কোনো দেশ দেউলিয়া হয়ে পড়লে কী হয়?
চরম আর্থিক ও মানবিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র- শ্রীলঙ্কা। এরমধ্যেই দেশটি দেউলিয়া দশা বলে আজ মঙ্গলবার (৫ জুলাই) পার্লামেন্টকে জানিয়েছেন লঙ্কান প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। তিনি বলেছেন, দেউলিয়া হিসেবেই শ্রীলঙ্কা এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ঋণ গ্রহণের আলোচনায় অংশ নিচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে শ্রীলঙ্কার। নেই নিত্যপণ্য আমদানির অর্থ। এই অবস্থায় খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানিসহ সকল নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে, চড়া মূল্যস্ফীতি লঙ্কানদের নাভিশ্বাস ওঠাচ্ছে। আর্থিক শক্তিও ফুরিয়ে এসেছে সরকারের।
আগের সরকারের উচ্চ ব্যয় এবং কর কর্তনের কারণে রাষ্ট্রের আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছিল। তার সাথে যোগ হয় চীন থেকে নেওয়া বিপুল অঙ্কের ঋণ পরিশোধের চাপ। করোনা মহামারির পর পর্যটন খাতের ধসও দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা আয় সংকুচিত করেছে।
রাজস্ব কমায় স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে ঋণ নিয়েছে লঙ্কান সরকার। এসব ঋণ পরিশোধে সরকার টাকা ছাপানো বাড়ালে মুদ্রার মান কমে যায়। তাতে মূল্যস্ফীতির আগুন নেয় সর্বনাশা রূপ। চলতি বছরের শুরুতে বিশ্বব্যাংক অনুমান করেছিল যে, সংকট শুরুর পর দেশটির অন্তত ৫ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র্য হয়েছে। অর্থাৎ, গত পাঁচ বছরে দারিদ্র্য দূরীকরণের সাফল্য উবে গেছে কয়েক মাসের ব্যবধানে।
নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। ধীরে ধীরে আরো গভীর হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি। জ্বালানির অভাবে দেশটি জুড়ে চলছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। বাস্তবতা মেনে নিয়ে দেউলিয়া দশা স্বীকার করেছে লঙ্কান সরকার। প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে তাই জানিয়েছেন আজ। কীভাবে বা কখন একটি দেশ দেউলিয়াত্ব ঘোষণা দেয় এবং তারপর কী ঘটে চলুন তাই বুঝে নেওয়া যাক-
রাজস্ব ও বিনিয়োগ থেকে পাওয়া আয়ের মাধ্যমে নিজস্ব দেনা মেটায় কোনো দেশের সরকার। তবে বেশি খরুচে মানুষ যেমন ঋণগ্রস্ত হয়, সরকারি ব্যয় লাগামছাড়া হলেও তা ঘটতে পারে। তখন সরকারকে আরো ঋণ নিতে হয়। ঋণ পেতে বন্ড ইস্যু করে সরকার। বন্ডের মেয়াদ পূর্ণ হলে এর সুদ ও আসল পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় উৎস থেকে নেওয়া ঋণ মিলে হয়- জাতীয় দেনা। একে সচরাচর সার্বভৌম দেনাও বলা হয়। সরকারের ইস্যু করা বন্ডের মাধ্যমে বেশিরভাগ বাহ্যিক ঋণ বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়া হয়, যে বন্ড কেনেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ ঋণ সরকার দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেয় বা জনগণের মধ্যে ঋণপত্র ইস্যুর মাধ্যমেও নিতে পারে।
