কম বৃষ্টিপাতে ধানের ফলন নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে
পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাবে ভারতের কিছু রাজ্যে কমেছে ধান রোপণের জমির পরিমাণ। অন্যদিকে, চীনের দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান চাল উৎপাদনকারী প্রদেশগুলোয় হয়েছে ব্যাপক বৃষ্টি ও বন্যা–যা সেদেশেই খাদ্য নিরাপত্তার শঙ্কা তৈরি করেছে।
বিশ্বের প্রধান দুটি উৎপাদনকারী দেশে এই অবস্থা হওয়ায়–গমের পর চাল এবার বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
চীন বিশ্বের বৃহত্তম চাল উৎপাদক হলেও–একইসঙ্গে শস্যটির সবচেয়ে বড় আমদানিকারক। সেদেশে কম উৎপাদনের অর্থ- এশিয়ার অর্থনৈতিক পরাশক্তিটি এখন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আরও বিপুল পরিমাণে ক্রয়ের উদ্যোগ নিবে; এতে অন্যান্য ক্রেতা দেশের জন্য যোগান কমবে।
আর এখানেই ওয়ার্ল্ড এগ্রিকালচারাল প্রোডাকশন্স ডটকম- এর সূচকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ চাল উৎপাদকের অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের জন্য শঙ্কার কারণ নিহিত। যেহেতু, স্থানীয় উৎপাদনের পাশাপাশি প্রধান খাদ্যশস্যটির বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখতে আমাদের আমদানিও করতে হয়।
এই মৌসুমে অপর্যাপ্ত বৃষ্টি দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ ধান ফসল আমনের চারা রোপণকে পিছিয়ে দিচ্ছে অনেক অঞ্চলে। কৃষকদের কাছে সারের প্রাপ্তিও হয়েছে উঠেছে উদ্বেগের বিষয়; সাম্প্রতিক সময়ে ইউরিয়ার মূল্যবৃদ্ধির পর কিছু ডিলার ইচ্ছে করেই সার সরবরাহ কম করছে বলেও অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।
দিনাজপুরের কয়েকজন কৃষককে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, তারা স্থানীয় বাজারে সার পাচ্ছেন না।
গতকাল (৪ আগস্ট) কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অতি-ব্যবহার কমাতেই প্রতিকেজিতে ইউরিয়ার দাম ৬ টাকা বাড়ানো হয়েছে, এতে চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
বিশ্ববাজারে ৪০ শতাংশ চালের যোগান দেয় ভারত। সেখানে উৎপাদন কম হলে- বাংলাদেশের জন্য ভারত থেকে আমদানির সুযোগও বন্ধ হবে বলে আশঙ্কা করছেন আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা। আর দেশটির প্রধান উৎপাদক অঞ্চলে অনাবৃষ্টির কারণে এবার ফলন কম হওয়ারই পূর্বাভাস রয়েছে।
এদিকে দেশে প্রচন্ড তাপদাহের পর স্বস্তির বৃষ্টি শুরু হয় জুলাইয়ের শেষ দিকে। তবে আমন রোপণের বাকি সময়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই বলেই জানাচ্ছে আবহাওয়ার পূর্বাভাস। জমিতে ধান লাগালে পরে গিয়ে সেচ খরচ বাড়বে– দেশের অনেক অঞ্চলের কৃষকের কপালেই এখন এই শঙ্কা চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। যতটুকু জমিতে তারা আমন রোপণের চিন্তা করেছিলেন–হয়তো অনেকেই ততখানি জমিতে আবাদ করবেন না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, ৫৯.০৫ লাখ হেক্টর জমিতে আমন রোপণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও, এখন পর্যন্ত রোপণ হয়েছে ১৫.৭৪ লাখ হেক্টর জমিতে।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহের পর বৃষ্টিপাত আবার কমার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানাচ্ছে আবহাওয়ার পূর্বাভাস। এতে আমনের ফলন কমার শঙ্কা করছেন কৃষকরা।
দিনাজপুর সদর উপজেলার কৃষক দেবেন রায় বলেন, 'দেরিতে আমন লাগালে উৎপাদন কমে যায়। আবার যদি পানির অভাব হয়- সেটাও উৎপাদন কমিয়ে দিবে'।
দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা জানিয়েছেন, স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত ইতোমধ্যেই আমনের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে জুলাই মাসে গড় বৃষ্টিপাত হয়েছে ৪৯৬ মিলিমিটার। কিন্তু, এই বছরের জুলাইয়ে মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ২১১ মিলিমিটার- যা ১৯৮১ সালের পর সর্বনিম্ন।
তবে কৃষিমন্ত্রী ড. মো আব্দুর রাজ্জাক টিবিএসকে বলেছেন, ' এখন স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ফলে আগষ্টের মাঝামাঝিতেই আমন রোপণ শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করছি'।
গত আমন মৌসুমে সারাদেশে প্রায় ১.৫ কোটি টন চাল উৎপাদনের তথ্য দিচ্ছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। হেক্টরপ্রতি ফলন ছিল ২.৬ টন।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)-র মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'ধানের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়– ফুল আসার সময়ে যদি পানির অভাব তৈরি হয়। এ ছাড়া চারার স্বাস্থ্য খারাপ হলেও ফলন খারাপ হবে'।
আমদানির সুযোগও সংকোচনের ঝুঁকিতে
সরকারি তথ্যমতে, গত বোরো মৌসুমে দুই কোটি টনের বেশি ধানের ফলন হয়েছিল।
তারপরও প্রধান খাদ্যশস্যটির স্থানীয় বাজার স্থিতিশীল রাখতে কর্তৃপক্ষকে আরও ১০ লাখ টন চাল আমদানির পারমিট দিতে হয়েছে। কিন্তু, ডলারের মান বৃদ্ধি এবং সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানিকারকদের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি উদ্যোগের কাঙ্ক্ষিত সুফল বাজারে পড়েনি।
কিন্তু পর্যন্ত দেশে ২০ হাজার টনের বেশি চাল আসেনি। অনুমতি পাওয়ার পরও অনেক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এলসি (ঋণপত্র) খুলছে না।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (বৈদেশিক সংগ্রহ) মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে জানান, তারা আমদানি পর্যবেক্ষণ করছেন। মন্ত্রণালয় এলসি খোলার সময়ও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আমদানিকারকরা বলছেন, চাল আমদানি না হওয়ার প্রধান কারণ হলো- ডলারের মূল্য বৃদ্ধি। দেশের চাল আমদানির ৮০ ভাগই হয় প্রতিবেশী দেশ- ভারত থেকে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, বাংলাদেশের আমদানির খবরে দেশটির রপ্তানিকারকরা ১০ শতাংশ পর্যন্ত চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, এই অবস্থায় চাল আমদানি করলে যে দাম পড়বে- তার খুচরা মূল্য দেশে উৎপাদিত চালের চেয়ে বেশি হবে।
বাংলাদেশ অটো-মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সহসভাপতি শহিদুর রহমান পাটোয়ারী টিবিএসকে বলেন, 'শুধু ডলারের কারণেই প্রতি কেজিতে খরচ বেড়েছে প্রায় ২০ টাকা'।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় চাল রপ্তানিকারক ভারতের কিছু অংশে- বৃষ্টির ঘাটতির কারণে চালের উৎপাদন কমে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহের জন্য পরবর্তীতে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়াবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপ্রদেশসহ কিছু রাজ্যে বৃষ্টিপাতের অভাবে এই মৌসুমে ধান রোপণের জমি ১৩ শতাংশ কমেছে।
ভারত ইতোমধ্যেই খাদ্য নিরাপত্তার অংশ হিসেবে ও স্থানীয় মূল্য নিয়ন্ত্রণে গম এবং চিনি রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে।
ব্যবসায়ী ও শস্যটির আমদানিকারকরা বলছেন, উৎপাদন কমলে ভারত রপ্তানি সীমিত করতে পারে। এতে বাংলাদেশসহ তাদের দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশী দেশগুলি পড়বে চরম বিপাকে। কারণ, বাংলাদেশের সামনে ভিয়েতনাম, চীন, থাইল্যান্ড, মায়ানমার থেকেও খুব বেশি আমদানির সুযোগ নেই।