পুড়ছে ইউরোপ, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী ছাড়াল
খরতাপে জ্বলছে ইউরোপ। দক্ষিণ থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে উত্তরে সরে আসছে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ। এতে করে মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) নাগাদ পশ্চিম ইউরোপবাসীও অসহনীয় গরমের শিকার হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, মঙ্গলবার সেদেশের কনিংসবি'তে ৪০.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াম তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা এপর্যন্ত সর্বোচ্চ।
ইতোমধ্যে ফ্রাসে জারি করা হয়েছে চরম তাপমাত্রার সতর্কতা। গতকাল সোমবার (১৮ জুলাই) উত্তর স্পেনে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
তাপপ্রবাহের কারণে ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন ও গ্রীসের বনে লেগেছে মারাত্মক দাবানল, প্রাণ বাঁচাতে এসব দেশের হাজার হাজার নাগরিককে তাদের বাড়িঘর থেকে সরিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
স্পেনের উত্তরপশ্চিম জামোরা অঞ্চলে দাবানলে দু'জনের মৃত্যু হয়েছে। রেলপথের কাছাকাছি আগুন বিস্তার লাভ করায় বন্ধ রাখা হয়েছে ট্রেন সার্ভিস। উত্তর পর্তুগালে দাবানল থেকে পালানোর চেষ্টাকালে মারা গেছেন বয়োজ্যেষ্ঠ এক দম্পতির উভয়েই।
ফ্রান্সের বেশকিছু অঞ্চলে সবচেয়ে উষ্ণ দিনের রেকর্ড হয়েছে। দেশটির জাতীয় আবহাওয়া দপ্তরের তথ্যমতে, পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর নানতেস- এ তাপমাত্রা ছিল ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
দাবানল বিস্তার লাভ করতে থাকায় বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ। উদ্ধারকৃতদের জন্য জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করেছে ফরাসি সরকার। একটি চিড়িয়াখানার প্রায় এক হাজার প্রাণীকেও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
দাবানল পরিস্থিতি ফ্রান্সে সবচেয়ে বাজে রূপ নিয়েছে দক্ষিণপশ্চিমের জনপ্রিয় পর্যটন অঞ্চল জিঁরোন্ডে। সারা দেশ থেকে দমকল কর্মীদের টিম এসে সেখানে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যেই আগুনে পুড়ে গেছে ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর বনভূমি, কৃষিজমি ও জনপদ। বাতাসের দিকপরিবর্তন হওয়ায় ধোঁয়ার চাদরে ঢাকা পড়েছে বোঁর্দো শহর।
জিঁরোন্ডের আঞ্চলিক প্রেসিডেন্ট জ্যাঁ-লুক গ্লেজ বলেন, ' এ যেন আগুনে দৈত্য। বিশালাকায় দানবিক অক্টোপাসের মতো সামনে-পিছনে, ডানে-বাঁয়ে সবখানে বিস্তার লাভ করছে। অসহনীয় খরতাপ ও বাতাসের গতি তো আছেই, তার সাথে বাতাসে জলীয়বাষ্পের অভাবে–এটি দানবে রূপ নিয়েছে। এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা খুবই কঠিন'।
সোমবার জিঁরোন্ডে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছিল–যা আজ মঙ্গলবার কমার আভাস দেওয়া হয়। তবে শুস্ক আবহাওয়া ও দিকভ্রান্ত এলোমেলো বাতাসের উৎপাত না কমলে তাতে দাবানলের বিস্তার হতেই থাকবে।
চরম উত্তাপ এখন ইউরোপের উত্তর ও পূর্ব দিকে আঘাত হেনেছে। ফ্রান্সের ব্রিটানি অঞ্চলের উত্তরপশ্চিমেও লেগেছে দাবানল। এতে পুড়ে গেছে ১,৪০০ একর জমির গাছপালা ও সবুজ আচ্ছাদন।
ইংলিশ চ্যানেলের ওপাড়ে মধ্য, উত্তর ও দক্ষিণপূর্ব ইংল্যান্ডে চরম তাপমাত্রার সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া দপ্তর। মঙ্গলবার সেখানে রেকর্ডকালীন ইতিহাসে প্রথমবার ৪০ ডিগ্রী ছাড়িয়েছে তাপাঙ্ক।
নেদারল্যান্ডসে গত সোমবার চলতি বছরের সবচেয়ে উত্তপ্ত দিনের রেকর্ড হয়। এদিন তাপাঙ্ক ছিল ৩৩.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আজ মঙ্গলবার কিছু এলাকায় তা ৩৯ ডিগ্রী ছাড়িয়ে যাওয়ার আভাসও দেওয়া হয়।
তাপপ্রবাহ উত্তর দিকে ধেয়ে আসতে থাকায় বেলজিয়ামসহ পশ্চিম ও দক্ষিণপশ্চিম জার্মানিতে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী ছাড়িয়ে যাওয়ার আভাসও দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে জার্মানির ডুইসবুরগ শহরে ৪১.২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের সর্বোচ্চ জাতীয় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল।
বিগত কিছুদিনে স্পেন ও পর্তুগালে প্রায় ১,০০০ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়েছে অত্যধিক তাপমাত্রা-জনিত অসুস্থতাকে। স্পেনের লসেসিও অঞ্চলে দাবানল নেভাতে গিয়ে মারা গেছেন এক দমকল কর্মী। এর আগে গত সোমবার উদ্ধার করা হয় ৬৯ বছরের এক মেষপালকের লাশ।
গত বৃহস্পতিবার পর্তুগালে তাপমাত্রা ছিল ৪৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। দেশটির আবহাওয়া বিভাগ চরম উষ্ণতার কারণে পুরো দেশকে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করে।
উত্তর পর্তুগালের মুর্কা অঞ্চলে আগুন লাগায় বেশ কয়েকটি গ্রামের অধিবাসীদের সরিয়ে নেওয়া হয়। অগ্নিদূর্গত এলাকা থেকে পালানোর সময় গাড়িতেি মারা গেছেন ৭০ বছরের দুই পুরুষ ও নারী। তিন দিক থেকে অগ্রসর হচ্ছে আগুন। নেভাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন দমকল কর্মীরা। সেখানে ৩ হাজার হেক্টর ভূমি পুড়ে গেছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালের মতো ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। সে বছর দাবানলে ৬৬ জনের মৃত্যু হয়।
স্পেনের ২০টি জায়গায় বন, ঘাসজমি বা শস্যক্ষেতে আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ভয়াবহ এক দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করেছেন এক ট্রেনযাত্রী। ভিডিওতে দেখা যায়, দুই পাশ থেকে ট্রেনের কামরার দিকে আগুন এগিয়ে আসছে। এসময় ট্রেনটি থামতে বাধ্য হয়। ঘটনাটি ঘটেছে স্পেন ও উত্তর পর্তুগালের সীমান্তে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপপ্রবাহ আরও ঘন ঘন ও তীব্র রূপে দেখা দিচ্ছে। থাকছেও আরও বেশি সময়। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১.১ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বিশ্বের সরকারগুলি যদি একযোগে উদ্যোগ না নেওয়ায় এবং গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ না কমায় তাহলে এটি বাড়তেই থাকবে।
- সূত্র: বিবিসি