স্বপ্নের ভ্যানে করে দুবেলা খাবার পৌঁছে দেন তিনি
স্বপ্ন কি অন্যের কাছে বিক্রি করা যায়! তা হয়তো যায় না, কিন্তু চাইলে অন্যদের মুখে হাসি ফোটানো যায়, আর এটাই সমাজের কারও কারও কাছে স্বপ্ন পূরণের চেয়ে বেশি কিছু। 'তাজুল ইসলাম লিখন' তাদের দলের একজন। তার 'ড্রিম ভ্যান ফাউন্ডেশন' থেকে গত ৫ বছর ধরে নিরলস শ্রম ও ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অন্যদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন অবিরাম।
নিজের স্বপ্নের ভ্যানে করে অসহায়, হত দরিদ্র মানুষের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন পুষ্টিকর খাবার। বেশ কিছুদিন আগে তার সেই তিন চাকার ভ্যানে বসিয়েছেন মটর যন্ত্র। কেননা তাকে ছুটে যেতে হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রান্তিক অসহায় মানুষের কাছে।
জীবিকা নির্বাহে মাঝে মাঝে টুকটাক কিছু কাজ করলেও; দেশ ও মানুষের সংকট মুহূর্তে তা ছেড়ে ছুড়ে ছুটে যান দূর-দূরান্তে সাধ্যমতো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে । বর্তমানে তিনি বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে হাজির হয়ে গেছেন সিলেট অঞ্চলে। পানিতে ভেসে গেছে যাদের ঘর ও স্বপ্ন তাদেরকে দুবেলা দুমুঠো রান্না করা পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্যে।
এতোসবের মধ্যে নিজে খুব সাদামাটা জীবন ধারণ করে চলেছেন। কিন্তু এতে তার কোনরকম দুঃখবোধ নেই, অন্যদের আহারের ব্যবস্থা করার পর তাদের মুখের প্রশান্তির হাসি তাকে আরও উৎসাহী করে তুলে ও অনুপ্রেরণা জোগায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।
স্বপ্নের ভ্যান যাত্রা
তাজুল ইসলাম লিখন কাজের সূত্রে দীর্ঘ ৫বছর দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকলেও নিজ দেশের প্রতি গভীর টান অনুভব করতেন। সেখান থেকে দেশে ফিরে এসে তিনি চিন্তা করলেন নিজ দেশেই ছোট একটা ব্যবসা দিয়ে বসবেন। অন্যদেশে যেয়ে ছোটখাটো কাজ করতে বাঙালি লজ্জাবোধ না করলেও নিজ দেশে ঐ একই কাজ করতে অনেকের আত্মসম্মান বোধে লাগে। এই চিন্তাধারাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে তিনি শুরু করেন তার স্বপ্নের ভ্যানের যাত্রা। নিজে ভ্যান চালিয়ে ঢাকার একস্থান থেকে অন্য স্থানে গিয়ে মেয়েদের ব্যাগ, জুতা, মাথার টুপি, টি-শার্ট ও অন্যান্য ব্যবহৃত জিনিসপত্র বিক্রি করতেন।
বিদেশের ভালো চাকরি ছেড়ে অনিশ্চিত এই পথের যাত্রা কেন শুরু করলেন এই ব্যাপারে 'লিখন তাজুল' বলেন- "কোন কাজই যে ছোট না, এটাই ছিলো আমার কাজের মূল প্রেরণা শক্তি। আমি মনে করি কোন কাজ না করাটা লজ্জাজনক।
আমাদের সমাজে খাটো করে দেখা কাজগুলো যারা করছেন তারাও অন্যদের মতো সম্মানের প্রাপ্য। এই চিন্তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমি নিজের সঞ্চিত অর্থ থেকে একটি ভ্যান কিনে কাজে লেগে পড়ি। কিন্তু করোনা মহামারী দেখা দিলে আমাকে মানুষের জন্য কিছু করতে হবে এই বোধের সঞ্চার হয়। তাই কাপড় ও ব্যাগ বিক্রি রেখে মানুষের জন্য একবেলা পুষ্টিকর খাবার জোগান দেওয়ায় নেমে পড়লাম"।
