ভোজ্যতেলের বাজার: পাইকারিতে দাম কমলেও সরকার নির্ধারিত দামে ঠকছেন ভোক্তারা
দীর্ঘদিন ঊর্ধ্বমুখী থাকার পর পাইকারি বাজারে ব্যাপক দরপতন হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ভোজ্যতেলের দামে। গত পনের দিনে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে প্রতি লিটার পাম অয়েলে ৪১ টাকা এবং সয়াবিনে ২১ টাকা কমেছে। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত দামের কারণে পূর্বের দামেই বিক্রি হচ্ছে পণ্যটি। এতে বোতল-মোড়কজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হলেও ঠকছেন ভোক্তারা।
ভোজ্যতেল আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গত দুই মাসে ভোজ্যতেলের বাজারে ব্যাপক দরপতন হয়েছে। এর প্রভাবে দেশীয় পাইকারি বাজারে আমদানিকৃত পণ্যটির দাম কমতে শুরু করেছে। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত দামের কারণে সেই সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা।
ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে জুনের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত প্রায় দুই মাস রেকর্ড দামে বিক্রি হয়েছে ভোজ্যতেল। ওই সময় প্রতিমণ (৪০ দশমিক ৯০ লিটার) পাম অয়েল ৭ হাজার টাকা ও সয়াবিন ৭ হাজার ৫০০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবে দেশীয় পাইকারি বাজারে জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে পণ্যটির দাম। সোমবার খাতুনগঞ্জে প্রতিমণ পাম অয়েল ৫৩০০-৫৪৫০ টাকা এবং সয়াবিন ৬৬১০-৬৬৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেই হিসেবে, গত দুই সপ্তাহে প্রতি মণ পাম অয়েলে ১ হাজার ৭০০ টাকা এবং সয়াবিনে ৮৯০ টাকা পর্যন্ত দাম কমেছে। উপরোক্ত বাজার দর অনুযায়ী- পাইকারি পর্যায়ে প্রতি লিটার পাম অয়েলে ৪১ টাকা ও সয়াবিনে ২১ টাকা পর্যন্ত দাম কমেছে।
কিন্তু খুচরা পর্যায়ে এই পর্যন্ত প্রতি লিটার পাম অয়েলে মাত্র ১৪ টাকা ও সয়াবিনে ৬ টাকা দাম কমানো হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে পাইকারির তুলনায় খুচরা পর্যায়ে একজন ভোক্তাকে প্রতি লিটার পাম অয়েলে ২৭ টাকা ও সয়াবিনে ১৫ টাকা বাড়তি গুনতে হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ২৬ জুন সরকার প্রতি লিটার সয়াবিনে ২০৫ টাকা থেকে ৬ টাকা কমিয়ে ১৯৯ টাকা নির্ধারণ করে। এর আগে গত ৯ জুন প্রতি লিটারে ১৪ টাকা কমিয়ে ১৭২ টাকা থেকে ১৫৮ টাকা নির্ধারণ করে পাম অয়েলের দাম। এরপর থেকে এখনো পর্যন্ত খুচরা পর্যায়ে উপরোক্ত নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ধারাবাহিক দরপতন অব্যাহত রয়েছে ভোজ্যতেলের। ইনভেস্টিং ডট কমের তথ্যমতে, আজ সোমবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন পাম অয়েল ১ হাজার ১০৮ ডলার বিক্রি হয়েছে। এর আগে গত ১৫ জুন প্রতি টন পাম অয়েল ১ হাজার ২৯০ ডলার, মে মাসে ১ হাজার ৭১৭ ডলার, এপ্রিলে ১ হাজার ৬৮৩ ডলার ও মার্চে ১ হাজার ৭৭৭ ডলারে বিক্রি হয়েছে। উপরোক্ত দর অনুযায়ী, গত দুই মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন পাম অয়েলের দাম কমেছে ৬৭০ ডলার।
আন্তর্জাতিক বাজারে গতকাল সোমবার প্রতি টন সয়াবিন তেল ১ হাজার ৫১০ ডলারে বিক্রি হয়েছে। এর আগে গত ১৫ জুন প্রতি টন সয়াবিন ১ হাজার ৭২৮ ডলার, মে মাসে ছিল ১ হাজার ৯৬৩ ডলার, এপ্রিলে ১ হাজার ৯৪৮ ডলার এবং মার্চে ১ হাজার ৯৫৭ ডলারে বিক্রি হয়েছে। সেই হিসেবে, এক মাসেই বিশ্ববাজারে প্রতি মণ সয়াবিনের দাম কমেছে ৪৫৩ ডলার।
