ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের প্রধান পাইপলাইন বন্ধ করতে যাচ্ছে রাশিয়া!
বার্ষিক সারাই/ মেরামত কাজের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) গ্যাস সরবরাহের বৃহত্তম অবকাঠামো নর্ড স্ট্রিম- ১ পাইপলাইন সাময়িকভাবে বন্ধ করছে মস্কো। রাশিয়া থেকে বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে জার্মানি যাওয়া পাইপলাইনটি আগামী ১১ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
ইউরোপ যখন শীতের জন্য গ্যাস মজুদ করতে তৈরি; তখন পাইপলাইনের মেরামত গ্যাস সরবরাহ আরও ব্যাহত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমনকি এই সারাইকালে ক্রেমলিন গ্যাস সরবরাহের পথ পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকে।
শীতে ঘর গরম রাখার পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউরোপীয় দেশগুলো যখন জ্বালানি মজুদ করছে তখনই রাশিয়া এই মেরামত উদ্যোগ হাতে নিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্বালানির ৪০ শতাংশ রাশিয়ার পাইপলাইনের মাধ্যমে এসে থাকে। ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের পর ইইউ যত দ্রুত সম্ভব রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে।
জার্মানির জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রধান ক্লাউস মুলার সিএনবিসিকে বলেন, নির্ধারিত সময় অনুযায়ী মেরামত কাজ শেষ হয়ে গেলেও রাশিয়া ইউরোপের জ্বালানি সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা অব্যাহত রাখতে পারে।
"বার্ষিক সারাই প্রক্রিয়া শুরু হলে স্বাভাবিকভাবেই পাইপলাইন দিয়ে আর কোনো গ্যাস আসবে না। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার পর গ্যাস সরবরাহ পুনরায় চালু হবে কি না আমরা তাও জানি না। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তা পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না," বলেন মুলার।
ইউরেশিয়া গ্রুপের রাজনৈতিক ঝুঁকি বিশ্লেষকরাও একই কথা বলেন।
পুতিনের চালে যদি সারাই কাজের পরেও গ্যাস সরবরাহ ফিরে না আসে তবে গ্রীষ্মের শেষের দিকে মজুদ পরিপূর্ণ করার যে পরিকল্পনা ছিল তা বাস্তবায়িত হবে না বলে জানান ইউরেশিয়া গ্রুপের শক্তি, জলবায়ু ও সম্পদ বিষয়ক পরিচালক হেনিং গ্লয়েস্টেইন।
নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইনের বেশিরভাগ অংশই রাশিয়ার গ্যাস কোম্পানি গ্যাজপ্রমের মালিকানাধীন। প্রতিষ্ঠানটি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
ইইউ নীতিনির্ধারকদের আরেকটি মূলচিন্তা হলো তারা জানে না যে কী ঘটতে পারে, কেননা গ্যাজপ্রমের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ভেঙে গেছে।
মে মাস পর্যন্ত যোগাযোগ থাকলেও এরপর গ্যাজপ্রমের সঙ্গে বন্ধ হয় তাদের যোগাযোগ।
শীতের সরবরাহ
রাশিয়া থেকে ইউরোপে আসা গ্যাস নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
রাশিয়া ইউরোপে গ্যাসের চালান প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে। নর্ড স্ট্রিম-১ এর প্রবাহ আগের মতো স্বাভাবিক মাত্রায় আর ফিরবে কি না তা এখনও অজানা।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এর আগে দাবি করেন, রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস পাঠাতে প্রস্তুত আছে। যে সংকট তৈরি হয়েছে তা ইউরোপের তৈরি বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
জার্মান অর্থমন্ত্রী রবার্ট হেবেক এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি জানান রাশিয়া 'রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে'র ভিত্তিতে সরবরাহ কমিয়েছে। মূলত এই অঞ্চলে অস্থিরতা বাড়িয়ে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করতেই তারা এই কাজ করছে।
গত মাসে জার্মানি জরুরি গ্যাস পরিকল্পনা নিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের 'সতর্কতা জারি' করে। এর অর্থ ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটি দীর্ঘমেয়াদী গ্যাস সরবরাহ সংকটের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকলেও, এখনও হস্তক্ষেপ ছাড়াই বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
জার্মানির ফেডারেল মিনিস্ট্রি অব ইকোনমিকক্স অ্যান্ড ক্লাইমেট অ্যাকশনের একজন মুখপাত্র সিএনবিসিকে বলেন, পাইপলাইনের বাৎসরিক পরিদর্শন কাজ সামনে রেখে সরকার নিবিড়ভাবে গ্যাসের বাজার পর্যবেক্ষণ করছে।
"সরবরাহ নিরাপত্তা এখন পর্যন্ত নির্বিঘ্ন রয়েছে, কিন্তু পরিস্থিতি গুরুতর,' বলেন তিনি।
পুরো ইউরোপের হটস্পট এখন জার্মানি
'জার্মানি পুরো ইইউ-এর জন্য হটস্পটে পরিণত হয়েছে," বলেন গ্লয়স্টেইন। তিনি বলেন, "ইউরোপের বৃহত্তম জনবহুল ও অর্থনীতির দেশ জার্মানি। তারাই সবচেয়ে বেশি গ্যাস ব্যবহার করে। রাশিয়ার গ্যাসের একক বৃহৎ আমদানিকারক জার্মানি। নয়টি দেশের সঙ্গে এর সীমান্ত রয়েছে। সুতরাং জার্মানিতে যা ঘটে তা পুরো ইউরোপেই ছড়িয়ে পড়ে।"
রাশিয়ার গ্যাসের দ্বিতীয় বৃহৎ আমদানিকারক ইতালির সরকার গত সপ্তাহে জানায়, তারা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গেস্টোর দেই সারভিজি এনার্জিটিকিকে গ্যাসের মজুদ বাড়াতে চার বিলিয়ন ইউরো প্রদান করেছে।
জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রিয়া এবং নেদারল্যান্ডসও রাশিয়ার গ্যাসের পরিবর্তে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবহারের ইঙ্গিত দিয়েছে।
তবে রাশিয়া নর্ড স্ট্রিম ১ পাইপলাইনে সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করবে না বলেও মনে করেন গ্লয়স্টেইন। কেননা তা হলে মস্কো নিজেই বিপদে পড়তে পারে।
ক্রেমলিন এর আগে জানিয়েছে সরবরাহ কমার মূল কারণ টেকনিকাল বিভিন্ন ফ্যাক্টর এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ।
এছাড়া রাশিয়া সীমিত পরিমাণে সরবরাহ বজায় রাখলেও বাড়তি দামের কারণে তারা কিছুটা হলেও লাভবান হবে।
"আমাদের মনে হয় রাশিয়া কিছুটা হলেও ছাড় দিবে। সেক্ষেত্রে তারা আসলে একটু দামাদামি করতে চায়। ইউরোপ সামনে নিষেধাজ্ঞা কঠোর করলে যেন তারা পালটা আঘাত হানতে পারে রাশিয়া তা-ই নিশ্চিত করতে চাইছে," বলেন গ্লয়স্টেইন।
সূত্র: সিএনবিসি