্যই মৃত বা পঙ্গু; সেখানে সংসারের হাল ধরেছিলেন শিক্ষিত নারীরা। তারাও এখন ঘরের কোণে বন্দী হয়ে পড়ছেন।
ড. রামিজ আলাকবারভের উল্লেখিত নারী-চালিত পরিবারের শতভাগ অনাহারে থাকার ঘটনাটি সেকারণেই ঘটছে।
- সূত্র: আল জাজিরা, বিবিসি