উপরোক্ত বুকিং দর অনুযায়ী, গত দুই মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি মণ পাম অয়েলে ২ হাজার ৬০৩ টাকা ও সয়াবিনে ১ হাজার ৭৬০ টাকা দাম কমেছে।
খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী মেসার্স আর এম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমে যাওয়ায় গত দুই সপ্তাহ খাতু্নগঞ্জেও পণ্যটির ব্যাপক দরপতন হয়েছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে লিটারে ৪২ টাকা কমে বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি লিটার পাম অয়েল ১২৯ টাকা ও সয়াবিনে ২২ টাকা কমে ১৬১ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে এর চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। এতে আমদানিকারকদের কাছ থেকে বেশি দামে পণ্য কিনে পাইকারি ব্যবসায়ীরা লোকসান দিলে ও অন্যদিকে বেশি দামে বোতল ও মোড়কজাত পণ্য কিনে ভোক্তারা ঠকছেন।
ভোক্তাদের অভিযোগ, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার সাথে সাথেই দেশীয় বাজারে পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দেয় আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বিশ্ববাজারে এমনকি দেশীয় পাইকারি বাজারেও পণ্যটির দাম কমলে খুচরায় সহজে দাম কমে না। দাম বৃদ্ধি করতে মোড়কজাত প্রতিষ্ঠানগুলো ও সরকারি সংস্থাগুলোকে যেভাবে চাপ সৃষ্টি করে, ঠিক একইভাবে দাম কমাতে কাজ করে না একই সংস্থাগুলো। এভাবে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভোক্তারা।
তবে ভোজ্যতেল আমদানিকারক ও বোতলজাতকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের উপমহাব্যবস্থাপক প্রদীপ কারণ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবে দেশের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো ভোজ্যতেলের দাম কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি আগের বাড়তি দামে কেনা পণ্যও এখন লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। কারণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কেউ চাইলেও পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে পারে না। খুচরা বাজারে ইতোমধ্যে পাম ও সয়াবিনের দাম এক দফা কমিয়ে দাম সমন্বয় হয়েছে। পাইকারি বাজারের মতো খুচরা বাজারেও ভোজ্যতেলের দাম কমে আসতে পারে।
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যবসায়ীদের দাবিতে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে তোড়জোড় করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে এবং পাইকারিতে দাম কমার পর দাম সমন্বয় করতে কমিশনের অনাগ্রহ। এই থেকে প্রশ্ন উঠে, ট্যারিফ কমিশন কি শুধু ব্যবসায়ীদের মুনাফা দেখবে? না ভোক্তাদের স্বার্থও বিবেচনায় আনার দরকার রয়েছে। খুব শিগগিরই আন্তর্জাতিক বাজার ও পাইকারি বাজারের সাথে দাম সমন্বয় করে ভোজ্যতেলের দাম পুনঃনির্ধারণের জোর দাবি জানাচ্ছি।'
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, ৩০ মে পর্যন্ত গত পাঁচ মাসে চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর দিয়ে মোট ১৫ দশমিক ১১ লাখ টন ভোজ্যতেল (পাম এবং সয়াবিন) আমদানি হয়েছে। যার আমদানি মূল্য ১৮ হাজার ১৮২ কোটি টাকা।