জ্বালানি সংকটে একের পর এক অ্যালুমিনিয়াম কারখানা বন্ধ বগুড়ায়
বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় তালোড়া বন্দরে এখনো জ্বালানি তেল পুড়িয়ে অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র তৈরি করা হচ্ছে। অথচ এ বন্দর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে বগুড়া শহরে গ্যাসের সংযোগ রয়েছে। সেখানে জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহার করে এসব পণ্য উৎপাদন চলছে। উৎপাদন খরচও জ্বালানির চেয়ে কয়েকগুণ কম। ফার্নেস ওয়েলে চলা কারখানাগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বিভিন্ন জ্বালানি দিয়ে উৎপাদন খরচ এতো বেশি যে বাধ্য হয়ে ইতিমধ্যে ১১টির মধ্যে ১০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। গত চার বছরের মধ্যে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। গ্যাস সংযোগ না পেলে চলমান একমাত্র সচল কারখানাও বন্ধ করতে হবে।
দুপচাঁচিয়া উপজেলা সদর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে তালোড়া বন্দর। এই বন্দরের সাথে রেল ও নদীপথে যোগাযোগের ব্যাপক সুবিধা রয়েছে। এ কারণে ১৯৫৪ সালে এই বন্দরে মেসার্স খেতওয়াত অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কস নামে একটি তৈজসপত্র তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে।
ব্যবসায়ীরা জানান, মুম্বাইয়ের বাসিন্দা লাদুরাম আগরওয়ালা তৈজসপত্র তৈরির এই কারখানা ওই সময় প্রতিষ্ঠা করেন। পর্যায়ক্রমে চাহিদার প্রেক্ষাপটে এই বন্দরে ১২টি ছোট-বড় কারখানা গড়ে ওঠে, যেখানে স্থানীয় প্রায় ৫ শতাধিক শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। কারখানাগুলোতে হাঁড়ি, পাতিল, গামলা, বালতি, মগসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত এসব তৈজসপত্র বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করা হয়।
কারখানায় ইনগট (অ্যালুমিনিয়ামের বড় বড় পাত), ভাঙারিসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থ কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসব কাঁচামাল আগুনে গলিয়ে নতুন নতুন তৈজসপত্র তৈরি করা হয়। ধাতব গলানোর কাজে ব্যবহার করা হয় ফার্নেস অয়েল, বার্নিং অয়েল ও খড়ি।
কিন্তু ফার্নেস অয়েলের দাম প্রতিবছই লিটারপ্রতি প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ টাকা করে বাড়ছে। ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করে এক কেজি তৈজসপত্র তৈরি করতে ১৬ টাকা পড়ে। অপরদিকে গ্যাস দিয়ে একই পরিমাণের তৈজসপত্র তৈরি করতে খরচ মাত্র ৬ থেকে ৯ টাকা। উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে না পেরে গত কয়েক বছরে ১০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
বিভিন্ন সংকটে ২ বছর আগে বন্ধ হয়ে যায় তালোড়ার প্রগতি অ্যালুমিনিয়াম। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক নূরে আলম চৌধুরী বলেন, 'শহরের দিকে গ্যাসের কারখানা হওয়ার কারণে আমাদের ব্যবসায় প্রথম ধাক্কা লাগে। কারণ আমাদের কারখানায় প্রধান জ্বালানি হচ্ছে ফার্নিস ওয়েল। গত কয়েক বছর ধরে এই জ্বালানির দাম হু হু করে বেড়েছে। এতে আমাদের উৎপাদন খরচও বেড়েছে বহুগুণে। তাই আমরা টিকতে পারিনি। আবার বগুড়ার শিল্প এলাকায় কোনো প্লট আমাদের নামে বরাদ্দ না থাকায় কারখানাও স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি।'
এই শিল্পের পুরোনো ব্যবসায়ী তালোড়া অ্যালুমিনিয়ামের মালিক পবন প্রসাদ পোদ্দার। তিনিও কারখানা বন্ধ করেছেন প্রায় এক বছর হলো। কারণ জানতে চাইলে এই ব্যবসায়ী বলেন, 'সংকট শুরুর কয়েক বছর আগে থেকেই, শহরের উপকেন্দ্রের কারখানাগুলোতে জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হয়। আমরা যারা উপজেলা পর্যায়ে কারখানা করে দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের সুযোগে অংশীদার হতে চাই সেখানে সরকারের গ্যাস সংযোগ দিতে অনীহা। তার ফল এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। জ্বালানি তেলের নাম বৃদ্ধি হওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে আমাদের কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কর্মসংস্থান হারিয়েছে অর্ধশত মানুষ।'