প্রজেক্ট জগাখিচুরি
মাত্র ৩০ টাকায় পাওয়া যায় জগা মামার জগাখিচুরি। তাও সেই খিচুরিতে দেওয়া হয় কয়েকরকমের সবজি, ডাল ও মাঝে মাঝে সাথে থাকে ডিম ও মুরগী। বর্তমানে এই খিচুরির মূল্য জনপ্রতি ৪০ টাকা। কিন্তু অর্থ নির্ধারণ করার বিষয়টি খিচুরি কেনার সাথে সম্পর্কিত না। রান্নার পরিমাণ ও প্রতিজনের জন্য খাবার আয়োজনের খরচের হিসেব রাখতেই এই মূল্য নির্ধারণ করা। কয়েকবছর ধরে বিনামূল্যে পথশিশু ও বস্তি এলাকায় বাস করা মানুষ ও শিশুদের মাঝে বিনামূল্যে খিচুরি বিতরণ আয়োজন করে আসছে তাজুল লিখনের 'ড্রিম ভ্যান ফাউন্ডেশন'।
শুরুর দিকে তাজুল লিখনের এই উদ্যাগের পেছনের কারণ ছিল, তিনি ভ্যান চালিয়ে ঢাকা শহরের একোণ থেকে ওই কোণে ঘুরতে ঘুরতে দেখতেন নিম্ন আয়ের বেশিরভাগ মানুষ শুধু একটি রুটি ও কলা খেয়ে সারাদিন কায়িক শ্রম করছে। সেখান থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন রুটি-কলার দামে তিনি এই মানুষদের ভালোমানের পুষ্টিকর খাবার দেবেন। তারপর দুইজন লোক সাথে নিয়ে চালু করে দিলেন 'প্রজেক্ট জগাখিচুরি'।
রিক্সাওয়ালা, দিনমজুর থেকে অন্যান্য পেশাজীবির লোকেরা তার থেকে দুপুরের এই খাবারটি কিনে নিতেন। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সময়তেও তিনি দামে ও মানে কোনরকম হেরফের হতে দেননি। কিন্তু সমস্যায় পড়ে গেলেন রান্না করা বাবুর্চিদের বেতন দিতে না পেরে। তার এই উদ্যোগটি কোন লাভজনক ব্যবসার উদ্দেশ্যে তিনি করেননি। স্বল্পমূল্যের খিচুড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে কোনরকমে চাল, ডাল, তেল, সবজি কেনার পয়সার জোগান হতো ঠিকই। কিন্তু জীবিকার জন্য অন্যকোন উৎস থেকে অর্থ উপার্জন ছিলনা।
তাই রান্নার লোকেদের বেতন চুকাতে না পারলে তারা বিদায় নিলো। প্রতিদিনকার মতো লোকেরা ভিড় করতে লাগলো তার ভ্যানের সামনে খাবারের জন্য। নিরুপায় হয়ে তাজুল লিখন নিজেই জগা খিচুড়ি রান্না করতে শুরু করে দিলেন। সেই থেকে বাচ্চা, বুড়ো সকলের কাছে একনামে পরিচিত হয়ে গেলেন 'জগা মামা' হিসেবে।
জগা মামার সেরা খিচুড়ি
খিচুড়ির স্বাদ ও মানের কারণে জগা মামা বাচ্চাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। সমাজের দরিদ্র মানুষের জন্যে রান্না করার ক্ষেত্রে কোনরকম হেলা ফেলা করে দায় সারা কাজ করতে রাজি না ড্রিম ভ্যান ফাউন্ডেশনের এই প্রতিষ্ঠাতা। একসাথে অনেক জনের জন্যে খিচুড়ি রান্না করা হলেও, সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যকর উপায় মেনেই সকল কাজ করা হয়।