সরকারের বাজেট বরাদ্দ থেকে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করার ব্যবস্থা থাকে। এজন্য অনেক সময় সরকার টাকা বেশি ছাপায় বা করের আওতা বাড়ায়।
তবে বাহ্যিক ঋণের একটি বড় বিপদ, এজন্য বাজেটে অন্যান্য রাজস্ব বৃদ্ধিকারী খাতে বরাদ্দ কমিয়ে সে অর্থ দেনা পরিশোধে রাখতে হয়। এ ঋণ শোধ করতেও হয় বৈদেশিক মুদ্রায়—যার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
"কোনো দেশ কখনোই আসলে দেউলিয়া হয় না"
'একটি দেশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে'- এমন ভাষ্য সঠিক নয়। প্রথমত- কোনো দেশ তার দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হলেই দেউলিয়া হয় না; বরং ঋণখেলাপি হয়। দ্বিতীয় কারণ, খেলাপি সরকার হয়, কোনো দেশ নয়।
রাষ্ট্রের ঋণ খেলাপি হওয়াকে বিরল ঘটনা মনে করা হলেও, জাতীয় ইতিহাসে প্রায় সব দেশই কোনো না কোনো সময় খেলাপি হয়েছে বা তাদের ঋণ পুনর্গঠনে বাধ্য হয়েছে।
প্রথম উন্নত দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ১৮০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়েছিল গ্রীস। ১৮২৯ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশটি অর্ধেকের বেশি সময় ঋণ খেলাপির তালিকায় রয়েছে।
সবচেয়ে বেশিবার খেলাপি হয়েছে স্পেন। ১৮ ও ১৯ শতকের মাঝামাঝি স্পেনীয় সরকার ১৫ বার ঋণ শোধে ব্যর্থ হয়।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক দাতাগোষ্ঠী আইএমএফ এর অধিকাংশ সদস্য দেশ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সংস্থাটির কাছে প্রায়শই 'বেইলআউট' বা দেউলিয়াত্ব প্যাকেজের আওতায় মন্দা কাটিয়ে ওঠার ঋণ চায়। এর আওতায় আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি পুনরুদ্ধার ব্যবস্থাপনার কৌশলগত পরামর্শ ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করে আইএমএফ।
তবে কড়া শর্তের অধীনে বেইলআউট ঋণ দেয় আইএমএফ, যার মধ্যে থাকে সরকারি ব্যয় সংকোচন, মুদ্রার মান অবনমন, বাণিজ্য উদারীকরণের মতো নানাবিধ শর্ত।
যেকারণে খেলাপি হয় একটি দেশ?
দেনা পরিশোধে কোনো দেশের অক্ষমতা বা অপারগত খেলাপি সৃষ্টি করে। যেমন কোনো দেশের ক্ষমতা পরিবর্তন হওয়ার পর, নতুন দলের সরকার ক্ষমতায় এসে সাবেক সরকারের করা ঋণ পরিশোধে প্রায়ই খেলাপি করে এমন নজির রয়েছে। খেলাপি হওয়ার পেছনে আরো অন্যান্য কারণও আছে। বৈশ্বিক মুদ্রা প্রবাহের গতি পরিবর্তিত হওয়া বা অপর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় সরকারের জন্য আর্থিক সংকট সৃষ্টি করে। যেমন- ২০১০ সালে সরকারের অতি ব্যয় এবং প্রধান শিল্প পর্যটনে ধস নামায় ৭৯০ কোটি ডলারের ঋণ খেলাপি হয় জ্যামাইকা।
কোনো দেশ খেলাপি হলে তারপর কী হয়?
ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণ খেলাপি হলে তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ঋণ দাতারা। তবে কোনো দেশ খেলাপি হলে ঋণদাতা এর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারে না অথবা যে পরিমাণ অর্থ ওই দেশের সরকারের কাছে না থাকায় খেলাপি হয়েছে-তা পরিশোধে বাধ্যও করতে পারে না।
তবে ওই দেশের বিদেশে থাকা সম্পদের ক্ষেত্রে এই নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। যেমন ২০১২ সালে আর্জেন্টিনা ঋণ খেলাপি হওয়ার পর ঘানায় থাকা দেশটির নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ জাহাজ জব্দ করা হয়।
এই অবস্থায় দেনাগ্রস্ত দেশকে ঋণদাতার একমাত্র উপায় হচ্ছে দেশটির সরকারের সাথে ঋণের শর্ত পুনরায় আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ। আলোচনার ভিত্তিতে সরকার আগে যে বন্ডে ঋণ নেওয়া হয়েছিল সেটি বাতিল করে ঋণদাতার প্রতি নতুন বন্ড ইস্যু করতে পারে, তবে নতুন বন্ডের মূল্য পুরোনোটির চেয়ে কম হয়।
যেমন ২০১১ সালে ৮১ বিলিয়ন ডলার খেলাপি করে আর্জেটিনা। এসময় দাতাদের খেলাপি করা অঙ্কের এক-তৃতীয়াংশ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়। এর আওতায় প্রতিশ্রুত অঙ্কের ৯৩ শতাংশ দেনা ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে নতুন বন্ড বা সিকিউরিটিজের সাথে বিনিময় করা হয়। ২০১৬ সালের আগপর্যন্ত বাকি ৭৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ পরিশোধ করেনি দেশটি।
খেলাপি হওয়ার ক্ষতিকর পরিণতি
এভাবে মোট ঋণের বড় অংশ পরিশোধে কোনো দেশের সরকার ব্যর্থ হলে বা ঋণ পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিলে- তাতে ঋণদাতার আসল ও সুদের ক্ষতি হয়।
বিদেশি বেসরকারি ঋণদাতাদের পক্ষ থেকে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ কম থাকায় কোনো সরকার তাদের দেনা অবলোপন বা বাতিল করার সিদ্ধান্তও নিতে পারে।
তবে সরকার খেলাপি করলে তাতে মূল্যস্ফীতি চরম রূপ নেয়, বাড়ে বেকারত্ব এবং রাজনৈতিক চাপও মোকাবিলা করতে হয়। এভাবে সংকট ঘনীভূত হতেই থাকে।
সরকারের বেশিরভাগ অভ্যন্তরীণ ঋণদাতা হয় সাধারণত স্থানীয় ব্যাংকিং খাত। ঋণ বেশি হলে আর্থিক ব্যবস্থার ওপর মানুষ আস্থা হারায়। তখন আমানতকারীদের মধ্যে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়, যাকে বলা হয় 'ব্যাংক রান'। এই বিপত্তি এড়াতে পুঁজি উত্তোলনের সীমা আরোপ করা হয়। এর মাধ্যমে আমানত কতখানি উত্তোলন করা যাবে- তা সরকার নির্ধারণ করে দেয়।
২০১৫ সালে ব্যাংকিং খাতে সংকট এড়াতে টানা ২০ দিন গ্রীক ব্যাংকগুলি বন্ধ রাখা হয়েছিল। সীমিত করা হয় বিদেশের ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তর ও নগদ উত্তোলন।
তবে অর্থাভাবে কোনো দেশের ভোক্তাদের মধ্যে পণ্য ও সেবার চাহিদা কমতে থাকলে, বৈদেশিক বাজার দেশটির মুদ্রার ওপর আস্থা হারাতে শুরু করে। এতে যে স্থানীয় মুদ্রা মান হারানোয় যে সার্বভৌম দেনা সংকট দেখা দেয় তা গভীর অর্থনৈতিক সংকটে রূপ নিতে পারে।
দেনাগ্রস্ত দেশের বৈদেশিক বাজার থেকে ঋণ গ্রহণের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়া আরেকটি বড় ক্ষতি। এসময় কেউ ঋণ দিলেও, তা দেয় অনেক চড়া সুদ ও অন্যান্য কঠিন শর্তের ভিত্তিতে। অনেক সময় কঠিন শর্ত মানতে রাজি হলেও ঋণ মেলে না। এতে ওই দেশের ক্রেডিট রেটিংসও নেতিবাচকভাবে মূল্যায়িত হয়। ফলে সেদেশে বিদেশি বিনিয়োগও কমতে থাকে।
- সূত্র: ইন্ডিয়া টাইমস ডটকম