বাপ-দাদার আমল থেকে তালোড়া এলাকায় অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবসা ছিল গৌরি শংকরের। বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁসহ আশেপাশে তার উৎপাদিত অ্যালুমিনিয়ামের পণ্যের এখনো খুব চাহিদা আছে। চাহিদা প্রেক্ষাপটেই তালোড়া বাজারে অর্ধশত শ্রমিক নিয়ে চলছিল কারখানা। কিন্তু কাঁচামাল, জ্বালানি সংকটের কারণে গত চারমাস হলো কারখানা বন্ধ রেখেছেন গৌরি। এই ব্যবসায়ী জানান, যেসব কারখানায় গ্যাস সংযোগ রয়েছে সেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য উৎপাদনে ১ লাখ টাকা খরচ হলে আমাদের হচ্ছে ৫ লাখ। একই পণ্য উৎপাদনের খরচে তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় টেকা সম্ভব হচ্ছে না। এখন অ্যালুমিনিয়ামের কারখানা বন্ধ করে পুঁজি ভেঙে খাচ্ছি।
রয়েল অ্যালুমিনিয়ামে প্রায় ১৬ বছর ধরে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন শফিকুল ইসলাম বাবু। এখন তিনি নিজেই ছোট করে কারাখানা গড়েছেন। মূলধন বিনিয়োগ করেছেন মূলত বেসরকারি সংস্থা ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। গত দু'বছর ধরে করোনা তাকে প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
শফিকুল জানান, তালোড়া বাজারে অন্য কারখানার চেয়ে তার উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা অনেক বেশি। কারণ তিনি শুধু টিফিন ক্যারিয়ার বক্স তৈরি করেন। কিন্তু করোনার ধাক্কায় তিনি পুঁজি হারিয়েছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা ছোট করে চালাচ্ছেন। কিন্তু এর সুদের হার খুব বেশি। এই কারণে সরকারের কাছে কম সুদে ঋণের দাবি করেছেন এই ছোট উদ্যোক্তা।
তালোড়া বাজারে শ্রমিকদের দিক বিবেচনা করে একমাত্র কারখানা চালু রেখেছেন সুভাস প্রসাদ কানু। সৌরভ অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কসের মালিক তিনি। এই ব্যবসার করুণ পরিণতির কথা উল্লেখ করে বলেন, 'গ্যাসের সংযোগ পেলেই কারখানাগুলোতে উৎপাদন দ্বিগুণ হবে। উৎপাদন খরচও কম পড়বে। এক মাসের ফার্নেস অয়েলের খরচ দিয়ে ছয় থেকে সাত মাস গ্যাস কিনে তৈজসপত্র উৎপাদন করা যাবে। এলাকায় শ্রমিকেরা বেকার থাকবে না। এ বিষয়ে গ্যাস সরবরাহকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে।'
সুভাস আরও জানান, চার বছর আগে যখন বগুড়ায় গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়, তখন এ বন্দরের ব্যবসায়ীরা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে গ্যাসের দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছেন। কিন্তু তাদের দাবি আর বাস্তবায়িত হয়নি।
তিনি আরও বলেন, 'দুপচাঁচিয়ায় শ্রমিক নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বাড়ির কাজের পাশাপাশি এখানে কাজ করেন তারা। কিন্তু তেল দিয়ে গালাই করে এই উৎপাদন দুরূহ ব্যাপার। জ্বালানি সংকটের কারণে এই ব্যবসা না হলে ব্যবসায়ীরা অন্য কিছু করবে। কিন্তু শ্রমিকরা কী করবে? তাদের কী হবে? এই বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় নেওয়া দরকার।'
অন্য কারখানা বন্ধ হওয়ার পর সৌরভ অ্যালুমিনিয়ামে গত দুই মাস আগে কারিগরের কাজ নেন আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'প্রায়ই শোনা যায় কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। সব সময় ভয়ে থাকি, কারণ একদিকে কাজের সংকট। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য লাগামছাড়া। একটি কারখানা চালু রয়েছে, এটিও বন্ধ হলে আমরা কীভাবে চলব, তা জানি না। তবে তালোড়ার কয়েকশ শ্রমিকের জীবনের কথা মাথায় নিয়ে সরকারের উচিত এখানে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া।'
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) উপ-মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান বলেন, 'বিসিকের পক্ষ থেকে ছোট উদ্যোক্তাদের অল্প সুদে ঋণ দেওয়া হয়। কেউ যোগাযোগ করলে তাদের ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। একই সাথে উদ্যোক্তাদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হবে। আর বগুড়া উত্তরবঙ্গের মধ্যে শিল্পাঞ্চল। এখানে অনেক ব্যবসায়ী। এই কারণে বিসিকে আপাতত তাদের জন্য জায়গা বরাদ্দ দেওয়া কঠিন। তবে আরেকটি বিসিক নগরী হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। তখন বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।'
তালোড়া অ্যালুমিনিয়াম শিল্প বাঁচাতে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে বগুড়ার জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক বলেন, 'সরকারের পক্ষ থেকে শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগের সুযোগ রয়েছে। এই বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করব। একই সাথে পত্রযোগে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জানাব কীভাবে এই শিল্পকে বাঁচানো যায়।'