প্যাকেটজাত তেল থেকে শুরু করে ভালো মানের চাল ও ডাল ব্যবহার করা হয় রান্নায়। খিচুড়িতে ডালের পরিমাণ থাকে চালের ৮০ ভাগ এবং সেখানে ব্যবহার করা ৩প্রকারের দেশি ডাল, যা খিচুড়ির স্বাদকে আরও বাড়িয়ে তোলে। সবজি দিয়ে তৈরি করা এই খিচুড়ির সাথে মাঝে মধ্যে ডিম ও মুরগি থাকলেও সবার কাছে এটা জগা খিচুড়ি নামেই পরিচিত। এমনকি খাবার পরিবেশনে স্বাস্থ্যসম্মত মান বজায় রাখতে ওয়ান টাইম প্লেটে করে খেতে দেওয়া হয়।
উদ্যোক্তা তাজুল লিখন জানান, " প্রথমদিকে প্রজেক্টটি চালু হওয়ার ২মাসের মাথায় ৩০০জনের ওপর খাবার বিক্রি হয়েছে। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলিতে আমি ঢাকার বস্তি এলাকায় গিয়ে বাচ্চাদের জন্য খিচুরি রান্না করে তাদের মাঝে বিতরণ করতাম। তারপর করোনার সময় গোটা বিশ্ব থমকে গেলে ঢাকার বিভিন্ন বস্তি এলাকায় এককালীন খাদ্যসামগ্রী সহায়তা দেওয়ার বদলে সপ্তাহের জন্য কয়েক কেজি চাল, ডাল, সবজি, তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দিয়ে আসতাম। শুরুর দিকে একাই রান্না ও যাবতীয় কাজ করলেও পরবর্তীতে একার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তাই প্রতিটি বস্তি থেকে কয়েকজন কে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হতো রান্নার জন্যে"।
কাজে স্বচ্ছতা রাখতে চাই
একবছর ধরে তাজুল লিখন উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রামে গিয়ে মানুষের খাবারের ব্যবস্থা ও অন্যান্য নানাভাবে সহায়তা করছেন। প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে থাকছেন ছোট্ট ভাড়া করা এক মাটির ঘরে। কেন সাদরে এমন জীবন কাটাচ্ছেন তার কারণটাও জানালেন নিজে। তিনি বলেন, "ঢাকার মধ্যে দরিদ্র মানুষদের খাবার দিয়ে আসছিলাম দীর্ঘদিন ধরে। একটা সময় মনে হলো ঢাকায় কাজের অনেকরকম ব্যবস্থা রয়েছে, আর কর্মঠ হলে সারাদিনের উপার্জিত অর্থে খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভব। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ের লোকদের অবস্থা আরও করুণ। এখানে সারাদিন কাজ করেও মিলে না ন্যায্য পারিশ্রমিক। তাই গত ১বছর ধরে আমি এখানকার মানুষদের পাশে নিজেকে সামিল করেছি"।
"কুড়িগ্রামের যে সকল পরিবারে কোন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নেই এবং বয়স্ক লোকদের যাদের আপন স্বজন নেই তাদের জন্যে ফাউন্ডেশন থেকে নতুন প্রজেক্ট নেওয়া হয়েছে। প্রতিমাসে ১হাজার পরিবারকে পৌঁছে দেওয়া হবে ১৫০০টাকার নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার। গ্রামের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীরা কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। এছাড়াও আমরা সাধ্যমতো চিকিৎসা খরচ ও বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ বহন করে থাকি, তবে সেটা যাচাই করা স্বাপেক্ষে। কেননা সমাজে ভালো মানুষ যেমন আছে তেমনি কিছু অসৎ লোক রয়েছে, যারা মিথ্যা প্রয়োজন দেখিয়ে সাহায্য সুবিধা নিয়েছে-যা আমরা পরবর্তীতে জানতে পারি"।
ব্যক্তি পর্যায়ে 'ড্রিম ভ্যান ফাউন্ডেশনের' কার্যক্রম ধীরে ধীরে শুরু হওয়ার পর অনেকেই এগিয়ে আসেন অনুদান দেওয়ার জন্য। এর মধ্যে বেশিরভাগ ছিলেন উদ্যোগক্তা তাজুলের পরিচিতজন ও আত্মীয়। এখনো তাদের বিশাল অবদানে এগিয়ে চলেছে ফাউন্ডেশনের কাজ। দাতাদের কেউ কেউ থাকেন দেশের বাইরে। তাই নিজেরা দেশে এসে গরীব মানুষের পাশে দাঁড়াতে না পারলেও থেমে নেই তাদের মহৎ কাজের শামিল হওয়া থেকে নিজেদের দূরে রাখা। পাঠানো অর্থ থেকে চলে প্রতিদিন শত শত মানুষের আহারের আয়োজন।
বর্তমানে 'ড্রিম ভ্যান ফাউন্ডেশনে' ৩০জন সদস্য রয়েছে। যারা আর্থিক ও মানসিকভাবে সহায়তা করে যাচ্ছে। রমজান মাসে 'ড্রিম ভ্যান ফাউন্ডেশনের' পক্ষ থেকে প্রায় ২০ হাজার মানুষের মাঝে ইফতার বিতরণ করা হয়। ছোট ছোট শিশুদের কে উপহার দেওয়া হয় ইদের নতুন জামা, যা হাতে পেয়ে শিশুদের চোখে মুখে আনন্দের রেখা খেলা করছিল।
ফাউন্ডেশনে আসা অনুদান অর্থের পাই পাই হিসেব রাখেন তাজুল লিখন। কাজে দায়িত্ববোধ ও স্বচ্ছতা রাখতেই তার এই হিসেব রাখা। তিনি বলেন, "মানুষ আমাকে অনেকে ভরসা করে নিজেদের উপার্জিত কষ্টের টাকা তুলে দেন, দুবেলা পথশিশু ও দরিদ্রদের জন্যে খাবারের ব্যবস্থা করতে। এখন আমি যদি সেই কাজে ফাঁকি দেই তাহলে সেটার জবাবদিহিতা কিন্তু কেউ করতে আসবে না। তাই আমি চাই আমার দায়িত্বে যেন কোনরকম হেলাফেলা না হয় তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে। যে সকল দাতারা অনুদান দেন তাদের নাম ও অর্থের অঙ্ক উল্লেখ করে দেওয়া হয়। এমনকি কি পরিমাণ খাবারের আয়োজন করা হয়েছে, তার সব হিসেবও আমি উল্লেখ করে দেই।
অনেকেই বলেন দান করলে নাম উল্লেখ করতে নেই। কিন্তু আমি এই নীতিতে বিশ্বাসী নই। দেখা গেল ১০জন দাতা অর্থ দিয়েছেন এবং আমি তাদের নাম ও অর্থের অঙ্ক উল্লেখ করে দেইনি। তাহলে আমি কোথায় কি পরিমাণ মানুষের খাবারের আয়োজন করেছি, তা কিন্তু মানুষ জানতে পারবে না। একান্তই কেউ নাম উল্লেখ করতে না চাইলে তাদের মা-বাবা বা অন্য কোন কোড নাম ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু আমি আমার স্বচ্ছতার জায়গা থেকে চাই সবকিছু প্রকাশ করতে এবং হিসেব রাখতে। কারণ মানুষের জন্যেই যখন কাজ করা সেখানে ব্যক্তিস্বার্থ থাকতে পারে না বলে আমি মনে করি"।
'তাজুল লিখন' স্বাধীনচেতা এই মানুষটিকে সংসার জীবন টানতে পারেনি। তাইতো নিজের জন্যে ভাবতে গেলে তার চিন্তা একটাই- তিনি মানুষের জন্য কাজ করে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে চান। এবং ক্ষুদ্র থেকে শুরু করা সেই স্বপ্নের ভ্যান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষদের স্থায়ী পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করে দিতে চান। ইতিমধ্যে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কলাতিয়ায় গড়ে তুলেছেন পুর্নবাসনের জন্য স্থায়ী ঠিকানা।